আজ ৩৯তম ওফাত বার্ষিকী অধ্যক্ষ মাওলানা হাফেজ আবুল হাসান রহ.

123

রায়হান আজাদ

ইসলাম একটি জ্ঞানভিত্তিক ধর্ম। কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা যতদিন সমাজে চালু থাকবে ততদিন জাহিলিয়াত ও গোমরাহী মাথাচাড়া দিয়ে ঊঠতে পারবে না। মাদারাসা আছে বলেই মসজিদ বিরাজমান। সবারই তো জানা, এ মসজিদই হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মারকাজ বা কেন্দ্রস্থল। ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে বাঁশখালীর জবরদস্ত আলিম মাওলানা আবুল হাসান রহ. ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। তিনি বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে বহু মাদরাসার শিক্ষক, সুপারিনটেনডেন্ট, প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং সর্বশেষ বাঁশখালী জলদি হোসাইনিয়া ফাযিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সর্বমহলে সুপরিচিতি লাভ করেন। তার ৩জন ছেলেই ফাযিল-কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং মেয়ে জামাতারাও একইভাবে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ভূমিকা রেখে ওফাত হয়েছেন। তাই তিনি একজন গর্বিত বাবাও। আজ ৩০ জুন ২০২০ সাল মাওলানা আবুল হাসান (রহ.) এর ৩৯তম ওফাত বার্ষিকীতে মাওলানার বর্ণাঢ্য জীবনের উপর সম্যক আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব, ইনশাল্লাহ।
জন্ম ও শিক্ষা : মাওলানা আবুল হাসান বাঁশখালী উপজেলাধীন জলদি ভাদালিয়া গ্রামে ১৮৮৩ সালে পৈত্রিক নিবাসে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মাওলানা বরকত আলী, তিনি অত্যন্ত পরহেজগার ও সমাজহিতৈষী ছিলেন আর মা হচ্ছেন রহিমা বেগম। খুব সম্ভবত তাদের পূর্বপুরুষ সুদূর জাযিরাতুল আরব হতে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন।
বাল্যকালে পারিবারিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করে মাওলানা আবুল হাসান আনোয়ারা উপজেলার বোয়ালিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একমাত্র দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিটাগাং মোহসিনিয়া মাদরাসায় (১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত) দাখিল স্তর সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে ভারতের কলিকাতা গমন করে সেখানকার সরকারি আলিয়া মাদরাসা হতে ১ম শ্রেণীতে কামিল পাশ করেন। অতপর তিনি ১৯১৫ সালে কুরআন হাদীস, ফিক্হ ও কালাম শাস্ত্রে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য সাহরানপুর গমন করেন। সেখানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে উচ্চতর কোর্স সমাপ্ত করেন। ইতিমধ্যে অনন্য মেধাবী এ মাওলানা নিজ উদ্যোগে মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে সমগ্র কুরআন হিফজ করে ফেলেন।
কর্মজীবন : ভারত থেকে উচ্চ শিক্ষা সমপন্ন করে দেশে এসে তিনি ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হাটহাজারী মইনুল ইসলাম মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর রাজধানী ঢাকার হাম্মাদিয়া মাদরাসায় প্রায় ২০ বছর সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অধুনালুপ্ত এ মাদরাসার স্থলে বর্তমানে একটি হাইস্কুল পরিচালিত হচ্ছে। এরপর তিনি নরসিংদী কুমরাদী সিনিয়র মাদরাসায় স্থানান্তরিত হন। এখানে ১০ বৎসর দায়িত্ব পালনের পর তিনি নিজ এলাকার শতাব্দী প্রাচীন (১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন কলিকাতা মাদরাসা বোর্ডের অধীনে অল ইন্ডিয়ার ১৩ম মাদরাসা) পুইছড়ী ইসলামিয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসায় চলে আসেন। এখানেও অত্যন্ত সুনামের সাথে ১৯৪৯-১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সুযোগ্য অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ নিজ প্রতিষ্ঠিত হোসাইনিয়া মাদরাসায় তিনি প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতা জীবনে তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে খতীবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (১৯০৩-১৯৮৭),ব্যারিস্টার ড.সানাউল্লাহ (১৯০৫-১৯৬৩), মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরী (মৃত্যু-২০১৯) প্রমুখ।
পারিবারিক জীবন : মাওলানা আবুল হাসান শিক্ষাজীবন শেষে ১৯১৬/১৭ সালের দিকে বাঁশখালীর খ্যাতিমান আলিম সম্পর্কে আমার মায়ের নানা গোল্ড মেডেলিস্ট অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল কাদের প্রকাশ বড় মাওলানা সাহেব রহ. (১৮৬০-১৯৪০) এর ২য় কন্যা হাজেরা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাওলানা আবদুল কাদেরের পিতা ছিলেন শাহছুফী মাওলানা মনছুর আলী রহ. যার নামের নিসবতে বর্তমানে বাঁশখালীতে মনছুরিয়া বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংসারিক জীবনে মাওলানা দম্পতির ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে। ১ম ছেলে অকালেই মারা যায়। ২য় ছেলে মাওলানা ফৌজুল কবির (এম.এম.স্কলার এবং ডবল এম.এ. ঢাবি) কর্মজীবনে তিনি গারাঙ্গিয়া আলিয়াসহ ৭টি ফাজিল-কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। অপর দুই ছেলে মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ (মৃত্যু-২০১৭) এবং মাওলানা হাফেজ মুস্তাফিজুর রহমানও দীর্ঘদিন যাবত পিতৃ প্রতিষ্ঠিত জলদি হোসাইনিয়া মাদরাসায় প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। আর মেয়েদের সকলেই সুযোগ্য আলিম পরিবারে পাত্রস্থ হয়।
সমাজকর্ম : এলাকার দুস্থ-পীড়িতের পাশে দাঁড়ানো ছিল মাওলানার স্বভাব। ইসলামী শিক্ষার খিদমতে তিনি পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সুযোগ পেলেই তিনি লোকজনকে ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে আমলী জিন্দেগী পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস চালাতেন। তিনি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ১৯৪৭ সালে নিজ বাড়ীর পাশে জলদি হোসাইনিয়া ফাযিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ মাদরাসা কামিল (এম.এ) মানে উন্নীত হয়েছে। উপজেলা ও পৌরসভা সদরে অবস্থিত একমাত্র এম.পিওভূক্ত মাদরাসা হওয়ায় এখানেই পুরো বাঁশখালী উপজেলার বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পরীক্ষাসমূহ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া তিনি নিজ এলাকায় আরো কয়েকটি মসজিদ-মাদরাসা ও ফোরকানিয়ায় আজীবন খেদমত করে গেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় মাওলানার এক দৌহিত্র কামরুল ইসলাম হোসাইনী বাঁশখালী পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র হিসেবে সমাজসেবায় ব্যাপক অবদান রেখেছেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ইন্তেকাল : মাওলানা আবুল হাসান ছিলেন সৎ, মেধাবী ও সাহসী আলিম এবং একজন দক্ষ মুফতি। তিনি ইলমে দ্বীনের আলোয় আলোকিত সোনার মানুষ। পানজাগানা নামায জামাতে ছাড়াও তিনি প্রচুর নফল ইবাদত করতেন। ফকীর-মিসকীনদের প্রতি ছিলেন রহম দিল। হিফজ করার পর হতে তিনি প্রতি বছর খতমে তারাবীহ পড়াতেন কিন্তু এর বিনিময় স্বরূপ কেউ তাকে এক কপর্দকও দিতে পারেনি। পঞ্চাশের দশকে তিনি পানির জাহাজে করে ফরজ হজ্ব সমপন্ন করেন।
তিনি বার্ধক্যের চাপে ন্যূয়ে পড়লে অবশেষে ৩০ জুন ১৯৮১ সালে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। জানাজা শেষে তাকে এলাকার সামাজিক কবরস্থানেই দাফন করা হয়। তিনি দুনিয়া থেকে চলে গেলেন কিন্তু রেখে গেলেন ইলমে দ্বীনের বিশাল খিদমত। ইসলামী শিক্ষায় তার অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আল্লাহ পাক তাকে পরকালে নাজাত ও আ’লা দরজা দান করুন। আমীন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার