আজ মাধ্যমিকে ভর্তি ইচ্ছুকদের ভাগ্য পরীক্ষা

56

লিটন দাশ গুপ্ত

কাব্যিক বিবেচনায় অক্ষরবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে ‘ভাগ্য’ শব্দটি দুই মাত্রায় নির্ধারিত হয়। ছন্দের নিরিখে ভাগ্য দুই মাত্রার হলেও এই নিয়ে সকল মানুষের মধ্যে রয়েছে দ্বিমত ও মতের ছন্দপতন! অর্থাৎ পৃথিবীতে ভাগ্য আছে কি নাই, এই নিয়ে মতপার্থক্য। বেশীর ভাগ মানুষ ভাগ্য বিশ্বাস করলেও একাংশ মানুষ মনে করে ভাগ্য বলতে কিছু নেই; মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নির্মাতা। যুক্তি হিসাবে এদের ভাষ্য ‘কর্মই ধর্ম’ বা কর্মই ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার। অর্থাৎ ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ হবে। আরো বুঝিয়ে যদি বলি, ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ বা ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’। এই জাতীয় প্রবাদ প্রবচনগুলো অস্বীকার করার উপায় নাই। আবার এর বাইরেও আছে; ‘অদৃষ্টের পরিহাস’ ‘কপালের লিখন যায়না খÐন’ ইত্যাদি কত কথা। এই কথাগুলোও কিন্তু অস্বীকার করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
আমরা এরই মধ্যে জেনেছি, এবারের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাচ্ছে লটারির ভিত্তিতে। যেখানে মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে বলা যাবেনা। তবে ‘ভাগ্য পরীক্ষা’ বলা যাবে। এখানে কোন শিক্ষার্থীর মেধা পরিশ্রম অধ্যাবসায় ইচ্ছা চেষ্টা ইত্যাদি কার্যত অচল, অর্থাৎ এইগুলো কোন কাজে আসবেনা। কাজে আসবে কেবল অদৃশ্য এক সহায়ক শক্তি যার নাম ‘অদৃষ্ট’ বা ‘ভাগ্য’।
যাইহোক লেখায় গৌরচন্দ্রিকা আর বৃদ্ধি করতে চাই না। তবে আমি মনেকরি, পরিশ্রম যেমন সৌভাগ্যের প্রসূতি, তেমনি ‘কপালে যা লিখন থাকে তা আজীবন, শত চেষ্টাতেও দাগ ঘুচবেনা…।
এবার আসি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লটারির মাধ্যমে ভর্তির বিষয়ে। আমাদের দেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় থেকে চলে আসছে পরীক্ষা পদ্ধতি। এই ভর্তি পরীক্ষাকে বিভিন্ন মিডিয়াতে ভর্র্তিযুদ্ধ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। কারণ যুদ্ধকালীন সামরিক বাহিনীতে যে তৎপরতা, তা ভর্তি কালীন সময়ে ছাত্রছাত্রী অভিভাবক সংশ্লিষ্টদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণি শেষে, পঞ্চম শ্রেণিতে শিশু শিক্ষার্থীর ভর্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ লক্ষ্য করে আসছি। এই সম্পর্কিত ২০১৪ সালে ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ও কিছু কথা’ শিরোনামে উসম্পাদকীয়তে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তখনই বলেছিলাম, ৪র্থশ্রেণি শেষে একজন শিশু শিক্ষার্থীর জ্ঞান মেধা বয়স বুদ্ধি পরিপক্কতা ইত্যাদির তুলনায় ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত কঠিন। তাই ভর্তি পরীক্ষা শিশুর মানসিক আবেগিক চাপ, তাদের সামগ্রিক বিকাশে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এমন কি অত্যাধিক চাপে ক্ষীণ মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। ছোট একটা উদাহরণ দিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কাঠিন্যতা সম্পর্কে ধারণা দিতে চাই। এসিটিবি’র পাঠ্যবইয়ে প্রথম মলাটে রচনা সম্পাদনা কিংবা প্রথম প্রকাশকাল এই ধরণের তথ্যসমূহ থাকে যা শিশুদের পাঠ্য বিষয়বস্তু নয়। কেবল দায়দায়িত্বে থাকা নামের স্বীকৃতি ও তথ্য লিপিবদ্ধ করণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা কচিকাচা শিশু শিক্ষার্থীর বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। কিন্তু দেখা যায়, কত সাল থেকে এই বই পাঠ্যপুস্তকরূপে গৃহীত হয়েছে, কিংবা বইটির শিল্প সম্পাদনার দায়িত্বে কে ছিলেন ইত্যাদি রকমের প্রশ্ন ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আমরা জানি ৪র্থ শ্রেণিতে ৬টি বিষয় আছে। এখানে দেখা যায়, ৬টি বিষয়ের মধ্যে অনেকেই ভর্তি সংশ্লিষ্ট গণিত বাংলা ইংরেজী তিন বিষয় অতিরিক্ত পড়াতে গিয়ে, অপর তিন বিষয় যেমন সমাজ বা বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান ধর্ম একেবারেই পড়ায় না বা পড়ানো হয়না। অনেকেই স্কুল বাদ দিয়ে প্রাইভেট টিউটর আর নামিদামি কোচিং-এ সকাল বিকাল টানা হেঁচড়া করতে গিয়ে, নিজেদের অজান্তে শিশুকে বহুমুখী সমস্যায় ফেলে দেয়। আবার অনেকেই ভর্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, ৪র্থ শ্রেণিতে দুই তিন বছর অতিরিক্ত পড়িয়ে ৫ বছরের প্রাথমিক শিক্ষাচক্র ৭/৮ বছরেও শেষ করতে পারেনা। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের স্বপ্নের স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে সত্যিকারের জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে ৩/৪ বছর পর্যন্ত কমিয়ে জন্মনিবন্ধন করার প্রবণতা। এমনকি কোনটা সুবিধা কোনটা অসুবিধা সিদ্ধান্তহীনতায় বারে বারে জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করে থাকে। অথচ ভর্তির জন্যে এতসব করা হলেও সামগ্রিক দিক বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চিরুনী তল্লাসির মাধ্যমে যাচাই বাছাই করা শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আলোকিত করছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীকে আলোকিত করছেনা।
শুধু তাই নয়, ভর্তি পরীক্ষার কারণে সরকারের একীভূত শিক্ষার যে কার্যক্রম, সকল প্রকার শিক্ষার্থী বা ছাত্রছাত্রী এক সাথে পাঠদান, এই ধরণের ভর্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচেতন অভিভাবক ও মেধাবী শিক্ষার্থী পৃথক হয়ে যাওয়ায় একীভূত শিক্ষা বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া ভর্তির সাফল্য না পাওয়া শিক্ষার্থী পরবর্তী শিক্ষা জীবনে হীনমন্যতাসহ মানসিক দ্ব›েদ্ব ভুগে। অন্যদিকে ভর্তি পরীক্ষার দিন কেন্দ্রে গিয়ে বাস্তবে দেখেছি, শিক্ষক ছাত্রছাত্রী অভিভাবক ও সংশ্লিদের ভিড়ের ভিতর ঠেলে, শিশু পরীক্ষার্থীকে অনেক অভিভাবক কোলে মাথায় কাঁধে নিয়ে মূলফটক পর্যন্ত কোন রকমে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে থাকে। নিরাপত্তাবাহিনী বা পুলিশের বাঁশি, গাড়ির হুইশেল জনসাধারণের আওয়াজ যেন পরীক্ষা নয়, একধরনের বিভীষিকাময় অজানা আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যে শিশুদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এতে অনেক শিশু পরীক্ষার্থী হারিয়ে গিয়ে কান্না করতে আবার কেউ মূর্ছায় পড়তে দেখা গেছে। এ্ই অবস্থায় আমার মনে হয় করোনা বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিবেশের মত আমাদের জাতীয় জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা সত্য। তবে মিথ্যা নয় শিশুদের করোনার কারণে লটারি প্রক্রিয়ায় ভর্তি ফলে কিছু একটা ভালো হয়েছে। লোকে বলে সকল খারাপের মধ্যে কিছু কিছু ভালো লুকিয়ে থাকে! একটি অচল নষ্ট ঘড়িও নাকি দিনে দুইবার সঠিক সময় প্রদান করে থাকে। তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, করোনা ভাইরাস অভিশাপ হলেও কচিকাচা এইসব শিশু শিক্ষার্থীর জন্যে আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দিয়েছে।
তাই সামগ্রিকভাবে শেষ কথায় বলতে চাই, শিশুদের ভর্তি পরীক্ষায় বহুবিদ সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ বিতর্কহীন লটারীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ভর্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। তাই আগামীতেও যাতে লটারীর এই আশীর্বাদ অব্যাহত থাকে, বিশিষ্ট জনসহ সকল সচেতন মহলের এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাহিত্যিক ও সম্পাদক ত্রৈমাসিক ত্রিকাল