আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী ফজলে হক খায়রাবাদী স্মরণে

528

ভারতীয় উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী একজন প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী। আজকের স্বাধীত ভারত প্রতিষ্ঠায় এই মহাবিপ্লবীর অবদান স্মরণীয়। ব্রিটিশবিরোধী এই যোদ্ধা স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। নব্বই হাজারেরও বেশি কর্মী ছিল তাঁর এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে। সমগ্র ভারতবর্ষে ভারতের স্বাধীনতার জন্য বিশেষ করে মুসলমান আলেম ওলামাদের নিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। দুর্ভাগ্য আজ আমরা সেই মহাবিপ্লবী ফজলে হক খায়রাবাদীর মতো গুণী দেশপ্রেমিককে ভুলতে বসেছি। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর জন্ম ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার খায়রাবাদে, তাই তাঁর নামের সাথে খায়রাবাদী যুক্ত করা হয়। তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, বিখ্যাত সাহিত্যিক, কবি ও ঐতিহাসিক বিপ্লবী। তাঁর গর্বময় দ্বিতীয় পরিচয় হলো, তিনি ১৮৫৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতার বিপ্লবের একজন প্রত্যক্ষ সংগ্রামী। ভারতকে স্বাধীন করতে গিয়ে তিনি বন্দী হন। বিচারের নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে তার সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয় আন্দামানে। সেখানেই তাঁকে বাকিটা জীবন কাটাতে হয়। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করায় মাওলানা ফজলে হককে আন্দামানে জেলে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়েছিল। তাঁকে রাখা কক্ষে ছাদ দিয়ে বৃষ্টি পড়তো। ফলে পায়খানার মতো ছোট কামরায় পানি জমে যেত। হাফ প্যান্ট আর ছোট জামা তাঁকে পরতে দেয়া হয়েছিল। খাদ্য হিসেবে দেয়া হত নানা জাতের মাছ সিদ্ধ, যা ছিল অত্যন্ত দুর্গন্ধময় ও খাবার অযোগ্য। সময়ে সময়ে বালি মেশানো রুটিও দেওয়া হত। ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে গরম পানি দেয়া হতো। অবশ্য কিছুক্ষণ রাখলেই তা ঠাণ্ডা হবার কথা, কিন্তু তার উপায় ছিল না-তাড়াতাড়ি পানি না খেলে পানির পাত্র ফিরিয়ে নিয়ে যাবার নির্দেশ ছিল। প্রতিদিন নিয়মিত বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা ছিল। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকতে হতো। রাত্রে অন্ধকারে রাখা হতো। কক্ষে দ্বিতীয় কেউ ছিল না যে তার কাছ থেকে একটু সাহায্য ও সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে। সর্বাঙ্গ দাদ, চুলকানি ও একজিমাতে ভরে গিয়েছিল পুরো শরীর। তদুপরি চিকিৎসা ও ঔষধ দেওয়া ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ভারতরতœ যতেœর অভাবে যেন নোংরা আস্তাকুড়ে চাপা ছিলেন। আরও দুঃখের কথা, হযরত খয়রাবাদী দিনের বেলা সাধারণ মেথরের মত নিজের ও অন্যান্য কয়েদীদের পায়খানা পরিষ্কার করতে হতো। এদিকে ডেপুটি জেলার সাহেব তার কাছে রক্ষিত একটি মূল্যবান ফার্সি পাণ্ডুলিপির যোগ্য অনুবাদককে খুঁজতে গিয়ে মাওলানা ফজলে হকের নাম পেলেন। তাই কারাকর্তা কাগজ-কলম দিয়ে পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁর কাছে পাঠালেন। অসুস্থতা ও অস্বাভাবিক মানসিকতা সত্বেও মাওলানা টিকাসহ অনুবাদের কাজ শেষ করলেন। সেই সঙ্গে তথ্যগুলো কোন লেখকের কোন পুস্তকের কোন খণ্ড থেকে নেয়া হয়েছে তাও লিখে দিলেন। জেলার সাহেব সেটা পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হলেন এই জন্য যে, কোন পুস্তকের সাহায্য ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা তো আসলেই বিস্ময়কর। তাই তিনি ফজলে হকের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। ঠিক এই সময়েই মাওলানা সাহেব পায়খানা পরিষ্কার করে বিষ্ঠামাখা টিন ও ঝাঁটা নিয়ে অর্দ্ধোলঙ্গ পোশাক পরে ধীরে ধীরে আসছিলেন। সাহেব তাকে হাত খালি করে দাঁড়াতে বললেন। তাঁকে নতুন কাপড় পরানো হলো। তারপর মূল্যবান পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই মাওলানাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। ক্ষমা চাইলেন ভুলবশত তাঁকে ময়লা পরিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। ফজলে হক নিজেও কেঁদে ফেললেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। এরপর জেলার সাহেব তাঁকে পুরস্কার দিতে চাইলে তিনি বললেন, “আমি আল্লাহর কাছ থেকেই পুরস্কার নেব। মানুষের কাছ থেকে নয়।” জেলার তাঁকে বললেন, আপনি আমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র ধরেছেন এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করাকে ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছেন আপনার অপরাধ অমার্জনীয়। কাজেই আপনাকে মুক্তি দেয়া ভারতের বড়লাটের ক্ষমতার বহির্ভূত। আপনাকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র ব্রিটিশের প্রিভি কাউন্সিল। আমি সেখানেই আপনার মুক্তির জন্য সুপারিশ করবো। ফজলে হক বললেন, আপনার এ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে মুক্তি দেয়া মানে আমাকে অনুগ্রহ করা। আমি ব্রিটিশের অনুগ্রহ নিব না। লখ্নো হাইকোর্ট আমাকে বলেছিল, আমি ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করলেই আমাকে মুক্তি দেয়া হবে। কাজেই যে আনুগত্যের অনুগ্রহ তখন নেই নি, তা এখনও নিব না। আপনি একজন জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি তাই বলছি। আমাদের কুরআন শরীফে আছে, “তোমরা কিছুই চাইতে পারবে না, কিন্তু আল্লাহ যা চান, তাই হয়।” কাজেই আমি যে এখানে আছি তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই আছি। মাওলানা সাহেবের তেজস্বীতা দেখে জেলার সাহেব বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, মুক্তি গ্রহণ করা না করা সেটা আপনার ইচ্ছা, কিন্তু আমার বিবেকতাড়িত কাজ আমি করবই। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী তাঁর মনের অন্তিম কথাগুলো তিনি কাফনের উপর লিখে যেতেন তাই তিনি ঐ জেলারকে আগেই বলেছিলেন, “আমার আনা কাফনখানি আমি আমার ছেলেদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। যদি আমার মৃত্যু এখানেই হয় তাহলে আপনারা সরকার অনুমোদিত কাফন দিয়েই আমার কবর দেবেন।” ঐ কাপড়ের উপর নির্বাসিত জীবনে বসে কাব্য আকারে যে কাহিনী তিনি আরবি ভাষায় যে লিখেছিলেন সেটাই সুবিখ্যাত “আসসাওয়াতুল হিন্দিয়া” (ভারতীয় বিদ্রোহ) এর পাণ্ডুলিপি। তাঁকে অনুবাদের জন্য যে কাগজ দেয়া হতো, তা থেকে কাগজ বাঁচানোর কোন উপায় ছিল না, কারণ কাগজ দেয়া হতো পরিমাণমত। তবে তিনি ছোট ছোট টুকরাগুলো রেখে দিতেন। এসব টুকরা কাগজ এবং কাফনের কাপড়ে পেন্সিল অথবা লাকড়ির কয়লা দিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন “আসসাওয়াতুল হিন্দিয়া” এই অমূল্য গ্রন্থটি। এই বইয়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লবে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্দামানে তাঁর উপর নির্যাতনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই পুস্তকটি অবশেষে তার ছেলে আব্দুল হক খায়রাবাদীর কাছে পৌঁছে। বেনিয়া ব্রিটিশ সরকারের তা সহ্য হয়নি। তারা পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত করে এবং অনুবাদক ও প্রকাশকের উপর অশেষ নির্যাতন চালায়। ঐ সময়ে মাওলানা সাহেবের দুই ছেলে মাওলানা আব্দুল হক ও মাওলানা শামসুল হক দেশের জ্ঞানী-গুণীদের সুপারিশ সংগ্রহ করে পিতার মুক্তির জন্য ব্রিটিশের প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আবেদন পাঠান। জেলার সাহেব এবং দেশবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রিভি-কাউন্সিল আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীকে মুক্তি দেন। মুক্তিনামার একটি কপি মাওলানা শামসুল হক খায়রাবাদীর কাছে আরেকটি জেলার সাহেবের কাছে পাঠানো হলো। মাওলানা শামসুল হক প্রায় চার বছর পর নিজের বরেণ্য পিতাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মহানন্দে আন্দামানগামী জাহাজে করে আন্দামান যান। মাওলানা শামসুল হক আন্দামানে নেমে দেখলেন হাজার হাজার কান্নারত কয়েদী একটি জানাজার পিছনে ছুটছে। তিনি একজন কয়েদীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কোন কয়েদীর জানাজা ভাই! কয়েদী চোখ মুছে বলল, আপনি বুঝি নতুন এসেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ! এটি ভারত অস্তিমিত সূর্য বিপ্লবী আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর জানাজা। বাক্যবিমূঢ় পুত্র মুক্তিনামাটি হাতে নিয়া ছুটে গিয়ে মৃতের কফিনের পিতার বুকে স্থাপন করে খাটিয়া ধরে চলল। জেলার সাহেবও মুক্তিনামাটি লাশের বুকের উপর রেখে খাটিয়া ধরে চলছিলেন। দু’জনের চোখেই তখন ভারত মহাসাগরের সমস্ত নোনাজল। জানাযা হচ্ছে আর জেলার সাহেব একটি পাথরের উপর বসে ভাবছিলেন, সেই দিনের আল্লামার কথাগুলো। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের অনুগ্রহ গ্রহণ করলেন না। সত্যি! ফজলে হক খায়রাবাদী বেনিয়ার মুক্তিনামা হাতে নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসার পরিবর্তে খোদার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বস্থানে চলে গেলেন আর শেষ আশ্রয় গ্রহণ করলেন স্বদেশ থেকে বহু দূরে আন্দামানের মাটিতে। আমরা আজ এই মহাবীর, যাঁর অবদান, ত্যাগ ও আত্মদানে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এসেছে, সেই বীরযোদ্ধা ও স্বাধীনতাসংগ্রামী ফজলে হক খায়রাবাদীকে ভুলতেই বসেছি। এই প্রজন্মের অনেকেই জানে না তাঁর অবদান ও ত্যাগের কথা। অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা এই বিপ্লবীর আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাম ফজলে হক খায়রাবাদী ১৮৬১ সালের ২০ আগস্ট আন্দামানেই সেলুলার জেলেই মৃত্যুবরণ করেন। আন্দামানে কোথায় তাঁর সমাধি হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য ইতিহাসে জানা যায়নি। তবে আন্দামানের সেলুলার জেলে মৃতুবরণকৃত স্বাধীনতাসংগ্রামীদের নামের তালিকায় সর্বাগ্রে বিপ্লবী ফজলে হক খায়রাবাদীর নাম সংরক্ষিত রয়েছে।
তথ্যসহায়ক: আযাদী আন্দোলন: ১৮৫৭ (আসসাওয়াতুল হিন্দিয়া); চেপে রাখা ইতিহাস; গবেষক আবদুর রহিমের বক্তব্য ; আন্দামানে বন্দী বীর; উইকিপিডিয়া ও ইন্টানেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে।

লেখক: গ্রন্থপ্রণেতা, সভাপতি,
চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র