আগুন থেকে বাঁচতে সবাই ছুটেন ছাদে

8

বিবিসি বাংলা

লিপ ইয়ারে ২৯ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি সোশ্যাল মিডিয়ায় চার বছর পর উঠে আসবে বলে গত কয়েকদিন নানা পোস্ট দিতে দেখা গেছে মানুষকে। কিন্তু ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজ কটেজে অগ্নিকান্ডের সময় যারা ভবনের ভেতরে আটকে পড়েছিলেন, তারা হয়তো তাদের এই লিপ ইয়ারের স্মৃতি চিরতরে মুছে ফেলতে পারলেই স্বস্তি পাবেন।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমেদ কামরুজ্জামানের গল্পটা অনেকটা তেমনই। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঐ ভবনের ছয় তলার একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন।
কামরুজ্জামান বলছিলেন, রাত পৌনে দশটার দিকে তারা খাবার অর্ডার দিয়ে যখন রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিলেন, তখনই ভবনে আগুন লাগার বিষয়টি টের পান তিনি। প্রথমে আমরা ধোঁয়ার গন্ধ পাই, পরে হইচই শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সামনের বিল্ডিংয়ের নিচে মানুষ জড়ো হয়ে আমাদের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে, হাত তুলে হইচই করছে। তার কিছুক্ষণ পরই যখন ধোঁয়া উপরে উঠতে থাকে, তখন বুঝতে পারি যে আমাদের ভবনেই আগুন লেগেছে।
ভবনে আগুন লেগেছে বোঝার পরই মি. কামরুজ্জামান তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভবনের ছাদের দিকে চলে যান। ছাদে যাওয়ার সময়ই সিঁড়িতে মানুষের প্রচন্ড হুড়াহুড়ির মধ্যে পড়ি। ততক্ষণে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গেছে, অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, প্রচন্ড ধোঁয়ায় সবাই কাশছে, মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন সিঁড়িতে পড়ে গেছে, রীতিমতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল”, বলছিলেন কামরুজ্জামান।
রাত দশটার দিকে তিনি তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন। সেসময় আরো অন্তত ৪০ জন তাদের সাথে ছাদে অবস্থান করছিল বলে জানান তিনি। “ছাদে রেস্টুরেন্ট আর নামাজের জায়গা থাকায় ছাদের পেছন দিকের ২৫ শতাংশ জায়গাই খোলা ছিল। সেখানেও এক কোনায় আমরা সবাই জড়োসড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিলাম কারণ সিঁড়ি দিয়ে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপ আসতে থাকায় তার ধারে কাছে আমরা থাকতে পারছিলাম না।
রাত দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ছাদে অপেক্ষা করার পর ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনের সাহায্যে কামরুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের নিচে নামানো হয়।
কামরুজ্জামানের মতো অনেকে ভবনের ছাদে অপেক্ষা করলেও কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে লাফিয়ে নেমেছেন ছাদ বা জানালা দিয়ে। ভবনের নিচ তলার রেস্টুরেন্ট মেজবানি খানায় কাজ করা ইকবাল হোসেন তাদেরই একজন। যে সময় আগুন লাগে, ইকবাল হোসেন তখন তিনি রেস্টুরেন্টের ভেতরেই ছিলেন। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর তিনি পাঁচতলা থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় কোমড় ও পায়ে চোট পান।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ইকবাল হোসেন জানাচ্ছিলেন, সাড়ে নয়টার পরপর হইচই শুনে রেস্টুরেন্টের গেট থেকে বের হয়ে দেখি বিল্ডিংয়ের মেইন গেটের কাছে আগুন। সেখান দিয়ে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই আর অনেক ধোঁয়া আসছে সিঁড়ির দিকে। তখন আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে চলে যাই। সিঁড়ি দিয়ে দোতলা-তিনতলা পর্যন্ত উঠে সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তিনি। ততক্ষণে নিচের তলা আর দোতলায় থাকা রেস্টুরেন্টগুলো থেকে মানুষ বের হয়ে সিঁড়িতে জড়ো হচ্ছিলেন। পরে ইকবাল হোসেন পাঁচতলার একটি রেস্টুরেন্টে যান এবং ঐ রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরের গ্রিলের সরু ফাঁক গলে বের হন।
ইকবাল হোসেন বলছিলেন, সেসময় অনেকেই জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গ্রিলের ফাঁক সরু থাকায় অনেকেই বের হতে পারেননি।
ইকবাল হোসেনের মত ঝুঁকি নিয়ে বের হয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু অনেকে সেই সুযোগও পাননি। ধোঁয়ায় আবদ্ধ সিঁড়িতে অথবা ঐ ভবনের কোনো একটি রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিশ্বাস নিতে না পেরে মারা যেতে হয়েছে অনেককে।
একটি খাবার ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা মুজিবুর রহমান, যিনি কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘদিন ঐ ভবনের ভেতরে আসা-যাওয়া করেছেন বলে জানান। তিনি বলছিলেন, বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি আর লিফট পাশাপাশি। সিঁড়িতে একসাথে সর্বোচ্চ তিন জন উঠা-নামা করতে পারবেন, লিফটে একসাথে সর্বোচ্চ ছয়-সাত জন ঢোকা সম্ভব। তিনি বলছিলেন, ঐ একটি সিঁড়ি আর লিফট বাদে ভবনে ঢোকার ও সেখান থেকে বের হওয়ার আর কোনো উপায় নেই।