আগুনঝরা মার্চ

46

ও আমার আট কোটি ফুল দেখো গো মালী/ শক্ত হাতে বাইন্ধো মালী লোহারও জালি/ ওরে এক ফাগুনে ফোঁটে নাই এই ফুল/ কত মেঘে জল শুকাইছে ফোটাইতে এ ফুল/ ওরে এক ফাগুনে ফোঁটে নাই এই ফুল/ কত চোখের জল শুকাইছে বাঁচাইতে এ ফুল/ ও কত রক্ত পানির মত দিছিগো ঢালি/ ওরে এমন ফুলের বাগান হায় কোথায়/ লক্ষ-কোটি প্রাণ বাঁচে যার বুকেরই সুধায়/ ওরে এমন ফুলের বাগান হায় কোথায়/ তিরিশ লক্ষ প্রাণ ঘুমায়রে গাছেরই তলায়/ ও কত মায়ের ভরা কোল হইছে গো খালি…
ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। একাত্তরের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত এ চুক্তির কারণে
মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি প্রচুর অস্ত্রও পেতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় হয় ত্বরান্বিত। সত্তরের দশকে দুই পরাশক্তির একটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও চীনের মাওবাদী সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়ালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার উপলব্ধি করে বৃহৎ শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি না পেলে এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে না। তখন প্রবাসী সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থনের আশায় একাত্তর সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে’ তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল পাঠায়। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ। অপর দুই সদস্যের একজন তিনি এবং অন্যজন ন্যাপের দেওয়ান মাহবুব আলী ছিলেন। ভারত সরকারও তখন বি.কে কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে সম্মেলনে। তবে, এ সম্মেলনে তাদের নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করে যোগদান করতে হয়েছিল। কারণ তাদের সকলের পরিবার তখন ঢাকায় ছিল। পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই তাদের এমনটি করতে হয়েছে। এর ফলে আব্দুস সামাদের নামের সঙ্গে আজাদ, দেওয়ান মাহবুব আলীর নাম মাহবুবুল আলম ও তার নাম গোলাম সারোয়ার রাখা হয়।
বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে প্রবাসী সরকারে প্রতিনিধি হিসেবে তারা তাদের বক্তব্য তুলে ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন দাবি করেন। কিন্তু বিশ্ব নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের তিনটি দাবি গ্রহণ করে। সেগুলো হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও গণহত্যা বন্ধ। কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া যে এ সমস্যার সমাধান হবে না, তা বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে তারা বুঝাতে ব্যর্থ হন। কিন্তু, প্রবাসী সরকারের পক্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সমর্থন আদায়ের জন্য সম্মেলনের পর তাদের মস্কো, পূর্ব বার্লিন ও পোল্যান্ড যেতে হয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষে মূলত মস্কোর দ্বিধা দূর করতেই তাদের এ সফর করতে হয়েছে। তখন মস্কোর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন গীতিধর। যিনি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ বিষয়ক মূল উপদেষ্টা হয়েছিলেন।
এই গীতিধরই বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে অর্থাৎ তাদের প্রক্রিয়াধীন ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তির কথা জানান এবং বলেন, চুক্তিটি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের সহযোগিতা আরো সহজতর হবে। সত্যিই চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের পক্ষ নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। চুক্তির আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি ছিল খুব বেশি। মুক্তিযোদ্ধারা যেমন অস্ত্র পেত কম, ট্রেনিংও তেমনি ছিল তাদের সীমিত। চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ট্রেনিং, অস্ত্র সবই বাড়তে থাকে অধিক হারে। সেই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক কমে আসে। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির একটি অপশন ছিল দুই পক্ষের কেউ যদি তৃতীয় কারো দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। এই অপশনের কারণেই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের পক্ষ নেয় এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে এবং তিনবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে।