আগস্ট- ট্র্যাজেডির কুশিলবদের কথা নতুন প্রজন্মের জানা জরুরি

8

এমরান চৌধুরী

বাঙালি বড়ো ভুলোমনা জাতি। ভুলে থাকতে কিংবা ভুলে যেতে যতটা চ্যাম্পিয়ন কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ততটাই উদাসীন। এককথায় বলা যায় আমরা বাঙালিরা আপাদমস্তক অকৃতজ্ঞ। এতটাই আমরা অকৃতজ্ঞ যে, কখনো কখনো নিজের জন্মদাতা পিতাকে পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে যাই। আমরা মিথ্যাকে নিয়ে যত মাতামাতি করি জ্বলজ্যান্ত সত্যকে রাখি আড়াল করে। যেমনটা রেখেছি ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ বছর। যে মানুষটি জীবনের প্রতি, সংসারের প্রতি সব রকম মায়া ত্যাগ করে একটি ভূখÐের স্বকীয়তা ও ওই ভূখণ্ডের মানুষের স্বপ্নপূরণের জন্য জানবাজি রেখে দীর্ঘ তেইশ বছর নাওয়াখাওয়া জীবন যৌবনের সব সাধ আহলাদ ভুলে লড়াই করেছেন আমরা তাঁকে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নানাভাবে হেনস্তা করেছি। আমরা তাঁকে তাঁর ন্যুনতম সম্মান দেওয়া দূরে থাক তাঁর নামটা পর্যন্ত উচ্চারণে দেখায়নি সৌজন্যবোধ। বাংলার মানুষ যাঁকে ভালোবেসে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেছিল, বিশ্ববাসী যাঁকে নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগণের বন্ধু হিসেবে মাথায় তুলে নিয়েছিল। যে মানুষটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’। এটা তাঁর কেবল কথার কথা ছিল না। এটা তিনি সারা জীবন আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, কর্ম ও নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। যে মানুষটিকে অন্তত দু’বার হত্যার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি হায়েনারা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী বানিয়ে একবার, আরেকবার একাত্তরে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী রেখে। কিন্তু পাকিস্তানি হায়েনারা যা পারেনি, তা করেছে এদেশের কতিপয় বিপথগামী সেনাকর্মকর্তা-যাঁরা ছিল বাঙালি। আর যে বাঙালিদের তিনি জীবনের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। এরকম নিখাদ, দেশপ্রেমিক মানুষটিকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী দুই জেনারেল এ হত্যাকাÐের বিচার করার বদলে আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছেন। তাদের এ আচরণ থেকে আমাদের কারো বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় এই দুই জেনারেল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুনিদের ভক্ত বা সমর্থক ছিলেন। জেনারেল জিয়া খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে, রাজকীয় হালে বিদেশের মাটিতে দিন কাটানোর ব্যবস্থা করেন। জেনারেল এরশাদ কৃতজ্ঞতার আরো এক ধাপ এগিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাজনৈতিক দল গঠন ও তাদেরকে সাংসদ বানিয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তে কেনা পবিত্র সংসদকে অপবিত্র করতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। এখানেই শেষ নয়, তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে নির্মমভাবে হত্যার দিনটাতে নকল জন্মদিনের উৎসব পালন করা হয়েছে শত শত কেজি ওজনের কেক কেটে। এরচেয়ে বড়ো লজ্জার বিষয় এ দেশের মানুষের জন্য আর কিছুই হতে পারে না। নিঃসন্দেহে এ জাতীয় কাজ নিন্দিত এবং অমার্জিত যা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমাদের নেই।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও শিশুদের হত্যার দ্বিতীয় কোনো নজির আছে বলে আমাদের মনে হয় না। এ থেকে বোঝা যায় হত্যাকারীরা কতটা বর্বর ও হিং¯্র ছিল। এদিন শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধান ও তাঁর ভবিষ্যত বংশধরদের হত্যা করা হয়েছে তাই নয়, একটি জাতির শেকড় উৎপাটনের সর্বাত্মক প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। এ হত্যাকা পেছনে সক্রিয় ছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তি। এ প্রয়াসের অংশ হিসেবে যে ¯েøাগান দিয়ে বাঙালি আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল। স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়ের সূর্য। পঁচাত্তরে ক্ষমতা দখলকারীরা রাতারাতি সেই স্লোগান পাল্টে ফিরিয়ে আনে পাকিস্তানি হায়েনা-নারী ধর্ষকদের স্লোগান জিন্দাবাদ। সেদিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাকর্মকর্তারা কারা কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে, কারা ‘সো হোয়াট’ বলে এমন জরুরি মুহূর্তে নির্বিকার ছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তা না জানার কথা নয়। হত্যার পরবর্তী কারা ইনডেমনিটি জারি করেছিল, কারা সেই ইনডেমনিটি সংসদে বৈধতা দিয়েছিল তা দেশের সচেতন মানুষ খুব ভালো করেই জানেন। সবচেয়ে বড়ো কথা ইতিহাস ইতিমধ্যে তাদের স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা ইতিহাস সম্পর্কে ছিল নিতান্ত অজ্ঞ। ফলে তারা অনুধাবন করতে পারেনি সাময়িকভাবে সত্যকে আড়াল করা গেলেও ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি কখনো ব্যাহত করা যায় না। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহকে সিংহাসনচ্যুত করতে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল তাদের পরিণতি কী হয়েছিল তা কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
দেরিতে হলেও ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। তবে এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে দীর্ঘ একুশ বছর। এই একুশ বছরে যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন তাঁদের কেউ জাতির পিতার, জাতির কর্তধারের হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। জাতির জন্য, দেশের মানুষের জন্যে বিষয়টি মোটেই সুখকর ছিল না। শেষ পর্যন্ত জাতির পিতার সুযোগ্যা কন্যার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারই সম্পন্ন করেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা। আদালতে অপরাধীদের সনাক্ত করা হয়েছে। চূড়ান্ত রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে এবং পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তারা হলো সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ. কে.এম. মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও মহিউদ্দিন আহমদ। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত একজন পলাতক জীবনযাপনের সময় জিম্বাবুয়ে মারা যান। করোনাকাল শুরু হওয়ার পর ঢাকার গাবতলী থেকে এতদিন পালিয়ে থাকা কর্ণেল (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২০ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ বিচারের মধ্য দিয়ে আমরা পিতৃহত্যার বদলা নিতে পেরেছি ঠিকই কিন্তু আমাদের দায়মুক্ত হতে অনেক দূর বাকি। এখনো আমরা পলাতক আরও পাঁচ খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারিনি। এই পলাতক খুনিরা নিজেদের বাঁচানোর জন্যে দেশের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় যে কোনো অপকর্ম করতে পারে এ বিষয়ে সরকারকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, এদেশে বসবাসকারী তাদের নিকটতম ও দূরতম স্বজনদের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ নিজের জন্যে, নিজের স্বার্থের জন্যে পারে না এমন কোনো কাজ অপরাধী-অপরাধীর স্বজনদের নেই। এদেশের সবার না হলেও কিছু মানুষের খাসলত এমন যে নিজের ছেলে বা স্বামী ধর্ষক জানার পরও ছেলে বা স্বামীকে বেকসুর দাবি করতে নিজেদের বিবেকে এতটুকু বাধে না।
বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়াসূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক পাঁচ কাপুরুষের মধ্যে দু’জনের অবস্থান সম্পর্কে সরকার মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। এই দুই কাপুরুষ হলো নূর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরী। নূর চৌধুরী কানাডায় ও রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে। বাকি তিন কাপুরুষের অবস্থান সম্পর্কে সরকার নিশ্চিত নয়। এ তিন কাপুরুষ বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। খন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তান কিংবা লিবিয়ায়, শরিফুল হক ডালিম কেনিয়ার পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানে, মোসলেম উদ্দিন জার্মানীতে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে যেভাবেই পালিয়ে বেড়াক না কেন তারা যে খুনি, নরকের কীট তা আর কারো অজানা নয়। সুতরাং রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী তাদের সাজা কার্যকর করা যাক বা নাই যাক সৃষ্টিকর্তা ঠিকই এ নরাধমদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যেখানে সাজা থেকে বাঁচতে কিংবা পালিয়ে বেড়াতে পাওয়া যাবে না পাকিস্তান, লিবিয়া, কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো দেশকে-যারা খুনিকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবে।
এ মুহূর্তে আমাদের উচিত ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড আগামী প্রজন্মকে জানাতে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা। যাতে উঠে আসবে এ হত্যাকাÐের মোটিভ, এর পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারা জড়িত ছিল তাদের পরিচয়। কাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, কাদের হয়নি। তাদের মাতাপিতা, বাড়ি-ঘর সহ বিস্তারিত বিষয়। পলাশির খলনায়কের নাম যেমন মানুষের মুখে মুখে ফিরে তেমনি খন্দকার থেকে শুরু করে অন্ধকারের সকল নায়কের নাম ছড়িয়ে দিতে হবে আগামী প্রজন্মের মুখে মুখে। আগামী প্রজন্মকে জানাতে হবে আমাদের জাতির পিতাকে, আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিকে, হাজার বছরের সেরা বাঙালিকে কারা কিভাবে হত্যা করছে। হত্যাকারী কারা? বঙ্গবন্ধুর বুকে কে গুলি চালিয়েছিল? মাসুম শিশুপুত্র রাসেলকে মায়ের কাছে নেওয়ার কথা বলে কে গুলি করেছিল? মাত্র চার বছরের শিশু সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবুকে কোন পাষণ্ড খুন করেছিল? অসহায় মা-বোনদের কোন কোন পাকিস্তানি প্রেতাত্মা ব্রাশফায়ার করেছিল? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসব খুনিদের ভূমিকা কি ছিল? এরা কী যুদ্ধ করেছিল নাকি খন্দকারের মতো অন্ধকার নামাতে ঘষেটি বেগমের ভূমিকা রেখেছিল -আগামী প্রজন্মের কাছে বিষয়গুরো স্পষ্ট করা জরুরি। তা যদি করা না যায়, কিংবা আমরা যদি তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে বিভীষণরা সুযোগ পেলেই যে ছোবল মারবে না তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।
তাই আসুন আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের প্রতি আমাদের দায়বোধের পরিচয় দিই। আমাদের সন্তানদের ১৫ আগস্ট কী ঘটেছিল, কারা ঘটিয়েছিল এসব বিষয় বিস্তারিত অবহিত করি। জানাই এ হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত ছিল। জানাই বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান-খন্দকার আবদুর রশিদের কথা। তাদের গর্বভরে স্বীকারোক্তির কথা। যে জালিম প্রথম রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার, সেই শরিফুল হক ডালিমের কথা। বজলুল হুদা, নূর চৌধুরী,
রাশেদ চৌধুরী, মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মোসলেহউদ্দিন, আবদুল মাজেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও আজিজ পাশার কথা। এসব কাপুরুষদের কৃতকর্মের সঠিক ইতিহাস যদি আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারি তবেই হবে বাঙালির পাপমোচন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক