আকাশি পরি

70

নিরা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। পড়াশোনায় যেমন ভালো ঠিক তেমন আচার ব্যবহারও। যাকে বলে শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। ফুল-পাখি, নদী-নালা; এক কথায় প্রকৃতির সবকিছুই ওর খুব ভালো লাগে। প্রকৃতির সাথে মিশতে মন চায়। প্রকৃতি ভালোবাসে। তোমরাও নিশ্চয় প্রকৃতিপ্রেমী? প্রকৃতির সবকিছুই তোমাদের ভালো লাগে? নিরাকে চিঠি দিয়ে জানিও কিন্তু। তোমরা আবার এমনটি মনে করো না যে, নিরা প্রকৃতি ভালোবাসে বলে গাছ থেকে ফুল ছেঁড়ে, পাখির বাসা থেকে বাচ্চা নিয়ে এসে খাঁচায় বন্দি করে রাখে। এগুলো সে একদমই পছন্দ করে না। ফুল শুধু গাছে মানায়, হাতে নয়। পাখির বাচ্চাদের তার মায়ের বুকের নিচে মানায়, কারো হাতে নয়। আকাশের বুকে উড়তে মানায়, লোহার শিকলের খাঁচায় মানায় না। পাখিদের আকাশে উড়তে দেখা নিরা পছন্দ করে, ভালোবাসে ফুটন্ত ফুলের সৌরভ নিতেও।
আজ খুব গরম পড়েছে। গরমের প্রত্যেক মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর পূর্বের রেকর্ড ভাঙ্গছে। দিন দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রাণিকুলের স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করা খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিরারা ঢাকা শহরে থাকে। স্কুলের বন্ধু ছাড়া ওর কোনো বন্ধু নেই। বাসায় একা একা খেলতে হয়। বিকেলবেলা ছাদে উঠে টবে লাগানো গাছে পানি দেয়। গাছে প্রজাপতি বসলে তার সাথে কথা বলে। পাখির সাথে কথা বলে।
নিরা ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। গোলাপ গাছটায় বেশ বড় সড় একটি প্রজাপতি বসেছে। গায়ে কত্ত সুন্দর নকশা করা। প্রজাপতির গায়ের রঙ আকাশি রঙের। এমন প্রজাপতি সে আগে কখনও দেখেনি। নিরা বলল, ‘ও প্রজাপতি, ও প্রজাপতি, তোমার বাড়ি কোথায়? তোমার ডানায় চড়ে ঘুরাবে আমায় স্বপ্নপুরী?’
হঠাৎ প্রজাপতিটা সত্যি সত্যিই একটি পরি হয়ে সামনে হাজির হয়ে গেল।
পরিটি বলল, ‘তুমি যাবে আমার সাথে? আমাদের দেশে?’
নিরা তো অবাক। সে ভাবতেই পারেনি এমনটি হবে। প্রতিদিনই তো সে এভাবেই প্রজাপতির সাথে, পাখির সাথে কথা বলে। এমটি তো কখনও হয়নি।
‘কী ভাবছো, হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে ভয় পেলে নাকি?’ পারীটি মৃদু হেসে বলল।
নিরা বলল, ‘ভয় পাবো কেন? তুমি আমার বন্ধু হবে?’
‘হ্যাঁ, বন্ধু হবার জন্যই তো তোমার কাছে এসেছি। তুমি খুব ভালো মেয়ে। বাবা-মায়ের কথা শোনো, ফুল-পাখিদের ভালোবাসো। আর এজন্য আমিও তোমাকে খুব পছন্দ করি।’
নিরা বলল, ‘সত্যি সত্যিই আমার বন্ধু হবে? আমাকে তোমার দেশে নিয়ে যাবে?’
‘হ্যাঁ, তুমি চাইলেই নিয়ে যাবো।’
নিরা কিছুক্ষণ পর বলল, ‘নাগো, যাবো না। মা আমায় দেখতে না পেয়ে কাঁদবে যে। বাবা-মাকে না বলে কোথাও যেতে নেই। বাবা-মা আমায় দেখতে না পেলে বড্ড চিন্তা করবে।’
‘তুমি কি জানো না আমরা পরিরা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সারা মুল্লুক ঘুরে আসতে পারি? তুমি চাইলেই কয়েক মূহুর্তের মধ্যে তোমাকে আকাশ ভ্রমণ করে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবো।’
নিরা বলল, ‘ইমা, তাই? আকাশে ওড়ার সখ নেই কার বলো? তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারলে চলো আমায় নিয়ে আকাশ দেখাবে।’
নিরা রাজি হয়ে গেলো। আকাশি পরীর ডানায় চেপে বসলো সে। আকাশি পরি উড়তে লাগল। যতই আকাশে উড়তে থাকে ততই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। নিরা বলল, ‘ভীষণ গরম লাগছে আমার।’ আকাশি পরি বলল, ‘দাঁড়াও তোমাকে একটি পোশাক পরিয়ে দিই। এই পোশাক গায়ে থাকলে গরম লাগবে না।’ নিরাকে আকাশি রঙের একটা পোশাকে মুড়িয়ে দিলো। এখন আর তেমন গরম লাগছে না। নিরা বলল, ‘কী গরমটাই না লাগছিলো! এত গরমে জগতের কোনো প্রাণীই থাকতে পারে না। আকাশি পরি বলল, ‘আর বলো-না সে কথা, এই গরমে আমাদেরও খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা আগের মতো আর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছি না। শুধু আমরাই নয়, পক্ষীকুলও খুব কষ্টে আছে। এই পরিস্থিতির জন্য তোমাদের পৃথিবীর মানুষেরাই দায়ী।’
নিরা বলল, ‘কেন, মানুষের দোষ দিচ্ছ কেন? এগুলো তো প্রাকৃতিক ব্যাপার।’
আকাশি পরি বলল, ‘প্রকৃতিকে ক্ষেপিয়েছে কারা? তোমরা মানুষেরা। অকারণে পাহাড় কাটছে, নির্বিচারে গাছ কাটছে। এগুলোই তো যথেষ্ট পৃথিবীকে ধ্বংস করতে।’
নিরা বলল, ‘গাছ কাটার সাথে গরমের সম্পর্ক কী?’
আকাশি পরি একটু হেসে বলল, ‘তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না? আজ তোমাকে অনেক কিছুই দেখাবো, এসো।’
উড়তে উড়তে অনেক উপরে চলে এলো। একদল অতিথি পাখি দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে নিরার মাথার উপর দিয়ে। ওদের দলনেতা বলল, ‘কীগো আকাশি পরি, তোমাদের খবর কী?’
আকাশি পরি বলল, ‘আর বলো-না, গরমে আমাদের অবস্থা ভালো না। তোমরা কোথায় চললে? এবার শীতকালে বাংলাদেশে আসবে তো?’ দলনেতা বলল, ‘নাগো, বাংলাদেশের আবহাওয়া পাল্টে গেছে। হাওড়-বাওড়, নদ-নদী, খাল-বিল এখন আর আগের মতো নেই। সব ভরাট হয়ে গেছে। তারপরেও কিছু অসাধু শিকারির অত্যাচারে ওখানে যেতে মন চাচ্ছে না। শিকারিদের হাতে মরতে যাব নাকি?’ পাখির দল উড়ে চলে গেল।
‘দেখেছো, পাখিরাও তোমাদের উপর অভিযোগ করল?’ আকাশি পরি বলল।
নিরা বলল, ‘আমার দাদুর যে বন্দুকটা আছে, ওটা আমি লুকিয়ে রাখবো।’
আরও কিছু উপরে উঠে এলো।
আকাশি পরি বলল, ‘ঐ যে একটা স্তর দেখতে পাচ্ছো? ওটাকে বলা হয় ওজন স্তর।’
‘ওজন স্তর? কী কাজ ওটার?’ নিরা বলল।
‘সূর্যের আলো পৃথিবীতে পড়তে সময় লাগে ৮মিনিট ৩২ সেকেন্ড। সূর্যের আলো সরাসরি পৃথিবীতে পড়ে না।’
‘তাহলে?’ নিরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
আকাশি পরি আবার বলতে লাগল, ‘সূর্যের আলোর মধ্যে এক প্রকার ক্ষতিকর রশ্মি আছে। যাকে বলা হয় অতিবেগুনি রশ্মি। এই অতিবেগুনি রশ্মি যদি সরাসরি পৃথিবীতে পড়ে তাহলে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা সবার ক্ষতি হবে। এটা পৃথিবীর জন্য হুমকি। তাই সূর্যের আলো সরাসরি ঐ স্তরের উপর পড়ে এই ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে ওজন স্তর বিকিরণ করে মহাশূন্যে ফিরিয়ে দেয়। যা অতিবেগুনি রশ্মি স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে আসতে পারে না। পৃথিবীর জন্য উপকারি আর প্রয়োজনীও আলো ওজন স্তর ফিল্টারের মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়।’
‘তাহলে তো ভালোই। কিন্তু এরপরও যে তাপমাত্রা বেড়েই যাচ্ছে?’ নিরা বলল।
‘সমস্যা তো আছেই। ঐ যে বললাম তোমাদের পৃথিবীর মানুষ দায়ী। আচ্ছা বলো তো, তোমরা শ্বাস নেওয়ার সময় কী গ্রহণ করো? আর ত্যাগ করার সময় কোন গ্যাস ত্যাগ করো?’
‘আসাদ স্যার বলেছেন, আমরা শ্বাস নেয়ার সময় অক্সিজেন গ্রহণ করি। আর ত্যাগ করি কার্বন-ডাই- অক্সাইড।’
‘ঠিক বলেছো। এবার শ্বাস নিয়ে দেখো আর ত্যাগ করার সময় হাত দিয়ে দেখো।
কিছু বুঝলে?’
‘হ্যাঁ। অক্সিজেন ঠান্ডা আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গরম।’
‘ঠিক তাই। তোমরা যে পদার্থ গ্রহণ করো সেটা গাছ তৈরি করে তোমাদের যোগান দেয়। আর তোমরা যে পদার্থ ত্যাগ করো সেটা গাছ গ্রহণ করে সূর্যের আলোর সাহায্যে পাতায় খাদ্য তৈরি করে। সুতরাং গাছ আর প্রাণী একে অপরের পরিপূরক। তবে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি। কলকারখানার কালো ধোঁয়া, পুরোনো গাড়ির কালো ধোঁয়া, বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করা। পাহাড় কেটে ফেলা। এতে করে কার্বণ-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে গাছপালা, বন-জঙ্গল কমে যাওয়ার ফলে পৃথিবীতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে কী হচ্ছে জানো? একটু লক্ষ্য করে দেখো তো ওজন স্তরে ফাটল ধরেছে কিনা?’
নিরা বললো, ‘হ্যাঁ, তাইতো। ওজন স্তরের ফাটল ধরেছে।’
‘আর এই ফাটলের জন্য যদি ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মী ১% ও পৃথিবীতে পড়ে, তাহলে মানুষের স্কিন ক্যানসার হবে। চোখে ছানি পড়বে। এমনকি মানুষের পৃথিবীতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।’
নিরা আৎকে উঠে বলল, ‘তাহলে এখন কী হবে? কোনো সমাধান নেই?’
‘সমস্যা থাকলে তার সমাধানও আছে।’
‘বলো, কী করতে হবে?’
‘বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। বন উজাড় করা যাবে না। পাহাড় কাটা যাবে না। কলকারখানার পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য নিয়ম মেনে চলতে হবে। পুরনো অকেজো গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি নির্মাণ করা যাবে না। তাহলেই আগামির পৃথিবী হবে সুন্দর বাসযোগ্য। অতিথি পাখিদের অভিযোগ নিজ কানেই শুনলে। ওরা তোমাদের দেশে আর আসতে চাইছে না। নদী নালা, হাওড় বাওড় ভরাট হচ্ছে। কিছু লোভী শিকারি অল্প কিছু টাকার লোভে ওদের শিকার করে বিক্রি করছে। এগুলোও বন্ধ করতে হবে। পাখিরাও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। পাখিরা চায় মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে উড়তে। বন্দি থাকতে নয়।’
কথা বলতে বলতে কখন যে নিরাকে ছাদে নামিয়ে রেখে গেছে সে বুঝতেই পারেনি। নিরা আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মা এসে নিরাকে ডাকার পর ফিরে ফিরে তাকাল। এখনও সূর্যিমামা চলে যায়নি। বিকেলের আকাশে ঝলমল করছে আলো।