আইয়াতরা কেন নৃশংসভাবে খুন হয়?

24

পারভীন আকতার

মাত্র পাঁচ বছরের ছোট্ট আইয়াত। কতইবা তার দুনিয়া বুঝবার ক্ষমতা হয়েছে? বিশাল পৃথিবীর বুকে তার ছোট্ট জীবনের গÐি পেরোনোর সফর শেষ হলো। এক পাষÐের হাতে নৃশংস বীভৎস রুদ্ধশ্বাস তারপর কেটে কেটে ছোট শরীরটাকে কয়েক টুকরো করে নালা, জোয়ার ভাটা, পতেঙ্গা কত জায়গায় ফেলে দিয়েছে! কী মর্মান্তিক। ভাবতে শিয়রে উঠি যে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে বর্তমানের ডিজিটাল নিরাপদ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা কতটা নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে পেরেছি সিসি ক্যামেরা কিংবা টহল পুলিশের মাধ্যমে।কখন কোথায় কী ঘটনা ঘটছে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে তা জানি না বলেই আধুনিক প্রযুক্তি কিংবা চৌকস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভ্যুদয়। কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি জোরদার না হওয়ার কারণে এমন নৃশংস ঘটনা চোখের সামনেই হরহামেশাই ঘটে চলেছে। নিজের ঘরেও আজ মানুষ নিরাপদ নয় কেন? মানুষ এতটাই নৈতিক অবক্ষয়ের নিম্নসীমায় পৌঁছে গেছে যে ছোট্ট শিশুটিও আজ হয়ে গেছে মুক্তিপণ নেয়ার টোটকা। যার শরীরে আছে এক পবিত্র নিষ্পাপ আত্মা যা পৃথিবীর পাপ মুক্ত অদ্যাবধি। তবুও খুনির বুক কাঁপেনি মেয়েটির সাথে না জানি আর কী কী হয়েছে।পুরো বিশ্ব আজ আইয়াতের জন্য শোক করছে। বয়ে বেড়াতে পারছেন না তার ছোট্ট শরীরের আত্মার ‘বাঁচাও বাঁচাও’ ডাকের আকুতিভরা ঐশ্বরিক আওয়াজ। মনে হচ্ছে এই তো কানে বাজচ্ছে, ‘কে আছো আমাকে বাঁচাও।’ ঘাতকের মনে একটুও মায়া হয়নি।
ভারতীয় টিভি সিরিজ গোয়েন্দা নাটক সিআইডি আর ক্রাইম পেট্রোল দেখে আবীর নামক ঘাতক আইয়াতকে হত্যা করে তার দেহ টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলেছে যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। আবীরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী স্যোসাল মিডিয়া জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভালো জিনিস শেখার নামগন্ধ নাই খারাপটাই শিখলি অসভ্য জানোয়ার! এখনো অনুসন্ধান চলমান আইয়াতের কিছু দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেলেও তার কোন প্রকৃত অবয়ব আছে? কারণ সময় দ্রæতই বদলে দেয় পরিস্থিতির দৃশ্যপট। জোয়ার ভাটায় কিংবা দীর্ঘ দিনের রোদ বৃষ্টির আবরণে হারিয়ে গেছে আইয়াতের দেহের অবশিষ্ট চিহ্ন। আইয়াত মিশে গেছে নদীর পলিতে কিংবা খেয়ে ফেলেছে কুকুর। তার আত্মাটা উড়ে গেছে চিরশান্তির আত্মার জগতে। যেখানে আমরা একটা ছোট্ট শিশুর নিরাপত্তা দিতে পারি না সেখানে অন্য বৃহৎ কিছুর নিরাপত্তা দেব কী করে? সড়কে বেসামাল মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। বাজারের নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। বাসা ভাড়া আকাশ ছোঁয়া। চাকরীর বাজার মন্দা। শিক্ষার ক্রমাগত অবনতি। নীতি নৈতিকতার বালাই নেই। চলছে ঘুষ, চুরি, ঋণ খোলপী, কালো টাকা আর ক্ষমতার দলাদলির নৈরাজ্য।
অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগতো লেগেই আছে। মানুষের শরীরে মশা বাসা বাঁধে আর ডেঙ্গুতে মৃত্যু যেন ঠেকানোই যাচ্ছে না। এতটা খারাপ অবস্থা গত বছরও ছিল না। হঠাৎ কী এমন হলো চারদিকে এতটা গোলমাল শুরু হলো।আর এসব অস্থিরতার মাঝে মানুষের ভিতরের ঢুকে গেছে হিংসা লোভ। মানুষের সুরক্ষা দেবে রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হবে খুবই যুগোপযোগী ও টেকসই। প্রতিটি ইউনিয়নে আছে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। তাদের কালেভদ্রে দেখা মিলে। রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের জোরদার করা হয়।কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন নিরাপত্তা বিধানে তারা কেন দায়িত্বশীল নয়? একদিনের জন্য বা শুধু রাষ্ট্রীয় কতিপয় কর্মকাÐের জন্যই কি গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উৎপত্তি? শহরে শহরের প্রতিটি এলাকায় টহল পুলিশ কোথায়? অনেক এলাকায় সিসি ক্যামেরা এখনো বসানো হয়নি। বসালেও ঠিকমতো তা কাজ করে না। এগুলোর কোন তদারকি নাই। যখন ঘটনা ঘটে যায় তখন ফুটেস দেখার তোড়জোড় চলে। অথচ চোর ঠিকই চুরি করে চলে যায়। আইয়াতদের জোর করে তুলে নিয়ে যায় অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুই জানে না! ঘটনা ঘটলেই, থানায় ডায়েরী করার পর কেন হুশ হয়? এর আগে কেন নিরাপত্তার বলয়ে থাকে না সংশ্লিষ্ট এলাকা? উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকান তারা কীভাবে নিরাপত্তা বিধান করে রাষ্ট্রে শিখুন দয়া করে।আজ নারীরা একলা বাইরে চলবে তাও মুশকিল হয়ে পড়েছে।পথে পথে বখাটেরা উঁৎ পেতে বসে থাকে। অভিভাবকরা আজ গভীর দুশ্চিন্তায় দিনরাত পার করছে আইয়াতের উপর ঘটে যাওয়া এমন নৃশংসতা দেখে।
এলাকাভিত্তিক স্থানীয় জনগণ, তরুণ ও প্রবীণদের কাজে লাগান।নিরাপত্তা কমিটি তৈরি করুন। নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিন।পালায় পালায় করে পাহারা দিন এলাকা। মানুষ বেঁচে না থাকলে কীসের উন্নয়ন কীসের কী? বাস্তবতায় ফিরে আসুন। সমাজের অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন।আর যেন কোন মা বাবা কোল খালি না হয়। অনেক কষ্টের বুকের ধন যেন তুচ্ছ চাওয়ার কাছে হত্যার শিকার হতে না হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো জোরদার করুন। পথে ঘাটে পাড়া মহলায় টহলদারি দিনে রাতে নিরাপত্তা জোরদার করুন।অকালে যেন আইয়াতদের স্বপ্ন হারিয়ে না যায়।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক