আইন অনুযায়ী প্রটোকল সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে : হাইকোর্ট

60

সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ সাংবিধানিক পদাধিকারী যারা সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) অনুযায়ী প্রটোকল সুবিধা পেয়ে আসছে, তাদের সেই সুবিধা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ মহানগর ও শহরাঞ্চলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে অবিলম্বে এ আদেশের অনুলিপি সকল জেলা জজ, মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবকে পাঠাতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের বিষয়ে সংবাদ প্রচার-প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও সতর্ক করা হয়েছে হাই কোর্টের আদেশে। একটি রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।হাই কোর্টের একজন বিচারককে খুলনা সফরের সময় প্রটোকল দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে স¤প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. শাহীনুর রহমান এই রিট আবেদন করেন। খবর বিডিনিউজের
আদালত আদেশে বলেছে, মানুষের জন্য সংবাদ পরিবেশন করা বড় ধরনের দায়িত্ব। রাষ্ট্র ও সমাজের মুখপাত্র হিসেবে সাংবাদিকদের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। তাদের কাছে প্রত্যাশা, সাংবাদিকরা আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবেন। তাদের দায়িত্বশীলতায় খন্ডিত বা আংশিক না, সম্পূর্ণ সত্যের প্রতিফলন থাকবে।
সরকারের একজন যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় কাঁঠালবাড়ি ঘাটে তিন ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখায় গত ২৫ জুলাই তিতাস ঘোষ নামের এক স্কুলছাত্র অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায়।
এরপর গত ৩১ জুলাই তিতাসের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে এক রিট মামলার শুনানিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের সেদিন শুনানির এক পর্যায়ে বলেন, সরকারের কোনো স্তরের কর্মকর্তাই কেউ ভিআইপি নন। তারা পাবলিক সার্ভেন্ট। সারা বিশ্বে অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস এবং নিরাপত্তার জন্য পুলিশের গাড়ি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেতে দেওয়া হয়। আর এখানে ঘটেছে তার উল্টোটা। ভিআইপি কারা সেটা আইনেই বলে দেওয়া আছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা অন্য কারো ক্ষেত্রে নয়।
ভিআইপি থাকলেও অ্যাম্বুলেন্সকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে যেতে দেওয়া হয়ে থাকে, কারণ এর সঙ্গে একজন মানুষের জীবন-মৃত্যুর বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে।
এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই হাই কোর্টের একজন বিচারপতির খুলনা সফরের সময় সার্কিট হাউজে ভিআইপি কক্ষ, গাড়ি ও পুলিশ এসকর্টের ব্যবস্থা চাওয়া হয় খুলনার জেলা প্রশাসনের কাছে। কয়েকটি সংবাদমাধ্যম তখন বিচারপতির জন্য ‘ভিআইপি প্রটোকল’ চাওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সেসব প্রতিবেদন যুক্ত করেই হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন আইনজীবী মো. শাহীনুর রহমান। তার পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী একরামুল হক টুটুল, যিনি কিছু দিন আগেও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি আটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
আদেশের পর একরামুল হক টুটুল সাংবাদিকদের বলেন, কিছু সংবাদমাধ্যম প্রটোকল নিয়ে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চকে মিসকোট করে সংবাদ প্রচার করেছে। পরে একজন বিচারপতির সফর নিয়েও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সুপ্রিম কোর্ট এবং সাংবিধানিক পদাধিকারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে, এটাই আমি শুনানিতে বলেছি।
আবেদনকারী আইনজীবীকে উদ্ধৃত করে আদালতের আদেশে বলা হয়, ‘দেশে কোনো ভিআইপি নাই’- এমন কোনো আদেশ বিচারপতি এফআর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ দেয়নি। তাই রিটে যাদের বিবাদী করা হয়েছে তাদের দায়ী করা ঠিক হবে না।
সংশ্লিষ্ট অনলাইন নিউজপেপারগুলো আদালতের আদেশ না দেখে নিজ দায়িত্বে এ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করেছে।
আদেশে বলা হয়, আদালতে বিচারকদের ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন করা হলেও আমাদের মনে রাখা জরুরি, তখনও আমরা একজন মানুষ। আমরাও ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে না। কখনও কখনও সুনির্দিষ্টভাবে চিন্তার প্রকাশ নাও হতে পারে। আদলতে একজন বিচারক যখন কথা বলেন, অনেক সময়ই তা বিষয়বস্তুর বাইরে চলে যায়। যে কারণে যা বলতে চাই তা অনেকেই বুঝতে ভুল করেন। তাই শুনানির সময় বিচারকরা যখন তাদের চিন্তাগুলো নিয়ে কথা বলেন, সে কথাগুলোকে চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তাই ভবিষ্যতে চূড়ান্ত রায়ের আগে তাদের সে কথাগুলোর ওপর ভিত্তি করে জনগণ যেন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়। কারণ চূড়ান্ত রায়েই কেবল আদালতের উদ্দেশ্য এবং ভাবনাগুলো সঠিকভাবে প্রতিফলন ঘটে।
সুপ্রিম কোর্ট একটি সাংবিধানিক সংস্থা হওয়ায় রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম ও সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী বিচারপতিরাও প্রটোকল পান। সেই প্রটোকল না দেওয়ায় আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে ফেনীর সাবেক জেলা জজ মো. ফিরোজ আলমকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে হাই কোর্ট।
গত ১৩ ফেব্রূয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কুদ্দুস জামানের হাই কোর্ট বেঞ্চের রায়ে বিচারপতিদের ভ্রমণ ও পরিদর্শনের ক্ষেত্রে প্রটোকল ব্যবস্থা নিয়ে কয়েক দফা নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
সেই নির্দেশনায় বলা হয়-ছুটির দিনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কোনো জেলা সদরে পরিদর্শন, ভ্রমণ বা সফরে গেলে জেলা ও দায়রা জজ পদ মর্যাদার অন্তত একজন বিচারিক কর্মকর্তা সফরকারী বিচারপতিকে সার্কিট হাউজ বা তার অবস্থানের জায়গায় অভ্যর্থনা জানাবেন। সে সময় জেলা ও দায়রা জজ জেলা সদর দপ্তরে অবস্থান করলে অবশ্যই তাকে সফরকারী বিচারপতিকে সৌজন্য কল করতে হবে।
সপ্তাহের কোনো কর্মদিবসে অফিস চলাকালে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি সফরে গেলে জাজ ইনচার্জ নেজারত বিচারপতিকে অভ্যর্থনা জানাবেন। তবে আদালতের কার্যক্রম শেষে জেলা দায়রা জজ অথবা তার অনুপস্থিতেতে একজন বিচারিক কর্মকর্তা সফরকারী বিচারপতিকে সৌজন্য কল দিবেন।
সফরকারী বিচারপতি উপজেলা বা গ্রামে অবস্থান করলে জাজ ইনচার্জ নেজারত অথবা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তার দেখভাল করবেন।
সফরকারী বিচারপতির বিদায়ের সময় জেলা ও দায়রা জজ বা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বা তাদের প্রতিনিধিদেরও সে সময় উপস্থিত থাকতে হবে।