আইনশিক্ষাবিদ জ্ঞানতাপস অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ সিদ্দিকী স্মরণে

41

জিয়া হাবীব আহসান এডভোকেট

জ্ঞানতাপস বহু আইনবিদ এর শিক্ষক, প্রবীণ মানবাধিকার কর্মী, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম আইন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশানের প্রবীণ হাটহাজারী মাদার্শা গ্রামের কৃতি সন্তান সদস্য এডভোকেট আলহাজ্ব সালেহ আহমেদ সিদ্দিকী স্যার আর নেই। গত ১১ জুন ২০২২, রোববার ভোরে তিনি মহান মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন ওপারে।ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা মহান প্রভূ দয়াময় রহমান রহিম মেহেরবানি করে আমাদের এই প্রিয় শিক্ষক এর সকল গুনাহখাতা মাফ করে দিন, কবরকে জান্নাতের বাগিচা করে দিন, জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন, আমিন। ঐদিন রোববার বাদ জোহর দুপুর ২ টায় মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময়ের কর্মস্থল আদালত প্রাংগনে অনুষ্ঠিত হয়। শত সহগ্র সতীর্থ দের শেষ শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হলেন তিনি।
তারপর নিজ জন্মস্থানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় সমগ্র বৃহত্তর চট্টগ্রামের আইন অংগনে নেমে আসে শোকের ছায়া। নিরলস নিরহংকারী সালেহ আহমদ সিদ্দিকী স্যার ওকালতি পেশার পাশাপাশি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম আইন কলেজের শিক্ষকতার দায়িত্ব সহ উপাধ্যক্ষ পরবর্তীকালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এতদাঞ্চলে তখন আইনশিক্ষার পাদপীঠ ছিল এ প্রতিষ্ঠানটি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে কুমিল্লা সিলেটে আরো দু একটি হাতে গোনা আইন কলেজ থাকলেও চট্টগ্রাম আইন কলেজ তখন স্বগৌরবে দেদীপ্যমান। আজকের অনেক বিখ্যাত আইন ব্যক্তিত্ব। এ কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। ৯০ এর দশকে আমারও সুযোগ হয় এখানে লেখাপড়ার এবং সালেহ আহমদ সিদ্দিকী স্যার, অধ্যক্ষ ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী, আলহাজ্ব শামসুদ্দিন আহমদ মির্জা, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন মাহমুদ, মরহুম এডভোকেট মুজিবুর রহমান প্রমুখ গুণী শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আইন শিক্ষা পাওয়ার। এসকল ব্যক্তিত্ব ছিলেন এক একজন আইনের জগতের ধ্রæব তারা। যাদের নাম শুনলে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় মানুষের মাথা ন্যূজ হয়ে আসতো। এরা ছিলেন একএকজন একাধারে আইনের শিক্ষক, গবেষক, লেখক, সত্য প্রতিষ্ঠার নির্ভিক সৈনিক, পরিশ্রমী নিষ্ঠাবান ত্যাগী মানবতার সেবক। সালেহ স্যার আমার আব্বা মরহুম আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা এডভোকেট এর বন্ধু ও একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় আমাকে ভাইপো বলে সম্বোধন করতেন। তিনি স্নেহ বশতঃ আমাকে আইন কলেজের বিভিন্ন কাজ ও অনুষ্ঠানাদীর দায়িত্ব পালন করতে দিতেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চট্টগ্রাম জেলা শাখার সহ সভাপতি ও আমি যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরবর্তীতে আমি ঐ সংগঠনের চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি ও জাতীয় কমিটির সদস্যের দায়িত্বও পালন করি ।শ্রদ্ধেয় ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী স্যারের নেত্বৃত্বে তখন এতদাঞ্চলে মানবাধিকার আন্দোলন তুংগে। পুলিশ হেফাজতে দরিদ্র গার্মেন্টস শ্রমিক সীমা ধর্ষণের আলামত গোপন মামলা, রেলওয়ে ও বন্দর নার্সদের বেতন ভাতা আদায়ের মামলা,নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে ঐতিহািিসক বন্দরটিলা ক্ষতিপূরন মামলা সহ বহু চাঞ্চল্যকর মামলা মোকদ্দমা, তদন্ত, আপোষ বিরোধ নিষ্পত্তি চলছিল। আমাদের কোতোয়ালি মোড় মানবাধিকার অফিসে সালেহ আহমদ স্যারকে শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিটি মানবিক কাজে হাজির পাওয়া যেত। নিষ্ঠাবান বিনয়ী মানুষটি স¤প্রতি করোনাকালে একদিন আমার কোর্ট চেম্বারে হঠাৎ চলে আসেন। আমিতো অবাক-খুশি। তিনি চেকের একটি জটিল মামলা নিয়ে আমার সাথে একাডেমিক ডিসকাশন করতে চান আর বলেন,তুমি নাকি চেক মামলা বিশেষজ্ঞ তাই তোমার কাছে এলাম। জ্ঞান পিপাসু মানুষটির শিশু সুলভ আচরণ আমাকে বিমোহিত করে। আমিও তাঁর কাছে ছোটদের থেকেও শেখার দীক্ষা লাভ করি। তবে স্যারের দোয়া এবং ভালোবাসার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না। এসব সিনিয়রগণ অভাবে অনটনে কখনো অর্থের পেছনে ঘুরেননি, জ্ঞানের পেছনে জীবন দিয়ে গেছেন। অর্থের পেছনে নয়, অর্থ তাদের পেছনে ঘুরেছে।
পারিবারিক সূত্রে জানি ১৯৬৭ সালে উনার বিয়ে হয় ।যিনি ছিলেন সে সময়ের একজন টগবগে মেধাবী যুবক । লম্বা, চওড়া, সুদর্শন স্বপ্নের নায়ক। তার পিতার নাম তজু মিয়া । হাটহাজারীর মাদার্শা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া এ যুবক তখন আইনে প্রথম শ্রেণী পাওয়া একজন স্নাতক ডিগ্রী ধারী ছিলেন। সময়ের তুলনায় এটা বিশাল ব্যাপার ছিলো। চট্টগ্রাম সে সময় কোন পাত্রের পরিবারের শহরে স্থায়ী আবাস না থাকলে সাধারণত কোন অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়েকে বিয়ে দিত না। একজন ব্রিটিশ আমলের আমলা ও পাকিস্তান সময়ের প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তাঁর শ্বশুর মানিক চিনতে ভুল করেন নি। তিনি তাঁকে সে সময় দেখেই বুঝেছিলেন এইটা একটা প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ একে কেউ আটকাতে পারবে না । নিজের চেষ্টায় জীবনে অনেক দূর এগুবে। এর পর উনি শ্বশুর পরিবারের অনেকটা আভিভাবক হয়ে গেলেন । শ্বশুর পরিবারের সব ছোট ভাইবোনদের সহযোগী হিসেবে। প্রচুর অধ্যাবসায় ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট । এই জন্যেই তাকে জ্ঞানতাপস বলাই শ্রেয় । ১৯৯৫ সালের দিকে হাটহাজারীর একটি বড় মালায় আদালত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্যে জনৈক আইনবিদ কে এডভোকেট কমিশনার নিযুক্ত করেন। বাদীর পক্ষে ছিলেন আমার আব্বা, বিবাদী পক্ষে সালেহ স্যার। আব্বা আমাকে তাঁর পক্ষে জুনিয়র হিসেবে সেখানে পাঠান। সেখানে সালেহ স্যার আমাকে অনেক সাপোর্ট দেন এবং কাজ শেখার সুযোগ করে দেন। আমার ওকালতি জীবনের ওটাই ছিল প্রথম এডভোকেট কমিশনার বৈঠকে অংশগ্রহণ।

উনার উদারতা, সততা, সাহস, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতার ফলে জীবনে কখনো উনাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। সফলতা উনার কাছে ধরা দিয়েছে সব সময়ে। উনি আমাদের জীবনে দেখা অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের একক প্রচেষ্টায় শূন্য হতে সিঁড়ি বেয়ে সর্বোচ্চ শিখড়ে উঠে গিয়েছিলেন। পেশা জীবনে উনি একজন সফল নামকরা আইনবিদ ছিলেন। চট্টগ্রাম আইন কলেজের অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পরীক্ষক সহ বিভিন্ন পেশাগত ও সামাজিক কাজে সফলতা দেখিয়েছিলেন। উনি সারাজীবন উনার গ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের পাশে থেকে সাহায্যের চেষ্টা করেছিলেন। অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন । সহজ, সরল আর নিরহংকারি মানুষটিকে দেখলে মনেই হতো না যে উনি এত বড় নামকরা আবইনবিদ বা আইনের শিক্ষক, অধ্যক্ষ ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে উনি একজন সুখী স্বামী ও পিতা। উনার পাঁচ সন্তানই উচ্চ শিক্ষিত এবং দেশী-বিদেশী সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। অতি স¤প্রতি তাঁর সহধর্মিণী স্বর্ণ প্রসবিনী মা হিসেবেও পুরস্কৃতও হয়েছেন । তিনিও একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা।
মরহুমের শ্যালক বিশিষ্ট স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ চৌধুরী ফজলে বারী তাঁর মৃত্যুতে তাঁর নিজের এফ বি ওয়ালে লিখেছেন, আমরা দুলাভাইকে হারিয়ে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। জানি জন্ম মৃত্যু নিয়ে আমাদের কোন হাত নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছে। কেউ জানে না কার ডাক কখন আসে। তবুও প্রিয় জনদের হারানোর বেদনা মেনে নিতে আমাদের অনেক কস্ট হয় । বিশেষ বড় দুলাভাই ছিলেন আমাদের পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। আমাদের দুলাভাইটা ছিলেন সে হৃদয়ের কাছাকাছি একজন মানুষ। যার হারিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে আমার বোন, আমার ভাগ্নেদের সুমন, শাকিল, সুজন, শাউন ও সাম্মি এবং আমাদের মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবার মাথার উপর হতে শক্ত ছাতাঁ যেন ভেংগে পড়ে গেলো। মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সে আঘাত সইবার ক্ষমতা দিক । আল্লাহ রব্বুল আলামীন মরহুমের সকল মানবতার সেবায় তাঁর সকল আত্মত্যাগকে কবুল ফরমা, আমীন ।

লেখক : কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সু-শাসনকর্মী