আইনজীবী হত্যায় পলাতক মাদক মামলায় জেলে!

18

সবুর শুভ

মাদক মামলায় কারাগারে থেকেও হত্যা মামলায় পলাতক! মামলা দুটি পাশাপাশি দুই থানায় দায়ের করা। হত্যা মামলাটি চকবাজার ও মাদক মামলাটি বাকলিয়া থানায় দায়ের করা হয়। হত্যা মামলাটি চট্টগ্রাম আদালতেরই আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পী হত্যার ঘটনায় দায়ের করা। মামলার প্রধান আসামি তার কথিত স্ত্রী রাশেদা বেগম। হত্যাকান্ডের দুদিন পর গ্রেপ্তার হয়ে রাশেদা কারাগারে গিয়েছিলেন। এরপর অবশ্য জামিন নিয়ে বের হয়ে যান। একপর্যায়ে নিয়মিত হাজিরা না দিলে মামলাটিতে তার বিরুদ্ধে আবার পরোয়ানা জারি হয়। কিন্তু সেই পরোয়ানা জমা থাকে চকরিয়া থানা পুলিশের হাতে।
এ অবস্থায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর মাদক মামলায় রাশেদাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলেও আইনজীবী হত্যা মামলায় এখনো পলাতক রয়েছেন তিনি। এ হত্যা মামলায় সর্বশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিনও পলাতক ছিলেন আইনের খাতায়।
এদিকে রাশেদার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা থাকার বিষয়টি জানতেন মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) বাকলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অঞ্জন দাশ গুপ্ত। আসামি গ্রেপ্তারের ফরোয়ার্ডিংয়ে তিনি রাশেদার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা বিচারাধীন থাকার বিষয়টি উল্লেখও করেছেন। তবে হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকেও অবহিত করেননি। যদিও আইও দাবি করেছেন, এটা তার দায়িত্ব নয়।
আসামির নাম-ঠিকানা দিয়ে ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) পর্যালোচনা করে মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আসামি যে ওই মামলায় পলাতক সেটি তিনি জানতেন না। এটি তার জানার সুযোগও ছিল না।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, এটা আসামিদের এক ধরনের ছলচাতুরি। রাশেদা একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় হয়তো জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেননি। এক্ষেত্রে মাদক মামলায় জামিন নিয়ে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার উদ্দেশ্য থাকাটাও উডিয়ে দেয়া যায় না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট আশরাফ উদ্দিন খন্দকার জানান, আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীকে নির্মম কায়দায় হত্যার ঘটনা চট্টগ্রামে বেশ আলোচিত। ওই মামলার প্রধান আসামি রাশেদা মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন বলে শুনেছি। এক্ষেত্রে আসামি রাশেদার উচিত ছিল বিষয়টি তার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করা। হয়তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে তিনি তা করেননি। তবে মাদক মামলার আইও বিষয়টি খোঁজ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে অবহিত করতে পারতেন। এ মামলায় রাশেদাকে কখন শোন এরেস্ট দেখানো হয় সেটাই লক্ষ্য করার বিষয় বলে জানান এ আইনজীবী।
প্রসঙ্গত, চকবাজার থানার কে বি আমান আলী রোডস্থ বড় মিয়া মসজিদের সামনে একটি ভবনের নিচতলার বাসা থেকে ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর তরুণ আইনজীবী বাপ্পীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় তার হাত-পা ও মুখ টেপ দিয়ে মোড়ানো এবং স্পর্শকাতর অঙ্গ কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। চরম নির্মমতার মাধ্যমে আইনজীবী বাপ্পীকে হত্যা করার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। আইন অঙ্গনে শোকের ছায়া ফেলে এ হত্যাকান্ড। ঘটনার পর বাপ্পীর বাবা আলী আহমেদ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বারের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায় হত্যাকান্ডের শিকার হলেন আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পী। গ্রামের বাড়ি বান্দরবান জেলার আলীকদমের চৌমুহনী এলাকায়। মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ফারুক। হত্যাকান্ডের আগ পর্যন্ত তিনি অবিবাহিত ছিলেন বলে জানতেন আত্মীয়-স্বজনরা।
পিবিআই’র তৎকালীন চৌকষ অফিসার এবং বর্তমানে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা হত্যা মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করার দু‘দিনের মাথায় প্রধান আসামি রাশেদাসহ ৬ জনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসেন। এরপর চলতে থাকে নিবিড় তদন্ত কার্যক্রম। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরপর একেএকে বেরিয়ে আসে এ হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক কাহিনী।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যমতে, ঘটনার কয়েকদিন আগে প্রধান আসামি রাশেদা তার স্বামীসহ থাকার কথা বলে ওই বাসা ভাড়া নেন। ঘটনার রাতে ওই বাসায় থাকতে যান বাপ্পি। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দেলোয়ার নামে এক ইয়াবা পাচারকারীর স্ত্রী ছিলেন রাশেদা বেগম। স্বামীর মামলার সূত্র ধরে আইনজীবী বাপ্পীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তারা গোপনে বিয়ে করেন।
আসামিদের গ্রেপ্তারের পর আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিনের বক্তব্য ছিল, আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। রাশেদাকে দুই লাখ টাকা কাবিননামায় বিয়ে করেন বাপ্পী। কাবিনের সেই টাকা বাড়িয়ে ৫-১০ লাখ টাকা করার পরিকল্পনা করেন রাশেদা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বন্ধু হুমায়ুনের মাধ্যমে চার যুবককে ভাড়া করেন রাশেদা। পরিকল্পনা অনুযায়ী খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিতে গিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে রাশেদা ওই পাঁচ যুবকের সহযোগিতায় বাপ্পীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।
এদিকে আলোচিত এ মামলার তদন্ত শেষে ২০১৮ সালে ৫ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন পিবিআই’র পরিদর্শক (বর্তমানে খুলিশী থানার ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা। এতে পরস্পর যোগসাজশে বাপ্পীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় রাশেদাসহ ৬ আসামির বিরুদ্ধে। ছয় আসামিই কারাগারে ছিলেন অভিযোগপত্র দাখিলের সময়। পরে প্রধান আসামি রাশেদার জামিন হয়। জামিনের পর আদালতে হাজিরা না দিলে আবার তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়। সেই পরোয়ানা যায় চকরিয়া থানা পুলিশের হাতে। এরই মধ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাকলিয়া থানার সৈয়দ শাহ এলাকা থেকে আরেক নারী সহযোগীসহ দুই হাজার ১০০ পিস ইয়াবা নিয়ে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। আদালতের নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী রাশেদা বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ডিবি পুলিশ জব্দ ইয়াবাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আসামিদের বাকলিয়া থানায় হস্তান্তর করে। এরপর বাকলিয়া থানায় একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের হয়। মামলা দায়েরের পর বাকলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অঞ্জন দাশ গুপ্ত তদন্তের দায়িত্ব পান। ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি রাশেদাসহ দুই আসামিকে আদালতে পাঠান। তখন তার ফরোয়ার্ডিং কপিতে রাশেদার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।
তিনি জানান, আসামিদের অপরাধ রেকর্ড তথা সিডিএমএস পর্যালোচনা করে তার বিরুদ্ধে যা পেয়েছি, তা ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখ করেছি। মাদক মামলাটি তদন্ত করে আমি ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। আসামি এখনো জেলহাজতে আছে। এর বাইরে অন্যকোন কিছু আমার জানার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কেশব চন্দ্র নাথের বক্তব্য হচ্ছে, ১৩ ডিসেম্বর আইনজীবী বাপ্পী হত্যা মামলায় আদালতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ মোট পাঁচজন সাক্ষ্য দেন। রাশেদা মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকার বিষয়টি কেউ অবহিত করেনি।