আঁধার করে আসে

70

মুশফিক হোসাইন

‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে। / আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে। কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,/ আজ আমি যে বসে আছি তোমার আশ্বাসে’।’ রবি ঠাকুর শান্তি নিকেতনে বসে ১৯০৯ এ কবিতাটি লিখেছিলেন। কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অসাধারণ ব্যঞ্জনায় দুরন্ত বাতাসে আজো ভেসে বেড়ায় তার সুর লহরী। আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষা কাল। প্রাচীন কাল হতে গাঙ্গেয় অববাহিকার বদ্বীপে ‘বর্ষা আসতো বেশ ঘটা করে। বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। বলা যায় কবিগুরু রবি ঠাকুর থেকে নিয়ে পুঁচকে কবি সকলেই বর্ষা মঙ্গলে মেতে উঠ। আমাদের প্রকৃতি ও সেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠতো। আষাঢ়ের প্রথম প্রহরে কদম ফোঁটা যেন আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। কদম ছাড়াও প্রকৃতিতে কেয়া, দোলন চাঁপা, হরেক রকমের লিলি, রঙ্গন, নয়নতারা, ওলট চÐাল, কাঠ গোলাপসহ নানা ফুলের সমারোহ দেখা যায় বর্ষার ভেজা বাতাসে ঘুরে বেজায় মাদকতায় ভরা সৌরভ। বিলে ঝিলে ফুটে নানা প্রজাতির শাপলা, পদ্ম ও ভ্যাট জাতীয় ফুল। খাল বিল গ্রামে গঞ্জে প্রচুর বর্ষার পানি জমতো। আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগেও তিন দিন, পাঁচ দিন এবং সাত দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হতো। মুরব্বিরা বলতেন ‘বোরা’। তারা আবার দিনক্ষণও বলতে পারতেন। শনিতে তিন দিন, মঙ্গলে পাঁচ দিন কিংবা বুধে সাত দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি বোরা লেগে থাকতো।
আমাদের শৈশবে লাগাতার বৃষ্টি দেখেছি। এই বোরার দিনে স্কুলে যাওয়া বন্ধ। জানালার শিক গলিয়ে পা দোলাতে দোলাতে বৃষ্টির ঝরে যাওয়া দেখতাম। নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি ঝরে পড়ার সেকি আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বাড়ির আশেপাশে পানি জমে যেত। তখন হলুদ/ সোনালী দাগের বড় বড় সোনা ব্যাঙের উদয় হতো। সারা দিন-মান ক্রমে কী রাতেও তাদের ঘো-ঘ্যাত ঘো-ঘ্যাত গান শুনে শুনে ঘুমিয়ে যেতাম। এক নাগাড়ে শুনতেও ভালো লাগতো। বেশ মজা পেতাম। ওদের দেখে দেখে সময় পার করে দিতাম। মাঝে মাঝে ওরা মারামারি করতো। এখন পরিণত বয়সে এসে বুঝছি, ওটা ছিল প্রজনন সময়। তখন ওরা মিলিত হতো। আর আমরা ভাবতাম মারামারি করছে। জানালার পাশে আম কাঁঠালের গাছ। গাছের ডালে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকত বৃষ্টি ভেজা কাক দম্পতি। তখন ওরা আমার প্রতিবেশি, ভয় পেত না। ধুস করে তাড়ালেও যেও না। আসলে বৃষ্টির দিনে মা আমাদের খৈ মুড়ি, পিঠা, নাড়–, ফল ইত্যাদি খেতে দিতেন। আমরা কিছু খেতাম, কিছু খেলতাম। বিশেষ করে মুড়ি ও খই জানালা দিয়ে নৌকার মতো ভাসিয়ে দিয়ে মজা পেতাম। সাথে ছোট ছোট কাগজের নৌকাও ভাসাতাম। যখনি খই-মুড়ি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারতাম, কাকেরা ছো মেরে তা লুফে নিত। বর্ষায় কাক আমাদের বন্ধু হয়ে যেত।
সাম্প্রতিক সময়ে আকাশে মেঘের পর মেঘ জমে। আঁধার করে এলেও এখন আর সে দিন নেই। তেমন করে বৃষ্টি নামে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষা এখন বিলম্বিত। পরিসংখ্যান বলছে গত কয়েক বছর ধরে বর্ষা অনিয়মিত। বর্ষাকালে বর্ষা নেই, গড় বা অসময়ে বর্ষা এসে শহর গ্রাম, ক্ষেতের ফসল সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখন বাংলাদেশে শ্রাবণ মাস, তথা বর্ষার সময়। বর্ষা আসে চিরচিরিয়ে, ঝিরঝিরিয়ে। ভাদ্র মাসের বৃষ্টির মতোÑ এই এলো এই নেই। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে না। আবহাওয়াবিদরা ভবিষ্যত বাণী করছেন দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রবেশ করেছে। বায়ু ঠিকই আসছে। মেঘে জল নেইÑ ঝরবে কোত্থেকে ? তাই ঝরে যেতে পারছে না। আকাশ দেখলে মনে হয় যেন শরতের আকাশ।
প্রকৃতির এমন বিরুদ্ধ আচরণ বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলছে। সাধারণ মানুষ ও সরকার নির্বিকার। প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণ দিন দিন রুক্ষ হচ্ছে। নির্মমতা বাড়ছে। বিজ্ঞান বলছে প্রকৃতি একটি শৃঙ্খলের মধ্যে চলে বা ঘুর্ণিত হয়। এই শৃঙ্খল মানব জাতি ভেঙ্গে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষাক্ত গ্যাস (মানব সৃষ্ট) বায়ুস্তর ফুটো করে দিচ্ছে প্রতিদিন। যার কারণে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ভারসাম্য হারিয়ে সে (প্রকৃতি) ওল্টাপাল্টা আচরণ করছে। উদাহরণ হিসাবে করোনা ভাইরাসের কথা বলি। এ ভাইরাসটি সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে তুলেছে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে শক্তিধর মানুষ আজ মৃত্যু ভয়ে কাঁপছে। এই ভাইরাসটি জীব জন্তুর শরীরে থাকার কথা। খাদ্য শৃঙ্খলের কোন একটিকে মানুষ ধংস করে দেওয়ার ফলে, সেই ভাঙ্গা পথে ভাইরাসটি মানুষের দেহে ভর করেছে। এ পর্যন্ত করোনায় সারা বিশ্বে পাঁচলাখের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় এক কোটিরও বেশি। আক্রান্তের ভয়ে মানুষের মনে নেই শান্তি আর স্বস্তি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য মানুষ আজ গৃহবন্দী। লকডাউনের বেড়াজালে গৃহবাসী। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও প্রবীণরা। যাদের প্রকৃতির সঙ্গে বেশি বেশি থাকার কথা স্বাস্থ্য রক্ষা ও মানসিক প্রশান্তির জন্য। আর কতো দিন মানুষ এভাবে গৃহে থাকবে। রুটি ও রুজির কারণে তাকে বের হতেই হচ্ছে। আজ পর্যন্ত প্রতিশেষধক ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। কবে হবে ? কবে সাধারণ মানুষ পাবে তার নিশ্চয়তা নেই।
এই শঙ্কার মাঝে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা। দেশের উত্তরের সীমানার দেশগুলোর পাহাড়ি এলাকায় তথা ভারত, চীন, ভুটান, নেপালে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় পশ্চাদভ‚মি বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে পানি ধেয়ে এসে প্লাবনের সৃষ্টি করে। দেশের ৬৮টি জেলার মধ্যে ৩০টি জেলা বন্যার পানিতে জলমগ্ন। লাখো লাখো মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায় যে ৩০টি জেলার মধ্যে ২০টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী উপচে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে চাষের জমি ও ফসল এবং পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ তলিয়ে যাচ্ছে। ধারনা করা হচ্ছে বন্যায় কমপক্ষে হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাস্তুতন্ত্র সমস্যায় পড়বে। গ্রাম রক্ষা বাঁধ, সড়ক, মহাসড়কে মানুষ আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য, পানির সমস্যা প্রকট আকার ধারন করছে। শুকনা খাবার ও শিশু খাদ্যের চরম অভাব বিরাজ করছে। সরকার ও প্রশাসন বলছেন পর্যাপ্ত পরিমান ত্রাণ সামগ্রী মওজুদ আছে এবং বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু গণমাধ্যমের সংবাদে দেখা যাচ্ছে যে, অধিকাংশ মানুষ একবেলা, আধবেলা খেয়ে কোন রকমে বেঁচে আছে। বন্যায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর খাদ্য সংকট আরো প্রকট। পানির নিচে পুকুর ও টিউব কল তলিয়ে যাওয়াতে পানীয় জলের তীব্র সংকট নতুনভাবে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পেটের পীড়া, চর্মরোগ, জ্বর, সর্দি কাশিসহ পানিবাহিত রোগ প্রকট হতে পারে। সেখানে বন্যার কারণে সব একাকার। টিনের চালে, মাচায়, সড়ক ও মহাসড়কে আশ্রয় নেয়া মানুষের সামাজিক দূরত্ব মানার প্রশ্নই অবান্তর। বন্যার পানি, আবাসন সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, সাপের ভয় তাদের আতঙ্কিত করে রেখেছে। সাথে আছে মহামারী করোনার ভয়। বন্যায় গ্রাম ও বসত ডুবে যাওয়ায় তারা চোখে অন্ধকার দেখছে। তাদের চোখে ঘুম নেই, পেটে অন্ন নেই। গতবারের বন্যায় দেখা গেছে উজান থেকে বিষধর সাপ ভেসে এসেছে। তাই অবিলম্বে সেখানকার কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা এবং জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে জরুরী ভিত্তিতে এন্টি ভেশন সরবরাহ প্রয়োজন। সাথে সাথে ঔষধ, চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসা কর্মী প্রেরণ করা বাঞ্চনীয়।
সব কিছু মিলিয়ে দেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রান্ত করছে। সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পয়সা নেই। করোনা মরামারীর কারণে সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার সম্মুখীন। দেশের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে। নি¤œ আয়ের মানুষেরা কর্মহীন। সাথে বন্যায় আক্রান্ত ৩০টি জেলা। রবিশষ্য ভেসে যাওয়াতে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এমতাবস্থায় দেশের সকল স্তরের মানুষের কৃচ্ছতা সাধন করে সামগ্রিকভাবে এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ এই মন্দ্রে দিক্ষিত ও উৎদীপ্ত হয়ে জাতিকে এগিয়ে যেতে হবে। সারা বিশ্ব জুড়ে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। ধনী-গরীব সকল দেশের অবস্থা তথৈবর। প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক তত্ত¡াবধানে এই ক্রান্তিকাল উত্তরণের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকার একার পক্ষে জাতীয় সমস্যা সমাধান করা সহজ হবে না। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক এবং সরকারের ঘনিষ্ঠজন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ মুহূর্তে ঋণ নেয়া যুক্তিযুক্ত হবে না। তার এ মন্তব্য দেশের সুশীলদের ভাবিয়ে তুলছে। কারণ সামনে অপেক্ষা করছে বিশ্ব মন্দা। বৈদেশিক মুদ্রা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের রক্ষা কবচ। তাই সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়ন কাজ সাময়িক স্থগিত রাখতে পারেন। আগে দেশের মানুষের অন্ন বস্ত্রের প্রাধিকার দেয়া বাঞ্চনিয়। তাই ভেবে চিন্তে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। প্রশাসন ও সমাজে দুর্নীতি ও লুটাপাটে মানুষ ও সরকার দিশাহীন। তাই কঠোর হস্তে দুর্নীতি বৃন্দ করুন। দুর্নীতির মহাগ্রাস থেকে দেশকে বাঁচান।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)

সংশোধনী : গত মঙ্গলবার ‘কর্ণফুলি’র ভাসমান সেতু: হারানো স্মৃতি নামক লেখায় কিছু তথ্যাগত ভুল আছে। ভবিষ্যতে তা সংশোধন করে অন্য লেখা দেয়া হবে-লেখক।