অ্যাডভোকেট হরিসাধন-একটি মহৎ প্রাণের প্রস্থান

139

 চট্টগ্রামের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী চলে গেলেন। সুপ্রিম কোর্টে যখন তাঁর পসার জমে উঠলো, তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে গত ডিসেম্বরে শেষ শয্যা নেন। তিনি জনপ্রিয় আইনজীবী অ্যাডভোকেট হরিসাধন দেবব্রহ্মণ। তাঁকে জনগণের আইনজীবী বললেও অত্যুক্তি হয় না।
শুধু আইনবিদ বললে হরিসাধন বাবুর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। তিনি একাধারে প্রগতিশীল রাজনীতিক, মানবাধিকারের প্রবক্তা ও সংগঠক, বিশিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা, পানচাষি সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এসব পরিচয়েও হরিসাধন বাবুর মহত্ত¡, মানবিকতা, বড়ত্ব ধরা পড়ে না। তিনি একজন উদার হৃদয়, মহৎপ্রাণ, বন্ধুবৎসল, মানবকল্যাণকামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পরিশীলিত জীবনবোধ, পরিচ্ছন্ন রুচি ও শুভ্র-সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন। হরিসাধন বাবুকে যারা দেখেন নি, তাঁর সঙ্গ লাভের সৌভাগ্য যাঁদের হয়নি, তাঁদের জন্যই একথাগুলি বলা। যাঁরা তাঁকে চিনতেন, জানতেন, তাঁদের কাছে নতুন করে হরিসাধন বাবুর পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজন নেই।
ফেরদৌস চৌধুরী, রইসুল হক বাহার, অ্যাডভোকেট হরিসাধন দেবব্রহ্মণ, সম্প্রতি আমার এই তিন বন্ধু কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে পর পর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অজানা গন্তব্যে। তিনজনই আমার খুব আপনজন ছিলেন। এমন আপন যে, মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়েও আমার কাছে বেশি আপন ছিলেন তাঁরা।
রাজনীতির সূত্রে তাঁরা আমার বন্ধুতে পরিণত হন। ফেরদৌস, বাহার, আমি একই রাজনীতি করতাম। হরিসাধন ভিন্ন পার্টি করতেন। ভিন্ন রাজনীতি নয়, ব্যাপক অর্থে আমরা যে রাজনীতি করতাম, তিনিও তাই করতেন।
সে রাজনীতি ছিলো সমাজতন্ত্রের রাজনীতি। হরিসাধন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা ছিলেন। আমরা প্রথমে জাসদ ও পরে বাসদের কর্মী ছিলাম। সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে সিপিবি ছিলো কুলীন ও জাসদ বা বাসদ অর্বাচীন বা ব্রাত্যজন।
হরিসাধনের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ বাহার ও আমার যোগাযোগ স্থাপিত হলো চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। জাসদ যেমন জিয়ার কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় আরোহন করতে চেয়ে ‘হিমালয়ান বøান্ডার’ করে আজো তার খেসারত দিয়ে চলেছে। সিপিবিও এক সময় জিয়ার স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন কর্মসূচি ‘উলশী-যদুনাথপুর’ এবং ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ’ প্রকল্পে মুগ্ধ হয়ে জিয়াকে সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করে প্রতারিত হয় এবং যখন বুঝতে পারে জিয়া কত ধুরন্ধর ও সুচতুর এক জান্তা, ততদিনে সিপিবির অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। হরিসাধনের মতো অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকরা কারাভ্যন্তরে নিক্ষিপ্ত হয়।
চট্টগ্রাম জেলের সিকিউরিটি ওয়ার্ডের লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে যখন দূরে পূর্বদিকে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের রোপিত কাঁঠাল চাপা গাছের দিকে চেয়ে চেয়ে এক অলস অপরাহ্নের ক্লান্ত প্রহর গুণছিলাম, তখন হঠাৎ করে সিকিউরিটি ওয়ার্ডের দরজা খুলে গেল বেশ শব্দ করে; আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে কারারক্ষীদের ঠেলা খেতে খেতে উদয় হলেন সিকিউরিটি ওয়ার্ডের নতুন অতিথিগণ (জেলখানার পরিভাষায় ‘নতুন আমদানি’)। প্রথমেই যিনি দৃষ্টি কাড়লেন, পরে যার সঙ্গে পরিচয় হলোÑতিনিই হরিসাধন দেবব্রহ্মণ। দীর্ঘদেহী হওয়ার কারণে তিনিই সর্বাগ্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বেশভূষা, চেহারা আর চলনে বলনে বিশেষ দ্রষ্টব্য বস্তু ছিলেন সকলেই। তাদের ওপর যে অত্যচার-নির্যাতনের বিরাট ঝড় বয়ে গেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কাপড়ে রক্তমাখা কিন্তু শুকিয়ে গেছে। কুঁচকে থাকা চোখ মুখে কষ্ট চেপে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো।
যাই হোক, সবাইকে বসিয়ে পরিচয় জেনে নিলাম। পটিয়া, বাঁশখালী আর বোয়ালখালী থানা থেকে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুভাষ আচার্য্য, শেখেরখিল নাপোড়ার তাহের মিঞা, শামসু মেম্বার, আবদুল কাদের, বিভূতি আর মুকুল। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে সুভাষ বাবু, শামসু মেম্বার আর কাদের আওয়ামী লীগের, তাহের মিঞা, বিভূতি, মুকুল ন্যাপের কর্মী ছিলো। বিভূতি পরে হরিসাধন বাবুর সঙ্গে পানচাষি সমিতি সংগঠিত করেন। মুকুল সুভাষ বাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র, বর্তমানে কুÐেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
পটিয়ার শুধু একজন হরিসাধন বাবু। হরিসাধন বাবু’র সঙ্গে সেই যে জেলখানায় পরিচয় হলো, সেই পরিচয় থেকে তিনি অচিরেই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন।
জেলখানায় আমরা রাজনৈতিক ক্লাস চালু করেছিলাম। মার্কসবাদ, লেনিনবাদ নিয়েই আলোচনা হতো। পৃথিবীর সৃষ্টি, প্রাণের সৃষ্টি, উভচর প্রাণী, স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী, চারপেয়ে প্রাণী, তারপর দু’পেয়ে প্রাণী বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের সৃষ্টি; প্রাকৃতিক পরিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে মানব সমাজ সৃষ্টি, পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, রাষ্ট্রের সৃষ্টি-এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার মধ্যে আমাদের দিনরাত কখন কেটে যেতো বুঝতেই পারতাম না।
জেলখানায় কয়েদী ও হাজতিদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও আমরা আন্দোলন করেছি। জেলখানার আন্দোলন হলো ‘হাঙ্গার স্ট্রাইক’। এক এক সময় এক এক দাবি নিয়ে আমরা খাওয়া বন্ধ করে দিতাম, আর জেল কর্তৃপক্ষের চেষ্টা থাকতো যেকোনভাবে আমাদেরকে খাওয়ানো। একবার এমনি এক অনশন ধর্মঘটের সময় জেল কর্তৃপক্ষ পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে আমাদেরকে লাঠিপেটা করার ফন্দি এঁটেছিলো। আমাদেরকে রোল কল করে যখন ফল্ ইন করানো হলো-তখন ডেপুটি জেলার, জেলার এবং সুপার আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করলে লাগলেন যাতে আমরা খেয়ে নিই। রোল কলের আগে মান্নান নামে একজন রাইটার গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে সাবধান করে দিয়ে যায় যে, আজকে জেল কর্তৃপক্ষ আপনাদেরকে অনশন ধর্মঘট ভাঙার জন্য অনেক সাধাসাধি করবে, তাতেও যদি আপনারা না খান, তাহলে আপনাদেরকে পাগল ঘণ্টি বাজিয়ে পিটাবে। আপনি আমার দেশি লোক, সেজন্য গোপনে কথাটি আপনাকে জানিয়ে গেলাম, যা’ করবেন, বুঝে শুনে করবেন। মান্নানের বাড়ি ছিলো বোয়ালখালী থানার শাকপুরা গ্রামে-আমাদের গ্রাম হুলাইন থেকে দু’ আড়াই মাইলের ব্যবধান। সে ছিলো জেলখানার একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাজার মেয়াদ থেকে শেষ হয়ে আসা বিশ্বস্ত কয়েদীদের মধ্যে থেকে রাইটার নিযুক্ত করা হয়। সুবেদার, ডেপুটি জেলারকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করা ছিলো তাদের দায়িত্ব। নতুন আসামি আসলে তাদেরকেও দাঁড় করিয়ে নামধাম লেখাজোকার কাজও তারা করে। সেটাকে বলা হয় ‘কেসটেবল’। সেখানে লেখালেখির কাজ করতো বলে তাদেরকে বলা হতো ‘রাইটার’। পাগলা ঘণ্টি মানে অনবরত একটা ঘণ্টা বাজানো। জেলখানায় মারামারি লাগলে, কোন আসামি পালালে বা পালাতে চাইলে কিংবা কোন আসামি জেল কর্তৃপক্ষের কথা শুনতে অমান্য করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করলে পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে দেয়া হতো। যতক্ষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসবে ততক্ষণ ঘণ্টা বাজবে আর সমানে গণপ্রহার চলতে থাকবে। তাতে দু’একজন যদি মারাও পড়ে আপত্তি নেই। পাগলা ঘণ্টির লাঠিগুলিও ছিলো বিশেষ ধরনের লাঠি। ‘কেরাকবেত’-এর মতো লাঠি। এমন বেত থেকে লাঠি বাছাই করা হতো যাতে লাঠিতে গিট থাকে। লাঠিগুলি পুড়িয়ে তেল ও ঘি মেখে এমন তেলতেলে করে তোলা হতো যে, ঐ লাঠির বাড়ি খেলেই পিঠে চাকা চাকা দাগ হয়ে যেতো এবং দরদর করে রক্ত বেরিয়ে পড়তো। অনেক পাগলা ঘণ্টিতে আসামি মারাও যেত। শুনেছি মারা গেলেও কাউকে জবাবদিহি করতে হতো না। তাই শাকপুরার মান্নান হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজের ছাত্র নাসিরের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলো।
যাই হোক, আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রশ্নের ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দিয়ে সেদিনের সন্ধ্যার সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়িয়েছিলাম। আমরা বেশ ক’বার অনশন ধর্মঘট করে আসামিদের জন্য অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলাম।
পরে আ.স.ম. আবদুর রবকে চট্টগ্রাম জেলে আনা হলে আমাকে কর্তৃপক্ষ আর চট্টগ্রাম জেলে রাখা নিরাপদ মনে করলো না। আমাকে নোয়াখালী জেলে নির্বাসন দিলো।
জেল থেকে বেরিয়ে হরিসাধন ওকালতিটা পড়ে নেয়। আমার মনে হয় নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বরাবরই উদাসীন ও বেহিসেবী হরিসাধন জীবনে নিজের জন্য একটাই কাজ করেছিলেন, সেটা হলো ওকালতি পাস করা। যদিও ওকালতিকেও তিনি নিজের কাজে লাগান নি। ওকালতি বিদ্যাকে তিনি দেশের কাজে, সমাজের কাজে, মানুষের কাজে লাগিয়েছিলেন। তখন চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির একঝাঁক উকিল ছিলেন। তন্মধ্যে এক্ষুণি মনে পড়ছে অ্যাডভোকেট একে এম এমদাদুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট শফিউল আলম, অ্যাডভোকেট অধ্যাপক শফিউল আলম, অ্যাডভোকেট আবদুল মোমেন ভূঁইয়া, অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্তের নাম। প্রবীণ ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী, অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হুদা, অ্যাডভোকেট ননী দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট কবীর চৌধুরী-রা ছিলেন। তবে তাঁরা ভাসানীপন্থী (ননী বাবু নন) ছিলেন। অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র লালা, অ্যাডভোকেট পূর্ণেন্দু চৌধুরী, অ্যাডভোকেট স্বভু প্রসাদ, অ্যাডভোকেট সাধনময় ভট্টাচার্য, অ্যাডভোকেট শংকর প্রসাদ দে, এরা ন্যাপ করতেন কিনা আমি জানিনা; তবে এই সার্কেলটার সঙ্গেই ছিলো হরিসাধন বাবুর ওঠাবসা।
হরিসাধন বাবু পরে ঢাকা চলে যান সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করার জন্য। এরশাদের সময়ে হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, আইনজীবীরা তা’ মানেন নি। সারাদেশের আইনজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এমন এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যে, এরশাদ পশ্চাপদসরণ করতে বাধ্য হন। হরিসাধন বাবু তরুণ আইনজীবী হিসেবে এই আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়ে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, হরিসাধন বাবু কিছু আগে পরে ঢাকায় প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং তিনজনই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিন্তু হরিসাধন বাবু যেহেতু গণমুখী ও আন্দোলনমুখী ছিলেন, অর্থোপার্জনের দিকে তাঁর কোন ঝোঁক গেল না। তাঁর জন্মই হয়েছিলো পরার্থে জীবন নিবেদিত করার জন্য। তিনি মেতে উঠলেন পটিয়ায় বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং অনুরূপ আরো বিভিন্ন আন্দোলনে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরকে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এসএসএকে ইজারা প্রদানের বিরুদ্ধে আইনি ও রাজপথের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন আপসহীন সেনাপতি হিসেবে। তিনি যদি নিজের আখের গুছাতে চাইতেন, তাহলে শুধু এসএসএ বিরোধী আন্দোলন থেকে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারতনে। সম্ভবত নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে আইনি লড়াইটাও তিনিই চালিয়েছিলেন।
আমি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, দলিল ও অন্যান্য উপকরণ সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে তিনি আমার সহযোগী হন। বইমেলা, নজরুল জন্মশতবার্ষিকী, বসন্তোৎসব ইত্যাদি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তিনি আমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পটিয়ায় গৌরব সংসদ নাম দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও পটিয়ার মনীষীদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বেশকিছু কাজ করেন। এ সমস্ত কাজের যাবতীয় ব্যয়ভার তিনি একাই বহন করেন।
তিনি তাঁর গ্রাম হাইদগাঁও-এ তিনটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে সেখানে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন পঙ্গু শরীর নিয়ে। ফিরে এসে, সে কী খুশি তাঁর। আমার বাসায় এসে আমাকে বলেন পাঁচ ছয় হাজার মানুষ হয়েছে।
ভারি দুঃখ হয়, দেশের জন্য, মানুষের জন্য যে মানুষটি এত কাজ করলেন, সেই মানুষটি হৃদরোগে, আয়ুবিক রোগে ভুগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেন। যত মানুষের তিনি উপকার করেছেন, সবাই যদি তাঁর চরম বিপদের দিনে তাঁর উপকার করতে এগিয়ে আসতেন, তাহলে হয়তো যমরাজ সদয় হয়ে আরো কিছুদিন তাঁকে এই সুন্দর পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতেন।
রুগ্ন শরীর নিয়েও তিনি অনেকদিন অপেক্ষা করে ছিলেন, হয়তো তাকিয়ে ছিলেন আমাদের দিকে আমরা তাঁর সুচিকিৎসার কোন বন্দোবস্ত করি কিনা সেটা দেখছিলেন। আমার ধারণা শেষের দিকে হৃদরোগের চেয়েও নিউরোলজিক্যাল রোগের আক্রমণে তিনি কাবু হয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাঁকে অনেকদিন থেকে বলে আসছিলাম কলকাতায় নব প্রতিষ্ঠিত নিউরো সায়েন্স হসপিটালে যাওয়ার জন্য। চট্টগ্রামেরই এক কৃতী সন্তান বিশ্ববিখ্যাত নিউরো সার্জন রাম প্রসাদ সেনগুপ্ত হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার খুব ভালো জানাশোনা আছে। আমি তাই বারবার উক্ত হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলাম। কিন্তু তাঁর অচলা ভক্তি দেবী শেঠিতে। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর শেঠি তাঁর অপারেশন করেছিলেন। সেজন্য তিনি মনে করেছিলেন শেঠির কাছে গেলেই তাঁর রোগ ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর রোগের চিকিৎসা যে আর শেঠির আওতায় নেই, সেটা আমি তাঁকে বুঝাতে পারিনি। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন, আমি দেখলাম তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলি বেঁকে চুরে একটার সঙ্গে আরেকটায় লেগে আছে। তখন তাঁকে আবার নিউরো সায়েন্স হসপিটালে যেতে বলেছিলাম। আমিও সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। তখন তিনি রাজি হয়েছিলেন, তবে বললেন ডিসেম্বরে ছেলের পরীক্ষার পরে যাবেন। কিন্তু ততদিন তাঁর পরমায়ু ছিলো না। ডিসেম্বরেই থেমে গেল তাঁর জীবন। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে একটি মহৎ প্রাণের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেলো।
হরিসাধন কেমন পার্টি-অন্ত-প্রাণ ছিলেন তার একটা উদাহরণ দিই। শ্রদ্ধেয় এমদাদ ভাই (অ্যাডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম) একদিন কথায় কথায় বললেন, হরিসাধনের কান্ড দেখেছেন? আমি বললাম কি, আমি ত জানি না। তিনি বললেন সাধন ওর পৈতৃক জায়গা জমি বিক্রি করে যে টাকা-পয়সা পেয়েছে সেটা কমিউনিস্ট পার্টির ব্যয় নির্বাহের জন্য শাহ আলমের হাতে তুলে দিয়েছেন। শাহ আলম মানে কমরেড শাহ আলম, তখন তিনি চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। শাহ আলম ভাই বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি।
বাংলাদেশে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত নিজের সমস্ত জমিজমা কোন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা তাঁর দলকে দান করেছেন কিনা সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্রিটিশ আমলে কোন কোন অবস্থান হিন্দু বামপন্থী নেতা, কর্মী বা সমর্থক তাঁদের নিজের বা পৈতৃক জমিদারির জমিজমা কমিউনিস্ট পার্টিকে দান করেছেন শোনা যায়। পল্টনে গোলাকৃতির কমিউনিস্ট পার্টির সুন্দর যে অফিসটা ছিলো, সেটাও নাকি সিপিবির প্রতি সহানুভূতিশীল কোন হিন্দু জমিদার দিয়েছিলেন। রাশিয়ার গøাসনস্ত, পেরেস্ত্রইকার প্রভাবে বাংলাদেশি মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও যখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন, তখন তাঁরা পল্টনের পার্টি অফিসটাও দু’ভাগ করে আধাআধি বখরা নিলেন। এক ভাগে তো কমিউনিস্ট পার্টি রইলো, অন্যভাগে যারা পার্টির হিস্যা নিলেন কিন্তু পার্টি আর করলেন না, তারা মনি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট নাম দিয়ে দখলে রেখেছেন। এখানে আমি মতি ভাই (মতিউর রহমান-সম্পাদক, প্রথম আলো), মফিদুল ভাই (মফিদুল হক-স্বত্বাধিকারী, সাহিত্য প্রকাশ), মোনায়েম ভাই (মোনায়েম সরকার) প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞেস করতে চাই, পার্টি না করলে পার্টির জন্য দানকৃত সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ওটা ভোগ করার অধিকার কি তাঁদের আছে?
মৃত্যুর দিন পনেরো পূর্বে হরিসাধন আমাকে ফোন করে আড়ষ্টকণ্ঠে বলেছিলেন-আপনি আশুদেরকে নিয়ে আপনাদের গ্রামে একটা ‘হুলাইন উৎসব’ করুন। আশু মানে আমার ভ্রাতৃপ্রতিম নূরউল আরসাদ চৌধুরী, যিনি এখন ঢাকা ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টর কত বড় সাংগঠনিক ও গণমানুষের নেতা হলে মৃত্যু শয্যায় থেকেও কোন ব্যক্তি কিসে মঙ্গল হয়, মানুষকে সংগঠিত করা যায়, সেটা চিন্তা করতে পারেন, আপনারাই ভেবে দেখুন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক