অস্থির আদালত পাড়া

48

সবুর শুভ

আদালতের মতো সুরক্ষিত জায়গা থেকে একের পর এক চুরি হচ্ছে মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি। এ চুরির তালিকায় কখনো আইনজীবী, কখনো আদালতের কর্মচারীদের নাম আসছে। নথি চুরির এ বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে। তোলপাড় হয়েছে চট্টগ্রাম আদালতে।
এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। বিভাগীয় মামলা হয়েছে আদালতের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সদস্যপদ স্থগিত হয়েছে আইনজীবী সমিতির তরফে। এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন বিচারকরাও।
আদালত থেকে নথি চুরি ঠেকাতে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত (সিএমএম) বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে চলতি মাসের শুরুতে। এ ব্যবস্থায় এখন থেকে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা নথি দেখতে চাইলে আইন অনুযায়ী লিখিতভাবে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া নথি দেখা এবং দেখানো দু’টোই বারণ বলে জানান মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ ইসমাইল।
আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সুরক্ষিত মামলার নথি থেকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকার চেক চুরির ঘটনায় পেশকার এএম মাসুদ হাসানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
তথ্য মতে, ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ইমপেক্সের মালিক এস এম পারভেজ আলম বাদী হয়ে একটি চেক প্রতারণা মামলা করেন চট্টগ্রাম আদালতে। মামলায় নগরীর পাঁচলাইশ থানা এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল আল বকরের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার চেক প্রতারণার অভিযোগ আনেন। বাদীকে দেওয়া আসামির ১২টি চেক ব্যাংকে অপর্যাপ্ত তহবিলের জন্য ডিজঅনার হওয়ায় মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলা দায়ের করার পর আদালত সমন দিলেও আসামি ফয়সাল হাজির না হয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে নগরীর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ।
১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম দ্বিতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে মামলার সাক্ষ্য দিতে গেলেই নথি থেকে ১২টি চেক গায়েব হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সবার সামনে আসে। এরপর পেশকার মাসুদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এক সদস্যের বিচারকের তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন যথা নিয়মে সম্পন্ন না হওয়ায় যথাযথ আইন প্রয়োগের স্বার্থে পেশকার মাসুদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আরেকটি বিভাগীয় মামলা করার মাধ্যমে তদন্ত শুরু করে সংশ্লিষ্ট আদালত। তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার দিবে যাবে সংশ্লিষ্টরা এমনটিই জানালেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ ইসমাইল।
এদিকে আদালতে মামলার নথি থেকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকার চেক চুরির ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে গত ১৩ অক্টোবর। মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ ইসমাইল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার আসামিরা হলেন মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী (৫৬), মো. এনামুল হক (৪২) ও জিকু দাশ (৩০)। তাদের মধ্যে ইদ্রিস ওই চেকের মামলার আসামি, এনামুল আইনজীবীর সহকারী এবং জিকু আদালতপাড়ায় দালাল হিসেবে পরিচিত।
মামলায় বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সাবিত্রী বণিক নামে এক নারী ইদ্রিসকে আসামি করে একটি চেক ডিজঅনার মামলা করেন। মামলাটি বিচারাধীন অবস্থায় ২০১৯ সালে ৮ জুলাইয়ে যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ পঞ্চম আদালত থেকে চেক চুরির করে অভিযুক্তরা। চেকটির মূল্য ছিল এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ঘটনায় এরই মধ্যে ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী এসএম মাসুদ হাসান ও অফিস সহায়ক তপন কান্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন জানান, ২০১৯ সালে আদালতে মামলার নথি থেকে চেক চুরির ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ ইসমাইল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। আমরা মামলাটি নিবিড়ভাবে তদন্ত করছি। আসামিদের আইনের আওতায় এনে পুরো চক্রের তথ্য ফাঁস করার কথাও জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর একই আদালত থেকে প্রায় ২৮ কোটি টাকা মূল্যের আরও একটি চেক চুরির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত আইনজীবী জোবায়ের মোহাম্মদ আওরঙ্গজেবের সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে জেলা আইনজীবী সমিতি। এরপর বিষয়টি অনুমোদনের জন্য সাধারণ সভায় পাঠানো হয়েছে জানিয়ে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এএইচএম জিয়া উদ্দিন বলেন, প্রথমে নিয়ম অনুযায়ী সদস্যপদ স্থগিত করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সাধারণ সভায় পাঠিয়েছি। এখান থেকে সিদ্ধান্ত আসলে ওই আইনজীবীর সনদ বাতিলের জন্য সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা হবে।
একের পর এক এ ধরনের ঘটনায় আদালতে মামলার নথির নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে আইনজীবী বিচারপ্রাথীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিচারকদের মাঝে। যেকোন মূল্যে মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক লিখিত অনুমতি ছাড়া নথি দেখানোর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট আইনের এ ধরনের নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নাজির মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ।