অসুস্থ বাণিজ্য-ভয়ানক প্রতারণা

34

ওয়াসিম আহমেদ

মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতা না থাকায় ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ক্ষতিকর চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহ করে ‘মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েল’ অনুসারে বর্জ্য পোড়ানো, মাটিতে পুঁতে ফেলা ও জীবাণুমুক্তকরণের কথা থাকলেও চসিকের সাধারণ বর্জ্যরে ভাগাড়ে ফেলে আসছে নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ কাজের জন্য ১৩০টি হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে ছয় বছর ধরে মাসে ৩ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। যথাযথ উপায়ে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করায় জনস্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে। তবে চিকিৎসা বর্জ্য পোড়াতে আধুনিক ‘ইনসিনারেটর’ বসাচ্ছে সিটি করপোরেশন। এমনটা জানিয়েছেন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।
গত বছর চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রথমবারের মত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগের তথ্য মতে চট্টগ্রাম শহরে ৮৭টি মেডিক্যাল এবং ১৮০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। তারমধ্যে ১৩০টি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্ধারিত ফি-এর বিনিময়ে চিকিৎসা বর্জ্য সংগ্রহ করে চসিকের নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা বলতে রয়েছে নিজস্ব ৩টি ২ থেকে ৩ টনের কাভার্ড ভ্যান। সুনির্দিষ্ট জনবলের কোনো তথ্য নেই। শতাধিক হাসপাতাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বর্জ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় হাসপাতালগুলো সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে মিশ্রিতভাবে বর্জ্য ফেলেই দায় সারে। যা জনস্বাস্থের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ বলে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা বর্জ্য সংগ্রহ করে সনাতন পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা ও অস্বাস্থ্যকর উপায়ে প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকিলিং করে বলে উল্লেখ করা হয় সেই প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে গত ৩১ আগস্ট যথাযথ চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ওই প্রতিষ্ঠানকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওইদিন পরিবেশ অধিদপ্তর গণমাধ্যমকে জানায়, ‘সাধারণ ও চিকিৎসা বর্জ্য পৃথকভাবে পরিবহনের বিধান থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তা অনুসরণ করছে না। এতে চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালার লঙ্ঘন হয়েছে। সাধারণ ও চিকিৎসা বর্জ্য প্রতিষ্ঠানটি একত্রে পরিবহন করছে। এতে সাধারণ বর্জ্যও পরিণত হচ্ছে সংক্রামক বর্জ্য। সিরিঞ্জের সুঁচ, কাঁচি ইত্যাদি ধারালো ও সংক্রামক বর্জ্য কাটা বা ধ্বংস করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো যন্ত্রপাতি দেখা যায়নি। উচ্চ তাপমাত্রায় মেশিনে বর্জ্য ধ্বংস করার কথা থাকলেও সেখানে সনাতন পদ্ধতির চুল্লি দিয়ে তা করা হচ্ছিল। স্যালাইনের নল ও বোতলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম পাকা চৌবাচ্চায় ব্লিচিং পাউডারের দ্রবণে রেখে জীবানুমুক্ত করার কথা বলা হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে বিøচিং পাউডার পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ম ভেঙ্গে সরাসরি না করে ‘হযরত শাহজালাল এন্টারপ্রাইজ’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানায় পরিবেশ অধিদপ্তর। সংক্রামক বর্জ্যগুলো জীবাণুমুক্ত ও পরিশোধন ছাড়াই কেটে টুকরো করে তা বিভিন্ন রিসাইক্লিংকারী প্রতিষ্ঠানে শাহজালাল এন্টারপ্রাইজ বিক্রি করছে বলে প্রমাণ পায় পরিবেশ অধিদপ্তর।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের এপ্রিলে চসিকের সাথে নিজস্ব যান ও জনবল নিয়ে মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার চুক্তি করে চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিনিময়ে হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে নির্ধারিত ফি আদায় করতে পারবে। ‘মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ২০০৫ ম্যানুয়েল’ অনুযায়ী কালার কোডে বর্জ্য সংগ্রহ করে বার্নিং করে ডাম্প করার শর্ত দেওয়া হয়। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে কাজ করানো হলে চুক্তি বাতিলের শর্ত দেওয়া হয়। সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সংগ্রহ করা হলেও প্রতি দুই বছর পর চুক্তির মেয়াদ নবায়ন করেছে সিটি করপোরেশন। চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ম্যানুয়েল অনুসারে ক্ষতিকারক, ধারালো ও রিসাইক্লিং বর্জ্য আলাদা বদ্ধ পাত্রে সংগ্রহ করার কথা। ক্ষতিকারক বর্জ্য নির্দিষ্ট তাপাতায় পুড়িয়ে ছাই তৈরি, ধারালো বর্জ্য মাটিতে পুতে ফেলা এবং রিসাইক্লিং বর্জ্য সম্পূর্ণরূপে রাসায়নিক ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করতে হবে। যার কোনোটাই করে না চসিকের নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান। এমনকি পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তার যোগসাজশে চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মীদের দিয়ে মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে চসিকের উপ প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করতে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। ছয় বছর আগে ১১টি হাসপাতাল দিয়ে কাজ শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি এখন ২১১ হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ফি অনুসারে ছোট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩ হাজার, মাঝারি হাসপাতাল থেকে ৪ হাজার এবং বড় হাসপাতাল থেকে মাসে ৭ হাজার টাকা করে ফি আদায় করে তারা। তাদের ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়ায় জাইকার অর্থায়নে একটি ইনসিনারেটর মেশিন বসানো হচ্ছে। যেটা দিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় চিকিৎসা বর্জ্য পুড়িয়ে ছাই করা হবে। তাতে পরিবেশে জীবাণু ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। মেশিনটি বসানোর পর ব্যবস্থাপনার খরচ ও বর্জ্য সংগ্রহ নিয়ে নতুনভাবে ভাবা হবে। কারণ এখন তো সিটি করপোরেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা করতে পারবে।
এসব বিষয়ে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এতোদিন মেডিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে কিন্তু সঠিকভাবে নয়। জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই জাইকার সাথে কথা বলে ইনসিনারেটরের ব্যবস্থা করছি। যেটা দিয়ে ঘণ্টায় দুইশ কেজি মেডিক্যাল বর্জ্য পুড়িয়ে ছাই করা হবে। ক্ষতিকর বর্জ্য সংগ্রহ থেকে পোড়ানো পর্যন্ত ব্যবস্থপনায় কোনো গাফিলতি সহ্য করা হবে না। ইনসিনারেটর মেশিনটার জন্য ৩৬ লাখ টাকা বন্দরে ডিউটি দিয়েছি। এটি বসানোর পর মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নিব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের চুক্তি নবায়ন করা হবে, নাকি সিটি করপোরেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসবে।
প্রসঙ্গত, ইনসিনারেশন বা জ্বলন হলো একটি বর্জ্য নিষ্কাশন প্রক্রিয়া এবং একটি নিষ্পত্তি পদ্ধতি যার মাধ্যমে শক্ত জৈব বস্তুগুলো দহন অর্থাৎ পোড়ানো হয় এবং অবশিষ্টাংশ বায়বীয় বস্তুতে রূপান্তর করা যায়। বর্জ্য পদার্থসম‚হকে পোড়ানোর জন্য ইনসিনারেশন একটি আধুনিক নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি। ইনসিনারেশন প্রক্রিয়াটি রাসায়নিকভাবে সংঘটিত একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কেবল জৈব বর্জ্যকেই ক্ষয় করে না সেগুলো ধ্বংস করতে পারে। ইনসিনারেশন সঠিকভাবে সম্পন্ন এবং পরিবেশবান্ধব করার জন্য পোড়ানোর আগে বর্জ্যসম‚হকে আলাদা করে নিতে হয়।