অসতর্কতায় বাড়ছে অগ্নি-দুর্ঘটনা

208

শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে না হতেই প্রায় প্রতিদিনই নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটে চলেছে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত অগ্নি-দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটলেও ব্যাপকভাবে সম্পদহানির খবর মিলছে। অসতর্কতা এবং অসাবধানতার কারণে যেমন অগ্নি-দুর্ঘটনা বাড়ছে, তেমনি অজ্ঞতার কারণে প্রাণ ও সম্পদহানির মাত্রাও কমিয়ে আনা যাচ্ছে না।
চলতি মৌসুমে গত শুক্রবার ছুটির দিনে নগরীর ভিক্টোরি জুটমিলের ভাড়া দেয়া দুইটি বিশালাকার গুদামে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তারা। এ ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
ভিক্টোরি জুটমিলে আগুনের ক্ষত না শুকাতেই গতকাল শনিবার বিকালে প্রায় কাছাকাছি সময়ে নগরীর পৃথক স্থানে জোড়া অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সৃষ্ট আগুনে দু’টি গ্যারেজে রাখা তিনটি প্রাইভেট কার ও ১৮টি রিকশা ভ্যান পুড়ে গেছে। এতে ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সন্ধ্যায় নগরীর দেওয়ানহাট এলাকায় ফারজানা গার্মেন্টস নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটে। কারাখানার পঞ্চম তলায় থাকা ঝুটের গুদামে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
অগ্নি প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, অসাবধানতা এবং অজ্ঞতার কারণেই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সচেতনতার মাধ্যমে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ করা প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। অগ্নিকান্ডের কারণ, সতর্ক থাকার নিয়মকানুন এবং অগ্নিকান্ডের পর
করণীয়- ন্যূনতম এই তিনটি বিষয় প্রত্যেকের জেনে রাখা উচিত। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অগ্নিনির্বাপণ মহড়াসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির পরও এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত হচ্ছে না। এছাড়া, অগ্নি প্রতিরোধ ও অগ্নিনির্বাপণ আইন-২০০৩ এরপর সরকার সর্বশেষ ২০১৪ সালে অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক করলেও বিধিমালার অনেক ধারাই বাস্তবে উপেক্ষিত থাকছে।
দমকল বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, উদাসীনতার পাশাপাশি ঘনবসতি ও সংকীর্ণ সড়ক এবং প্রতিনিয়ত কমতে থাকা পানির উৎস অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিকে উল্টো ভয়াবহ করে তুলছে। নগরীতে বর্তমানে শিল্প-কারখানা, গুদাম, মার্কেট ও বসতি মিলিয়ে চার শতাধিক স্থাপনা অধিক মাত্রায় অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ বা অধিকতর ঘিঞ্জি এলাকা হিসেবে পরিচিত রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, কর্ণফুলী সিঙ্গাপুর মার্কেট এবং আগ্রাবাদের মোগলটুলী, মাদারবাড়ি, বাকলিয়ার মিয়াখাননগর, পাহাড়তলীর আমবাগান, ইপিজেডের কলসী দীঘির পাড়, বায়েজিদ শেরশাহ এলাকার বেশকিছু কলোনি রয়েছে ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে। এসব এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিরও আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বা চলাচলের সড়কগুলো এতই সরু এবং সংকীর্ণ যে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও দমকল কর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছানো একপ্রকার অসম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতবছর শুরুতেই নগরীর প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লার একটি পাঁচতলা একটি ভবনের তৃতীয় তলায় অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় থাকা ‘গার্ডিয়ান আইপিএস’ নামের দোকানে আগুন লেগে দগ্ধ হয়ে মারা যান দোকানের মালিক শুভ্র দাশ বাবু (৫০)। এ ঘটনায় দগ্ধ ও ধোঁয়ায় মো. ইকবাল, অঞ্জন দাশ, বিজয় চৌধুরী, জুয়েল দে, রহিম বাদশা, বাবলু ও মিন্টু হাসান নামে আরও সাতজন অসুস্থ হন। তারা সবাই ওই দোকানের কর্মী ছিলেন। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুন ওই দোকানে রাখা আইপিএসের ব্যাটারির তরল উপকরণসহ কেমিক্যালে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। ভবনে উঠানামার সিঁড়ি ছিল অতি সংকীর্ণ। একইভাবে গত ৩১ আগস্ট বিকেলে নগরীর সদরঘাট থানার মাঝিরঘাটের স্ট্র্যান্ড রোডে একযোগে সাতটি লবণ কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চারটি কারখানা পুরোপুরি আগুনে পুড়ে গেছে। বাকি তিনটি কারাখানা আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। শতভাগ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া কারখানাগুলো হল মেসার্স সুমন সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, জননী সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, তানভীর সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও সী সাইট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এছাড়া পপুলার সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সাগুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এলিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানা আংশিক ক্ষতির শিকার হয়।
সেসময় ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি অগ্নিনির্বাপক গাড়িভর্তি সরঞ্জাম নিয়েও দমকল কর্মীরা দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। স্থানীয়ভাবে পানির উৎস না পাওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের বেগ পেতে হয়েছে। এমনকি সড়ক না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের অন্য কারখানার টিনের ছাদে উঠেও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হয়েছে। বছরের শেষদিকে এসে গত ২২ নভেম্বর দুপুরে নগরীর নন্দনকানন এলাকায় আগুন লেগে মমতাজ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ১২টি কাঁচা বসতঘর পুড়ে যায়। এতে অর্ধ লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। আমরা অভ্যাসগত কারণেই অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি তৈরি করে রাখি। তাছাড়া ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। যে কারণে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হলেও তা নির্বাপণে ফায়ার কর্মীদের বেগ পেতে হয়। ফায়ার সনদ নিলেও নির্দেশনা অনুসরণে অভ্যস্থ হচ্ছে না। একইভাবে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করা হয়না। ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকায় কোন কোন সময় প্রাণহানি বেশি ঘটে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ত্রুটিমুক্ত নয়। যে কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পাওয়া যায়। নগরে নির্বিচারে জলাশয় ভরাটের কারণে অগ্নি নির্বাপণের সময় পানি সংকটে ভুগতে হয়।
তিনি আরো বলেন, অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ করা প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। একটু সচেতন হলেই আমরা মারাত্মক এসব দুর্ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারি। কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম রাখা, ফায়ার ডোর ব্যবহার করা, বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিবছর নিয়মিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র পরীক্ষা করিয়ে রাখা এবং ছোট অবস্থাতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলে বড় ধরণের ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
উল্লেখ্য, অগ্নিকান্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ-দুর্ঘটনাসহ যে কোনও দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় সরকারের প্রথম সাড়াদানকারী প্রতিষ্ঠান হল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এক্ষেত্রে তাদেরকেই প্রথমে সংবাদ দেওয়া হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের জরুরি নম্বরগুলো হল- ০৩১-৭১৬৩২৬-৭, ২৫২১১৫২-৩, ০১৭৩০-৩৩৬৬৬৬ ও ০১৯৬৮-৮৮১১১৩।