অসংগতিতে সমাজ

54

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস ফেব্রুয়ারি প্রায় শেষ। এমাসেই পালিত হলো বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস। এ সকল দিবস শুধু আচার পালনের? এ থেকে সমাজ, দেশ ও জাতি কী শিখতে পেল-সেটাই হলো বিবেচ্য। আমার ধারণা এ দিবসগুলো দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকভাবে আমাদের উন্নত করতে এখনো সক্ষম হয়নি। নানান আনুষ্ঠানিকতা ও আচার পালনের বিত্তে আমরা আবর্তিত হচ্ছি। এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। অন্যথায় জাতি হিসাবে আমরা উন্নতি ও সভ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে যাব। আমাদের মনন ও মেধায় ঘাটতি থেকে যেতে পারে। অথচ ভাষা আন্দোলন, এগারো দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় বিশাল অর্জণ আমাদের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে। এবার আসা যাক নৈতিক ও চারিত্রিকভাবে কোন অবস্থায় আছি তার দু-একটি উদাহরন দেয়া যাক। গত দু’বছর থেকে চট্টগ্রামে সম্মিলিত উদ্যোগে একুশের হচ্ছে বই মেলা। লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীসহ সকল স্তরের নাগরিকদের নিয়ে চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে বৃহত্তর আকারে পালিত হচ্ছে একুশের বইমেলা। এবারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রায় দুইশতটি স্টল সেখানে অস্থায়ীভাবে নির্মিত হয়েছে। প্রকাশকগণ তাদের স্টল নিজেরা সাজিয়ে নিয়েছেন। দেখতে বেশ নান্দনিকও লাগছে। এমনি একটি স্টলের একটি বইয়ের তাক গোছানোর সময় দুর্ঘটনাক্রমে বিক্রয় প্রতিনিধির মাথায় পড়ে। বেচারা কোনমতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আশপাশে অনেকগুলো স্টল। তাদের কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। মেলায় আগুšুÍক দর্শনার্থীদের কেউ কেউ স্মার্ট ফোনে ভিডিও ছবি ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বটে। সমাজে নানা ঘটনা দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের ও প্রাণিদের উদ্ধারের চেষ্টা না করে ভিডিও ধারণ করার নজির বহু আছে। এ ধরনের উদাহরণ বিশেষতঃ অনুন্নত ও নৈতিক অধপতিত জাতিসমূহে বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশ ক্রমশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরও আমরা আমাদের নৈতিকতা উন্নত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। মোদ্দা কথায় আমাদের মানবিক হতে হবে। দ্বিতীয় একটি উদারণ দেওয়া যাক, অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে খাগড়াছড়ির গুইমারাতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিনদিনব্যাপী বইমেলা। উক্ত বইমেলায় এগারোটি স্টল দেয়া হয়। লক্ষনীয় যে, তিনদিনে মেলায় লক্ষাধিক টাকার বই বিক্রি হয়। আমি উক্ত বই মেলায় একটি প্রকাশনার পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলাম। মেলায় পাহাড়ি ও বাঙালি কিশোরদের প্রচুর সমাগম হয়। যেহেতু তারা ছাত্র-ছাত্রী, তাদের হাতে হয়ত টিফিনের ২০/৫০ টাকা। তাই তারা বিক্রেতার কাছে ২০/৫০ টাকার বই বেশি খোঁজে। তবে বিজ্ঞানের বইয়ের সাথে তারা ধাধা, ভূতের বাস্পের বইও খোঁজে। উক্ত মেলায় আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে যে, প্রকাশকরা এখনও ভূত পেতিœ, রাক্ষস, পরীর কল্পকাহিনী নিয়ে নির্বিচারে বই প্রকাশ করছেন। অথচ বৈজ্ঞানিক এই তেমন দেখা যায় নি। যা আছে তাও হাতে গোনা। প্রশ্ন হলো বাস্তবে ভূত পেতিœ, পরী, রাক্ষস ইত্যাদির কোন অস্তিত্ব নেই। এই সকল অবাস্তব কাহিনী দিয়ে শিশুদের মন, মনন, মেধা ধ্বংস করার কোন মানে নেই। এতে করে শিশুদের বিকাশ তো হচ্ছেই না বরং তাদের অবাস্তব একটি জগতে ফেলে বিভ্রান্ত করা দুঃখজনক। প্রকাশকদের উচিত হবে লেখকদের বিজ্ঞান মহাকাশ প্রকৃতি, ইত্যাদি বাস্তব বিষয় কল্প বা বাস্তব কাহিনী লেখার জন্য তাগিদ দেয়া। যাতে করে শিশু মনে ঐ সকল বিষয়ে একটি বাস্তব ধারণা জন্মাতে পারে। যা পরবর্তী শিক্ষা ও কর্মজীবনে তাদের পথ দেখাতে পারে। অতএব অবাস্তব বিষয় নিয়ে লেখকদের গ্রন্থ রচনা না করার অনুরোধ রইল। প্রকাশকদেরও অনুরোধ করব। তারা যেন এই ধরনের বই প্রকার করা থেকে বিরত থাকেন এবং সমাজকে বিজ্ঞান মনস্ক করার জন্য অবদান রাখবেন।
যে কথাটি বলতে চেয়েছি তা হলো, যে মাঠে বইমেলা অনুষ্ঠিত হলো, তার পাশেই গুইমারা কলেজিয়েট স্কুল দ্বিতল স্কুল ভবনের উপরে ও নিচে দুইটি বাথরুম আছে। নামিদামি সেনিটারি ফিটিংস লাগানো আছে। আমার মনে হলো ভবন নির্মাণের পর ঐ সকল টয়লেট একদিনের জন্যও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়নি। গাদা গাদা ময়লা সাদা সাদা টাইলস, কমোড, প্র¯্রাবে নোংরা হয়ে আছে। তার নিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এটা একটি টয়লেটের অবস্থা হয়। তাহলে কোমলমতি শিশু কিশোরদের মনে কী প্রভাব পড়তে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এই শিশু কিশোররা কী তাদের বাড়িঘরের টয়লেট পরিষ্কার রাখার মানসিকতা জন্মাবে? পরবর্তীতে কর্মজীবনে এসে ও তাদের মন মানসিকতায় এর ছাপ দেখা যাবে। আমাদের প্রকাশকদের এক নারী বলেছিলেন ব্রাস, ও পাউডার পেলে আমি নিজেই পরিষ্কার করে দিতাম। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও উপজেরা প্রশাসনের কাছে আকুল আবেদন, ঐ স্কুলের টয়লেট ও মাঠ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ নিন। স্কুল ভবনের আশপাশে পুষ্পন ও ফলজ বৃক্ষ লাগানোর উদ্যোগ নিন। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে ছাত্র-ছাত্রীদের অবশ্যই অংশ নিতে উৎসাহিত করুন। একটি দেশের মোট আয়তনের প্রাকৃতিক পরিবেশে যদি ২৫, শতাংশ বনবনানী থাকে, তবে তাকে আদর্শ পরিবেশ বলা যাবে। দুর্ভাগ্য যে, বাংলাদেশের মোট আয়তনের হিসাবে বনবনানী হরো মাত্র ১০-১২ শতাংশ। এই বিষয়ে শিশুদের উৎসাহিত করতে যেমন হবে তেমনি তাদের হাতে কলমে কাজ করার জন্য বাধ্য করতে হবে। ব্যবহারিক কাজ না জানার কারণে বিদেশে আমাদের নাগরিকদের কর্মসংস্থান কম হচ্ছে। প্রবাসে তাই শুধু শ্রমিক বা নির্মাণকর্মী হিসাবে তারা স্থান পাচ্ছে।
তৃতীয়ত: আমাদের বইমেলা যে মাঠে অনুষ্ঠিত হলো, তার অপর পারে গুইমারা গভ: মডেল হাইস্কুল। যা ১৯৬৩ সালে স্থাপিত হয়েছিল। স্কুল ভবনের আশপাশে বেশ কিছু টিলা ও পাহাড়। স্কুল মাঠে গিয়ে দেখলাম সেখানে একটি শহীদ মিনার। গুইমারাবাসী একুশের প্রথম প্রহরে সেখানে ফুল দিয় শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল একটি টিলা কেটে সেখানে মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সরকারি আইন অনুযায়ী পাহাড় কাটা অপরাধ। গুইমারায় কী পরিবেশ অধিদপ্তর নেই? নেই কোন উপজেলা প্রশাসন, কিম্বা পুলিশ বাহিনী? কেন, কিভাবে একটি সরকারি স্কুল। কর্তৃপক্ষ পাহাড় কাটতে সাহস পেল। সরকারের প্রচলিত আইনের প্রতি বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখাতে সাহস করে? সর্বোপরি এ বিদ্যালয়ে যারা বিদ্যা অর্জনে গিয়েছে তারা তো পাহাড় কাটার শিক্ষা ও পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে কোন স্থাপনা নির্মাণ নয়। ঐ স্কুলে প্রাঙ্গণে প্রচুর পতিত ভূমি আছে। পাহাড়টি রক্ষা করেও মিলনায়তন করার উদ্যোগ নেয়া যেত।
আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক অনেক অর্জন আছে। যা পৃথিবীর অনেক দেশ ও জাতি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে গ্রহণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আমাদের ভাষার জন্য আত্মদানের স্বীকৃতি হিসাবে জাতিসংঘ কর্তৃক একুশে ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। এ ধরনের আরো আছে যা আন্তর্জাতিক অঙ্গন স্বীকৃতি প্রাপ্ত। আসুন আমাদের এই অর্জন ও উন্নতিকে আরো বিকশিত করার জন্য আমাদের আচরণ, মানসিকতা মন উন্নত করার লক্ষ্যে সংযত হই। বিশ্ব যেন আমাদের অনুস্বরণ করে সেভাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে। সভ্য সমাজের প্রভৃতি হিসেবে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করতে শ্রম দিতে হবে কর্ম ও চেতনায়।

লেখক- কবি, নিস্বর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)