অশুভ’র বিনাশ শুভ শক্তির উদয় হোক

79

 

দুর্গা শব্দের অর্থ দুর্গতি নাশিনী। আর পূজা শব্দের অর্থ যা করণে জীবনে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়। অর্থাৎ যার আরাধনার মধ্য দিয়ে জীবনের দুঃখ, দুর্দশা দূর হয়ে উন্নয়নের পথ সুগম হয় তিনিই মা দুর্গা। কথিত আছে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র, রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে অকাল বোধনের মাধ্যমে মহাশক্তির আধার শ্রীশ্রী মা দুর্গাকে জাগ্রত করে ১০৮টি নীল পদ্মের মাধ্যমে মায়ের চরণে পুষ্পার্ঘ অর্পণের মাধ্যমে দেবীকে তুষ্ট করে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিস্থলে রাবণের দশমুÐ ছিন্ন করে তাকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন ও মহান বিজয়া দশমীতে বিজয় উৎসব করেন। ভগবান রামচন্দ্র শরৎকালে এই পূজার আয়োজন করেছিলেন বিধায় এটিকে শারদীয় উৎসব হিসেবে আবহমান কাল থেকে বাঙালিরা পালন করে আসছে। আমরা এই উৎসবে মÐপে মন্ডপে দেবী দুর্গার যে মূর্তি দেখতে পাই সেটি হল পরিবার সমন্বিতা বা স্বপরিবার দুর্গার মূর্তি। দেবী দুর্গার এই পরিবার কাঠামোর মধ্যস্থলে স্বয়ং দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুর মর্দিনি। তাঁর মাথার উপর দেবাদিদেব শিব বা মহাদেব, ডান পাশে দেবী ল²ী ও গণেশ বামপাশে দেবী সরস্বতী ও কার্তিকেয়। শ্রীশ্রী লক্ষী সমৃদ্ধি বিকাশ ও অভূ্দয়ের প্রতীক। শুধু ধনৈশ্বর্যই নয়, তিনি চরিত্র ধনের ও প্রতীক। ধন, জ্ঞান ও শীল এই তিনেরই মোহনীয় বিকাশ দেবী ল²ীর চরিত্র মাহাত্ম্যে ফুটে উঠেছে। ডানপাশের গণেশ হলেন কার্যসিদ্ধির দেবতা। সনাতনী পুরাণের নিয়ম অনুসারে অন্যান্য দেবতার আগে গণেশের পূজা করতে হয়। শাস্ত্রমতে গণশক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ সেখানে কর্মের সকল প্রকার বাধা বিঘ্ন দূরীভূত হয়। দেবাসুর-যুদ্ধে দেবতারা যতবারই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসুরদের সঙ্গে লড়াই করেছেন ততবারই তারা জয়ী হয়েছেন। গণেশের আর এক নাম বিঘ্নেশ, অর্থাৎ বিঘ্ননাশকারী বিঘ্নশ প্রসন্ন থাকলে সিদ্ধি নিশ্চিত। দেবীর বাঁয়ে অন্যদিকে মা সরস্বতী হলেন বাণীরূপিনী বাগদেবী, তিনি জ্ঞানশক্তির প্রতীক। তার হাতে পুস্তক ও বীণা। তাই জ্ঞানের সাধনা করতে হলে সাধককে হতে হবে দেহে মনে প্রাণে শুভ্র-শূচি শ্বেতবর্ণা। তার বাহন হংস। দুধ মিশ্রিত পানি থেকে হংস যেভাবে পানিকে আলাদা করে দুধের সারবস্তুকে গ্রহণ করে ঠিক তেমনিভাবে আমাদেরকেও সমাজের সব পঙ্কিলতাকে ত্যাগ করে ভালো কিছু অর্জনের মধ্য দিয়ে একটি নিষ্কলুষ সুন্দর সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।
আবার দেবী কাঠামোর বাঁয়ে দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বা কার্তিক সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক। একারণে ব্যবহারিক জীবনেও কার্তিকেয়কে প্রসন্ন করতে পারলে ভক্তের ও শৌর্য-বীর্য অর্জন হয়। দুর্গার বাহন সিংহকেও শ্রীশ্রী চন্ডী-তে মহাসিংহ, বাহনকেশরী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। দুর্গাপূজার সময় সিংহকেও বিশেষভাবে পূজা করা হয়। দেবীপুরাণে উল্লিখিত সিংহের ধ্যানে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিষ্ণু, শিব, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীরা অবস্থান করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কেন্ডেয় পুরাণ অনুসারে হিমালয় দুর্গাকে এই সিংহ দিয়েছিলেন। শিবপুরাণ অনুসারে শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গাকে সিংহ দিয়েছিলেন। এই সিংহ হলো রজোগুনের এক প্রচন্ড শক্তির উচ্ছ¡াসের প্রতীক। মা দুর্গার কাঠামোতে দেবীর পদতলে দলিত মহিষাসুর ‘সু’ এবং ‘কু’ এর মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্ধে অশুভ শক্তির উপর শুভশক্তির বিজয়ের প্রতীক। তবে অসুর হলেও দূর্গোৎসবে মহিষাসুরের ও পূজার বিধি রয়েছে। মার্কেন্ডেয় পুরাণ ও কালিকা পুরাণ অনুসারে মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে নিজের মৃত্যুদৃশ্য স্বপ্নে দেখে ভীত মহিষাসুর ভদ্রকালীকে তুষ্ট করেছিলেন। ভদ্রকালী তাকে রক্ষার প্রতিশ্রæতি না দিলেও তাঁর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বরদান করতে ইচ্ছুক হন। আর এতে মহিষাসুর দেবতাদের যজ্ঞভাগ বর চাইলে দেবী সেই বর দিতে অসমর্থ হন। তবে মহিষাসুরকে এই বর দেন যে, যেখানেই দেবী পূজিতা হবেন, সেখানেই তার চরণতলে মহিষাসুরের স্থান হবে এবং পূজিত হবে। এমনকি দেবী আরো বলেন যে, মহিষাসুর পূজা ব্যতীত দেবী দুর্গার পূজা কখনো পরিপূর্ণ হবে না। অন্যদিকে এই দেবী কাঠামোর সকলের উপরে রয়েছেন দেবাদিদেব শিব। তিনি সবকিছু অবলোকন করছেন এবং দেবী দুর্গাকে প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য সাহস জোগাচ্ছেন। মা দুর্গার দশটি হাতের মধ্যে একটি আশির্বাদের অভয় হস্ত এবং বাকী নয়টিই হচ্ছে প্রহরণ যন্ত্র। এই নয়টি প্রহরণ যন্ত্র দিয়ে মহাশক্তি জগতের সকল অমঙ্গলকে দূরীভ‚ত করে এই পৃথিবীকে মঙ্গলালোকে উদ্ভাসিত করছেন। ঠিক তদ্রæপ আমাদের এই পার্থিব জগতে প্রতিটি জননীও যেন মা দুর্গার এক একটি উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব। মা দুর্গা যেমন সেদিন তার দশ হাত দিয়ে অশুভ শক্তিকে নিধনের মধ্য দিয়ে শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে দেবলোকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে প্রতিটি পরিবারের নারীরাও তার দুই হাতের মাধ্যমে সমস্ত ঝড়-ঝঞ্জাকে উপেক্ষা করে নিজ নিজ পরিবারে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন এটিই মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ