অশান্তির অনলে পুড়ছে পরিবার

25

মনিরুল ইসলাম মুন্না

সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে আপন ভাইয়ের সাথে অমিল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কারণে-অকারণে মতের অমিল, পরস্পরের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত, শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ির লোকজনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, বন্ধুত্বে সন্দেহ, প্রেমে ব্যর্থতা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, বেকারত্ব, করোনা মহামারির লকডাউনে তৈরি হওয়া অভাব-অনটন, সামাজিক-অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে অনলে পুড়ছে পরিবার। এসব কারণে দিন দিন বাড়ছে খুনোখুনি, হত্যা বা আত্মহত্যার মত ঘটনা।
চট্টগ্রামে গত বুধ, বৃহস্পতি ও গতকাল শুক্রবার তিনদিনে পারিবারিক কলহের জেরে হত্যা ও আত্মহত্যায় প্রাণ গেছে সাতজনের। এর মধ্যে গত বুধবার রাতে মিরসরাই উপজেলায় একই পরিবারের তিন সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাÐের শিকার তিনজন হলেন- মোস্তফা সওদাগর (৫৬), তার স্ত্রী জোছনা আক্তার (৪৫) ও তাদের ছেলে আহমেদ হোসেন (২৫)। এ ঘটনায় পুলিশ নিহত মোস্তফা সওদাগরের বড় ছেলে সাদেক হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটায় নগরীর আকবরশাহ থানাধীন শাপলা আবাসিক এলাকা থেকে আলমগীর হোসেনের (৩০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা গেছে, এর আগের রাতে তার সাথে ঝগড়া হয় স্ত্রীর। এরপর স্ত্রী বাপের বাড়িতে চলে যান। এ অভিমানে আলমগীর হোসেন আত্মহত্যা করেন। তিনি স্থানীয় একটি লেবু বাগানের পাহারাদার ছিলেন। একইভাবে গত বৃহস্পতিবার রাতে স্বামী সোহেল রানার সাথে অভিমান করে দুই সন্তানকে হত্যা করে স্ত্রী সুমিতা বেগম (২৭)। এরপর তিনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সুমিতা বেগমের দুই সন্তান জান্নাত মুন (৭) এবং শান ওরফে বাবু (২ বছর ৬ মাস)। পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে পরিবারে অশান্তি বিরাজ করছিল। এর জেরে আত্মহত্যা করেন সুমিতা।
এছাড়া করোনা মহামারিকালে দেশব্যাপী দেয়া হয়েছিল লকডাউন। এ সময় অনেক মানুষ চাকরি হারিয়ে বিষণ্ণতায় ভুগছেন। বেকার সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কেউ খুনোখুনিতে জড়ান। আবার কেউ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা ও আত্মহত্যা ঘটনার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এসব কারণ বের করে সুষ্ঠু সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনে দেশের নাগরিকদের বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে হত্যা-আত্মহত্যার কুফল বুঝিয়ে তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, খুন করা সমাজের নিকৃষ্টতম কাজ। সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। অসৎ সঙ্গের কারণে এবং অন্য একজনের প্ররোচনায় সমাজে খুনসহ নানা অপরাধ বেড়েছে। এক গবেষণায় খুন করার নেপথ্যে আমরা তিনটি কারণ বের করেছি। প্রথম কারণ হল- মাদকের অবাধ ব্যবহার। মাদকের নির্দিষ্ট রুট সম্পর্কে সবাই অবগত। কোন পথে এটি বেশি আসছে বা কীভাবে এটি রোধ করা দরকার, তা সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নি¤œ পর্যায় পর্যন্ত সবাই জানেন। তবুও মাদক পরিবহনের রুট নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর মাদক ক্রয়, বিক্রয়, পরিবহন মিলে তৈরি হয়েছে একটা সিন্ডিকেট বা চক্র। এ সিন্ডিকেটের চক্করে পড়ে টাকার লোভে একজন অপরজনকে খুন পর্যন্ত করে ফেলছে।
দ্বিতীয় কারণ হল- কিশোর গ্যাং। দেশে কথিত রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে গড়েছে শক্তিশালী এসব কিশোর গ্যাং। যেটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি, খুনসহ নানা অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি তারা নিজেদের জাহির করার জন্য এবং পদ পাওয়ার জন্য খুনের মত ঘটনাও ঘটাচ্ছে। আবার দেশে অযোগ্য প্রার্থীকে বড় পদ দেয়ার ফলে যোগ্য প্রার্থীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। যেটাতে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। এটি এক পর্যায়ে খুন করার পর্যায়ে নিয়ে যায়। অথবা বিষণœতায় ভুগে নিজে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
তৃতীয় কারণ হল- অস্ত্রের ব্যবহার। বর্তমানে দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি বেড়েছে দেশে তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার। যেমন রাম দা, ছুরি ইত্যাদি। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত বিভিন্ন হলে এসব অস্ত্র ব্যবহার করছে। আমি মনে করি, এটি প্রশাসনের দুর্বলতা। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য একটা পক্ষকে উস্কে দিয়ে যাচ্ছে, তাই অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। কাজেই অস্ত্রের ব্যবহার কমাতে প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মানুষ এখন লোভী হয়ে গেছে। আইন-কানুন না মেনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ ভাই-বোন ও পিতা-মাতাকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। এক ভাই শক্তিশালী হলে দুর্বল ভাইয়ের প্রতি অন্যায়-অবিচার করছে। এতে অন্য ভাইটি হয় অপর ভাইকে হত্যা করবে, না হয় হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেই আত্মহত্যা করবে। আমি মনে করি, এগুলো সমাজে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে। কাজেই হত্যা-আত্মহত্যা রুখতে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আত্মহত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ধরুন, এক ব্যক্তি জেনে বা না জেনে একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন, যেটা জানাজানি হলে নিজের মান-সম্মানহানী হতে পারে। তাই কি করবে বুঝতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি। তথ্য-প্রযুক্তির অপপ্রয়োগে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকে ব্ল্যাকমেইলিং করছে। এতে ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরি হচ্ছে। এমন মানুষদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যার মত জঘন্য পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং প্রশাসনের মাধ্যমে তাদেরকে নিরাপত্তার স্পেস তৈরি করে দিতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব সুইসাইড প্রিভেনশনের তথ্য মতে, বিশ্বজুড়ে বছরে সাত লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন। প্রতি এক হাজার মৃত্যুর মধ্যে ১৩ জনই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আবার প্রতি ১০০টি আত্মহত্যা করা মানুষের মধ্যে ৫৮ জনের বয়সই ৫০ বছরের নিচে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন আত্মহত্যা করেন। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ৯ হাজার ৩১০ জন আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে ১ হাজার ৯৪৯ জন বেশি আত্মহত্যা করেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার ডা. শহিদুল আলম বলেন, বর্তমান সময়ে টিনএজার ছেলে-মেয়েরা বাসা-বাড়িতে একা থেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে সামান্য একটু এদিক-ওদিক হলেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ সময় ছেলে মেয়েদের হরমোন ইন ব্যালেন্সড থাকায় এ প্রবণতাটা বাড়ে। যেমন- তারা ‘হয় করবো, না হয় মরবো’ বলে এমন এমন জেদ ধরে, যার ফলে আত্মহত্যাটাকে প্রিয় মনে হয়। এছাড়া দেশে বেকারত্বটা ‘অভিশাপ’ হওয়ায় আত্মহত্যাটাকে সহজভাবে নেন।
তিনি আরও বলেন, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যৌতুক ও নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক সম্পর্কে জটিলতা ইত্যাদি কারণে। উত্যক্ত ও প্ররোচিত করার কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। আবার অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণজনিত লোকলজ্জার ভয়েও এ ঘটনা ঘটে। এর বাইরে রয়েছে প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা, বেকারত্ব, কিছু শারীরিক অসুস্থতার কারণেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এগুলো হলো- বিষন্নতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়া।