‘অশনি’ নিয়ে আসছে অশনি সংকেত?

42

তুষার দেব

রুদ্র বৈশাখের খরতাপ আর রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি মধ্যেই আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’। প্রবল শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড় প্রতিবেশি দেশ ভারতের উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দু’-চার দিনের মধ্যেই আঘাত হানতে পারে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে। সেক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সাতক্ষীরা উপক‚ল। তবে দেশের অন্যান্য উপক‚লও একেবারে বিপদমুক্ত বলে মনে করছে না আবহাওয়া অধিদপ্তর।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল শনিবার বিকাল সাড়ে তিনটায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আরও সামান্য উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘনীভ‚ত হয়ে গতকাল শনিবার দুপুর ১২ টায় একই এলাকায় নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার চারশ’ ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে, কক্সবাজার উপক‚ল থেকে এক হাজার তিনশ’ ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে, মোংলা বন্দর থেকে এক হাজার চারশ’ ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার চারশ’ পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভ‚ত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলেমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ কারণে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার উপকূলকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগের অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপক‚লের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেইসাথে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বলছেন, আজ-কালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে প্রথমে লঘুচাপ অতঃপর গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে সেটি উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এটি উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা-খুলনা জেলায় আঘাত হানতে পারে। নিম্নচাপে রূপ নেয়ার পর এটির গতিপথ কোন দিকে যাবে তা ধারণা করা যাবে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট এন্ড সাস্টেনিবিলিটির আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশের মতে বলেন, এই মুহূর্তে ঘূর্ণাবর্তটি অবস্থান করছে দক্ষিণ আন্দামান সাগর এবং সন্নিহিত এলাকায়। গত ২৪ ঘণ্টায় আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো থেকে প্রাপ্ত পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, গতকাল শনিবার ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাত করার সময় তিন দিন পিছিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির গতিমুখও পরিবর্তন হয়েছে। আগামী ১৪ মে সকাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনের ওপর দিয়ে (ইউরোপিয়ান মডেল অনুসারে) ও আমেরিকান মডেল অনুসারে আগামী ১৩ মে দুপুরের পর থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী উপকূল দিয়ে স্থলভাগে আঘাতের আশঙ্কার কথা নির্দেশ করছে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাত করার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠতে পারে ঘণ্টায় একশ’ থেকে একশ’ ৩০ কিলোমিটার। ইউরোপিয়ান মডেলের পূর্বাভাস সঠিক প্রমাণিত হলে ঘূর্ণিঝড়টি সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে আমেরিকান মডেলের পূর্বাভাস সঠিক প্রমাণিত হলে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে প্রভাব বেশি পড়বে।
এই সংক্রান্ত ফ্ল্যাশব্যাকে চোখ রাখলে ট্র্যাক রেকর্ডটা এই রকম- ২০০৯ সালের ২৫ মে ধেয়ে এসেছিল প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। যার বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞে চিরচেনা রূপ হারিয়েছিল সুন্দরবন। এরপর ১১ বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এই অঞ্চলে পুনরায় আছড়ে পড়েছিল ‘আম্ফান’। সেটাও ছিল ২০ মে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৬ মে হাজির হয়েছিল ‘ইয়াস’। এবার আসছে ‘অশনি’। নামটি শ্রীলঙ্কার দেয়া। ‘অশনি’ মানে ক্ষুব্ধ।
এই বিষয়ে অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, দক্ষিণ আন্দামান সাগরের সম্ভাব্য লঘুচাপটি শেষতক ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তন্তরিত হওয়ার আলামত বিদ্যমান রয়েছে। এটি প্রতিবেশি পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও বাংলাদেশের দিকে মুখ করে আছে। তবে এর গতিপথ একেক সময় একেক দিকে দেখাচ্ছে। এ জন্য বলা মুশকিল, এটি আসলে কোন দিকে ধাবিত হবে। তবে আমাদের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী এটি পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও বাংলাদেশের উপক‚লের দিকেই আসবে। বাংলাদেশে প্রবেশ করলে ঘূর্ণিঝড়টি কোন দিকে আঘাত হানতে পারে সে ব্যাপারে এখনও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। যে কোনও দিকেই এটি আঘাত হানতে পারে। এটি দেশের পশ্চিম অথবা পূর্বাঞ্চলের দিকেও যেতে পারে।
এদিকে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ মোকাবিলায় সরকারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় পূর্ব প্রস্তুতি বিষয়ে আয়োজিত সভা শেষে সংবাদকর্মীদের তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি- ভারত মহাসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে একটি ‘ঘূর্ণি’ সৃষ্টি হয়েছে। এটি আগামী ৯ মে -এর মধ্যে লঘুচাপে রূপ নিতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে এটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ হবে। আগামী ১১ মে’র দিকে এটি নিম্নচাপে রূপান্তরিত হবে। পরে এটি গভীর নিম্নচাপ হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়, তাহলে এর ল্যান্ডফলটা সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক কোথায় হবে তা এখনও ক্যালকুলেশন হয়নি। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর জানাতে পারব কবে এটা বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ দেশ। আমাদের অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এজন্য আমরা এসওডি অনুযায়ী প্রাথমিক সভা ডেকেছি। সভায় ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কবে লঘুচাপ, কবে নিম্নচাপ সৃষ্টি হবে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের প্রস্তুতি কী, আমরা কোর পর্যায়ে কাদেরকে সংযুক্ত করব, কাদের দায়িত্ব দেব, কাদের কখন কী নির্দেশনা দেব- সেগুলো আমরা ঠিক করেছি। পরবর্তীতে যদি সতর্কতা সঙ্কেত দেয়া হয়, তখন আরেকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে নির্দেশনাগুলো মাঠ পর্যায়ে জানিয়ে দেয়া হবে। সিপিপি ভলান্টিয়ারদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা উপকূলীয় অঞ্চলে কাজ করছে, আমাদের যে এসওডি আছে, সে অনুযায়ী কখন কী করতে হবে সেটা আমরা সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিয়েছি।