‘অলৌকিক উত্তাপ’ : যাপিত জীবনের শৈল্পিক মনস্তাপ

115

মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন

“শরীরে যদিও ভাটার টান/ মন এখনও তেজোময় বুনো উদ্দাম”- দৃঢ়চেতা এ উক্তিটি করেছেন কবিতার জন্য ২০১৯ সালে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিবার (বাসাসপ), ঢাকা কর্তৃক পুরস্কার প্রাপ্ত মননশীল কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর। উক্তিটি তিনি করেছেন তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “অলৌকিক উত্তাপ”-এর ‘হারিয়ে যাবো’ শিরোনামের কবিতায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন- “বার্ধক্যকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। …. …. …. …. আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি- যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই।” (যৌবনের গান, কাজী নজরুল ইসলাম) কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বেলায়ও বিদ্রোহী কবির অমর উক্তিটি প্রযোজ্য। কারণ যাপিত জীবনের বিকেল বেলায় এসে কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী একে একে সৃজন করে যাচ্ছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি সাহিত্য-সম্ভার। আজকের আলোচনা তাঁর স¤প্রতি প্রকাশিত “অলৌকিক উত্তাপ” কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে।
‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক কাজী সাইফুল হক তাঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘গলুই’ প্রকাশন, মাহমুদ কমপ্লেক্স- ২য় তলা, নজির আহমদ চৌধুরী রোড, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২২। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪। চার রঙা আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ও একশ’ গ্রাম অফসেট কাগজে ছাপানো বোর্ড বাইন্ডিং লেমিনেশন কভার পেপার মোড়ানো বইটি বেশ চমৎকার। মূল্য ১৮০ টাকা মাত্র।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কবিকে পাঠকের কাছে পরিচিত করানো সমীচীন মনে করছি। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, পিতা: আলহাজ মাস্টার নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মাতা: আজবাহার বেগম। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কাকারা গ্রামে ৩০ জুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। বর্তমান বাসস্থান চকরিয়া পৌরসভার চিরিঙ্গা উপ-শহরের হাসপাতালপাড়ায়। শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো থেকেই সাহিত্য আর লেখালেখির দিকে প্রবল ঝোঁক। তাঁর রচিত প্রচুর গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনা করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছেন এমএ ডিগ্রি। পহরচাঁদা ফাযিল মাদরাসার বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক পদ থেকে বিগত ৩০ জুন ২০১৭ তারিখে অবসর গ্রহণের পর পুরোপুরি মগ্ন হয়েছেন লেখালেখিতে। লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। আমার গোপন দহন মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর প্রথম বই। এ গ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিবার (বাসাসপ) ঢাকা কর্তৃক সম্মাননা ২০১৯ লাভ করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশ ছোটগল্প ছোটো ছোটো দীর্ঘশ্বাস। তাঁর নতুন প্রভাত (নাটক) শিগ্গির প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
কবিরা সাধারণত সত্যনিষ্ঠ ও স্বপ্নচারী। কবিতার শরীর বুননে কবিরা হন একজন নিপুণ শব্দ-কারিগর। আলোচ্য কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও সে রকম একজন দক্ষ শব্দ-কারিগর। শব্দের বুননে তিনি কবিতাকে করে তুলেন বাক্সময় ও হ্রদয়গ্রাহী। সহজ বোধগম্যতার জন্য তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন শব্দের কোমলরূপ। এতে কবিতা পাঠে আপ্লুত হয় পাঠক হৃদয়। ৬৪ পৃষ্ঠার এ কাব্যগ্রন্থে মোট ৫৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতার ভাব, ভাষা, সৃজনপদ্ধতি ও বিষয়গত প্রকরণের দিক দিয়ে কবিতাগুলোকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। কাব্যগ্রন্থের ৯ম পৃষ্ঠা থেকে ৩৪তম পৃষ্ঠা পর্যন্ত প্রথম ভাগ এবং ৩৫তম পৃষ্ঠা থেকে ৬৪তম পৃষ্ঠা পর্যন্ত দ্বিতীয় ভাগ। উভয় বিভাগের কবিতাগুলো স্বমহিমায় ভাস্বর। তবে সাহিত্যের প্রথাগত প্রকরণ নয় বরং কবিতা সৃজন বিবেচনায় আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের সমগ্র কবিতাকে আমরা আরো বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমনÑ
(ক) প্রেমমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ২০টি। (১) সুখময় প্লাবন (২) অতৃপ্ত বেদন (৩) কাছে আছো (৪) দূরত্ব (৫) পুষ্পমালবিকা (৬) হাসি (৭) মল্লিকা ফুল (৮) জল ডুবুরি (৯) সুদূরিকা (১০) নিদহীন হিয়া (১১) অবেলায় (১২) সারথি (১৩) মায়াবতী (১৪) মিছে বেঁধোনা (১৫) ইচ্ছে জাগে (১৬) অতঃপর কাছে (১৭) দরোজায় কতদিন পর (১৮) বেলাজ হাত (১৯) প্রতীক্ষার শেষ দরোজায় (২০) পরশ পাথর।
(খ) বিরহমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৭টি। (১) অনাঘ্রাত সুখ (২) আজন্ম পিয়াস (৩) অনুক্ত (৪) নয়ন জলধি (৫) শূন্য মরুভূমি (৬) পাথর চোখ (৭) পিছুটান।
(গ) স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিক কবিতা: এর সংখ্যা ৪টি। (১) সীমান্তের ওপারে (২) যখন চলে যাবো (৩) নীরব দহন (৪) হারিয়ে যাবো।
(ঘ) নিসর্গপ্রীতিমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৩টি। (১) কাজল মেয়ে (২) শীতের বারতা (৩) তোমাকে আসতে হবে।
(ঙ) আশায় বসতিমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৯টি। (১) তন্দ্রাচ্ছন্ন ফুল (২) চেতনার দ্বিপ্রহর (৩) ঝিলমিল (৪) নীরব ব্যাকুলতা (৫) আলোয় আলোয় (৬) স্বপ্ন ফানুস (৭) অলৌকিক উত্তাপ (৮) আমি চলে গেলে (৯) পালকি।
(চ) যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনামূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৭টি। (১) ঝুলে থাকা জীবন (২) রাত আর দুঃখের মিছিল (৩) এই তো জীবন (৪) ধূসর ফুল (৫) আলিঙ্গনের নেশায় (৬) চেতনার বাঁশি (৭) দীপালি জ্বলুক।
(ছ) অসা¤প্রদায়িক চেতনামূলক কবিতা: ১টি। (১) সাম্যের জয়ভেরি।
(জ) স্বদেশপ্রেমমূলক কবিতা: ১টি। (১) কোথায় হারায়।
(ঝ) প্রশান্ত আত্মার কৃতজ্ঞতামূলক কবিতা: ২টি। (১) ভোরের লাহান (২) ঝরে শুধু তলহীন জল।
(ঞ) প্রয়াণ চিন্তা বিষয়ক কবিতা: ২টি। (১) পড়ন্ত বিকেলের ভাবনা (২) শেষ যাত্রা।
আমরা এখন উপরিউক্ত প্রকরণের আলোকে গ্রন্থের চুম্বক কবিতাগুলো আলোচনার প্রয়াস পাবো।
(ক) প্রেম চিরন্তন। প্রেমের কোন মেয়াদ উত্তীর্ণতা থাকেনা। প্রেম বয়সের ব্যবধান মানে না। তাই কবিকুল প্রেম নিয়ে নিজের সাহিত্য সম্ভার পূর্ণ করতে সচেষ্ট হন। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও এর থেকে মুক্ত নন। তাই “বেলাজ হাত” কবিতায় আমরা কবিকে নিজের অনুভবে প্রেমের উত্তাপে হৎপিÐের সবটুকু সুখ খোঁজতে ব্যস্ত হতে দেখি। কবি বলেনÑ
অন্ধকারে তোমাকে দেখি মেঘহীন আকাশের মতো
বেলাজ হাত উন্মুক্ত ওষ্ঠাধর খুঁজে খুঁজে ফিরে
অসম্ভব লোভাতুর যুথী কামিনীর পালক সায়রে
নেশাময় মাতাল অধীর ব্যাকুলতায় নিদজাগা রাত
শুধু খোঁজে, শুধু খোঁজে হৃদপিন্ডের সবটুকু সুখ এখানে সুন্দর সবটুকু সুন্দর যতটুকু পিপাসার্তময়। [বেলাজ হাত]
প্রেমের বাঁধন কিন্তু তাসের ঘর নয়- এ অনুভূতিকে বুকে ধারণ করে কবি প্রতীক্ষায় থাকেন প্রিয়জনকে কাছে পেতে। তাই তিনি প্রেমের মাহাত্ম্যকে চির অটুট রাখার জন্য দয়িতাকে আহŸান জানান প্রেমের মিছে খেলাঘর না বাঁধতেÑ
ছলছল আঁখিতে যতই তৃষ্ণা ঢালো
বুঝে নিও আমি এখন অন্য গ্রহের আলো
অনুরাগের পানসি চড়ে স্রোতময় ধারায়
উজানভাটির টানে চলে গেছি দূর অজানায়
এখন যত ফেল জল সব দূরাশা
দূরের আকাশে আমি অনুজ্জ্বল ভালোবাসা
যতই কেঁদে কেঁদে ফেলো আঁখিজল
তোমার আমার মধ্যখানে আছে শুধু ছল
প্রতীক্ষার প্রহর ফুরিয়ে গেছে ধু ধু বালুচর
শূন্য মরুর বুকে মিছে বেঁধোনা খেলাঘর। [মিছে বেঁধো না]
কবি তার নিজের অনুভূতিকে এরূপ ব্যক্ত করেছেন ‘প্রেম বিষয়ক’ অন্যান্য কবিতাগুলোয়।
(খ) মানুষের মাঝে প্রেম-ভালোবাসা আছে বলেই অনেক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় বিরহের। এ রকম বিরহের মাঝেও কবি বাঁচতে চান স্বকীয় সত্তায়। কারণ পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক হৃদয় বিরহকে ধারণ করে সুখের আবাস গড়তে চেয়েছেন যুগ থেকে যুগান্তরে। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। তৃপ্তির ঢেকুরেও সবকিছু না পাওয়ার বেদনায় কবি কখনো কখনো উন্মনা হন। সে ভাবটুকু ধরা দেয় কবির ‘অনাঘ্রাত সুখ’ কবিতায় এভাবে-
হয়তো বেলাজ হাতখানি খুলবে বেষ্টনির সবটুকু গিট
অধরা জবায় জাগবে প্রাণের অমিয় প্লাবন
নিষিদ্ধ লোবানের ঘ্রাণে ভেসে যাবে অপেক্ষমান রাত
জেগে উঠবে বৈশাখি ঝড় লোমশ শরীরে
পুবাকাশে তারাটি অস্ত যাবে পশ্চিম দিগন্তে
অচলায়তন দেহ পড়ে রবে এলোমেলো সীমানায়
নিশ্বাসে জাগবে ক্ষীণ হাওয়ার ক্লান্ত উদাস
শুধু অগোছালো পড়ে থাকবে নিদজাগা চোখ। [অনাঘ্রাত সুখ]
ভালোবাসা পাওয়া মানুষের চিরায়ত একটি আরাধ্য বিষয়। কিন্তু মানুষ কখনো তা পায় আবার কখনো পায় না। যখন পায় না তখন না পাওয়ার বেদনায় হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটে অবিরত। এ ক্ষরণ ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝে না। তখন প্রেমিক হৃদয়ে হাহাকার উঠে মুহূর্তের মধ্যে। সে হয়ে পড়ে আনমনা। কখনো বাউল হয়ে হৃদয়ের সে ব্যথা প্রশমনের চেষ্টা করে। সে রকম একটি ভাব আমরা দেখি আলোচ্য কবির ‘অনুক্ত’ কবিতায়Ñ
বুকের মাঝে ধুপশিখা জ্বলে দুজনার হয়নি তো বলা অস্ফুট স্বরে ‘ভালোবাসি’ অন্তহীন দহন জ্বলে বুকের ঝালর বেদনার অতৃপ্ততার নিশিরাত থাকে শুধু বারোমাসি।
কবি আরো বলেনÑ কৌত‚হলী মনে জেগেছিল অযুত প্রশ্নের কুঞ্জ বালিকা বালিকা হলো না ষোড়শী, শুধু নীরব-নয়নে চেয়ে থাকা সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়, নেকাবে জড়ায় অকথিত কথা নিশ্বাসের সাথে নিশ্বাস লাগে তবু কথা হয়না সাবালিকা। [অতৃপ্ত বেদন]
রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, “ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়াÑ পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।” [বাঁশি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাব্যগ্রন্থ- পুনশ্চ] আলোচ্য কবিতায়ও কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী কাক্সিক্ষত প্রিয়জনকে না পাওয়ার বেদনায় স্বগত প্রকাশ করেছেনÑ “অতৃপ্তির দহনে জ্বলি দুজনে, মিছে ডাকি ভালো থেকো সজনি।” [অতৃপ্ত বেদন]
(চলবে)

অনাঘ্রাত সুখ, আজন্ম পিয়াস, নয়ন জলধি, শূন্য মরুভূমি, পিছুটান- এসব কবিতায় কবির বিরহপ্রিয়তা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।
(গ) প্রেম-ভালোবাসা মানুষের কাছে পরম আরাধ্য ও বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান বিষয়। এর থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে কেউ। আবার বয়োবৃদ্ধির কারণে অতীতের স্নেহ-ভালোবাসা ও ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি মানুষের এক প্রকার স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিক ভাব জন্ম নেয়। তাই উভয় কারণে ভাবুক মন পুরনো দিনের সুখ-দুঃখের অনুভূতির সাগরে সাঁতরে বেড়ায়। এ ক্ষেত্রে কবিরা একটু বেশি আগুয়ান। তখন তারা স্বীয় অনুভূতিগুলোকে কালো অক্ষরের বুননে কবিতা নামক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। আলোচ্য কবির ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থেও আমরা সে রকম কিছু কথামালার সন্ধান পাইÑ যেগুলোকে আমরা স্মৃতির তাড়নায় কাক্সিক্ষত চেতনা-বিলাস হিসেবে চিহ্নিহ্নত করতে পারি। যেমনÑ
যখন চলে যাবো চিরতরে
তুমি কি দেখবে আমার কবিতার খাতা?
কখনো যদি মনে পড়ে
মনে পড়ে যায় পুরানো স্মৃতি
পিদিমজ্বলা আলোতে
খুলে দেখো আমার পান্ডুলিপি
হয়তো তোমার আমার অসমাপ্ত
কথাকলি খুঁজে পাবে সেখানে [যখন চলে যাবো]
আলোচ্য কবি বারংবার নস্টালজিয়ায় ভুগেন। ফেলে আসা দিনগুলো কবিকে পিছু ডাকে। ভাবনায় কুঠার আঘাতে তখন বিচ্ছুরিত হয় ‘মাতামুহুরী-সুত’ কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর স্মৃতির তর্পণ-
আমি হারিয়ে যাবো মাতামুহুরির বুকে
যেখানে অগণন তারুণ্যদীপ্ত স্মৃতির পাপিয়া
ডুবসাঁতার খেলাঘরে নোঙর ফেলেছিলো
হারানো স্মৃতি কুড়িয়ে কুড়িয়ে আবার
চলে যাবো ষোড়শের কোটায়
জীবনের মাঝ বয়সী সময়
হরদম পিছুটানে দুরন্তপনায়
*** *** *** ***
শরীরে যদিও ভাটার টান
মন এখনও তেজোময় বুনো উদ্দাম। [হারিয়ে যাবো]
(ঘ) এ কাবগ্রন্থে আমরা কবির নিসর্গপ্রীতিরও সন্ধান পাই। কবিদেরকে যদি ‘নিসর্গ-সন্তান’ বলা হয়, তাহলে অত্যুক্তি হবেনা বোধ হয়। নিসর্গ কবিকে কবিতা লেখার প্রেরণা যোগায় দারুন ভাবে। কাব্য জগতে তাই নিসর্গ বর্ণনার ছড়াছড়ি। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও তাঁর প্রিয়জনকে নিসর্গের স্বাদ গ্রহণের আহŸান জানান এভাবেÑ
তোমাকে আসতে হবে একবার
অজস্র নরম ঘাসফুলের দেশে
হরিদ্রাভ গালিচা বিছানো
থাকবে তোমার আতিথেয়তায়
তুমি হেঁটে যাবে অজস্রবার
শুয়ে শুয়ে দেখবে রুপোলি
চাঁদের খেলা মেঘের ফাঁকে। [তোমাকে আসতে হবে]
এ কবিতায় কবি তার প্রিয়জনকে শ্রাবণ-আকাশের বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনাতে চান, আবীর রঙের আকাশ কীভাবে সাগরে ডুবে যায় তা দেখাতে চান, বাউলি সুরের বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ শুঁকাতে চান, শিশিরের চাঁদোয়ার ভেতর পথকলিরা কীভাবে শীতের তীব্রতা সরায় তা দেখাতে চান এবং রাতের নিস্তব্ধতায় ডাহুকের ডাক কৃষ্ণের বাঁশির মতো কীভাবে পড়শিদের ঘুম ভাঙায় তাও দেখাতে চান। ‘কাজল মেয়ে’ এবং ‘শীতের বারতা’ কবিতা দুটিও নিসর্গপ্রীতিতে ভরপুর।
(ঙ) মানুষ বেঁচে থাকে আশার বাস্তবায়ন নেশায়। যে স্বপ্ন সে দেখে একদিন সে স্বপ্নের বাস্তবায়নই হয় তার ব্রত। আশায় আশায় দিন গুণে বাকি জীবন কাটায়। এভাবেই মানুষ আশায় বসত করে। কবি এ ভাবনাকে তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেÑ
হঠাৎ চেতনার দ্বিপ্রহরে জেগে ওঠে দ্রোহের ঝড়
দুঃখময় গ্লানিতে নেমে আসে শারদীয় পূর্ণিমা
প্রশান্তির অশ্রুতে ডুবে যায় গ্লানিকর খড়
স্বপ্ন আলিঙ্গনে উড়বে শান্তির তেজোময় নীলিমা [চেতনার দ্বিপ্রহর]
‘অলৌকিক উত্তাপ’ এ গ্রন্থের নাম কবিতা। এ কবিতায় এক অশান্ত কবির লকারে সাহিত্য-রসের অলৌকিক উত্তাপ রয়েছে জমাটবাঁধা তিনি পথকলিকে সে উত্তাপ গ্রহণে আহব্বান জানান- যারা তথাকথিত ভদ্র সমাজে অনাঘ্রাত, অবহেলিত এক দঙ্গল মানব সন্তান। তাদেরকে তিনি আহব্বান জানান, তারা যেন খালি গায়ে মেঠো আলপথ ভেঙে কবির আহব্বানে সাড়া দেয়। প্রসঙ্গত কবি সুকান্ত যেমন তীব্র শীতে অসহায় মানব শিশুকে উষ্ণ করার জন্য শক্তির আধার সূর্যকে ওম দেওয়ার জন্য আহব্বান জানান, ঠিক তেমনি আলোচ্য কবিও সে রকম আহব্বান জানাচ্ছেন। সুকান্ত যখন বলেনÑ “হে সূর্য / তুমি আমাদের উত্তাপ দিও/ শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড/ তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে/ একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই/ এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডে পরিণত হব/ তারপর সেই উত্তাপে পুড়বে আমাদের জড়তা/ তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো/ রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে/ আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।” (প্রার্থী, সুকান্ত ভট্টাচার্য্য, কাব্যগ্রন্থ- ছাড়পত্র) আলোচ্য কাব্যগ্রন্থেও কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী সে রকম আহŸান জানাচ্ছেন পথশিশুকে সূর্যের উত্তাপ গ্রহণ করার জন্য। কারণ নির্দিষ্ট উত্তাপহীনতায় মানুষ বাঁচতে পারে না। নিঃসঙ্গ কবি মনে করেন, পথকলির উত্তাপহীন জীবন যেন নিবু নিবু ও নি®প্রাণ। কবিতার শেষে কবি কামনা করেন ঐসব ব্রাত্যজন যেন অসীম উত্তাপ তথা প্রাণশক্তি গ্রহণ করে শক্তির আধার সূর্য থেকে। কবি হয়তো তার জীবনে প্রত্যাশিত প্রাণশক্তি গ্রহণ করতে পারেন নি। তাই অনাগত পথকলিকে সে শক্তি গ্রহণ করার উদাত্ত আহŸান জানাচ্ছেন। কবিগুরুর ভাষায় বলতে গেলেÑ ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি/ এসো কবি অখ্যাতজনের/ নির্বাক মনের/ মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার *** *** *** *** অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি/ তাই তুমি দাও তো উদবারি/ সাহিত্যের ঐকতান সংগীত সভায়।” [ঐকতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাব্যগ্রন্থ- জন্মদিনে] ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থে কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও যেন তা-ই বলতে চেয়েছেন।
কবি বলেন-
উত্তাপের উৎসবে তোমাদের আমন্ত্রণ
এসো মেঠো-আল ভেঙে উদোম শরীরে
নকশিকাঁথার ওম ফেলে অধরা জীবন
এসো একচিলতে উষ্ণতার দ্বিপ্রহরে
হে পথকলি রাতের হিমশীতল সায়রে
কখনো উঠে যদি অলৌকিক উত্তাপের ঢেউ
নিশ্চয় জেনো কোনো এক অশান্ত কবির লকারে
জমাট আশিস ঝরে পড়েছে অঝোর ধারায়
পথকলিহীন উত্তাপ উৎসব নিষ্পাণ নিষ্প্রভ
এইটুকু মানি নিঃসঙ্গ একাকিত্বের প্রহরে
তোমরা পারো তো উত্তাপ নিও সীমাহীন
উষ্ণতার আধার দানবীর সূর্যের বিলায়িত রশ্মি হতে। [অলৌকিক উত্তাপ]
কবি এভাবে তার সৃজিত তন্দ্রাচ্ছন্ন ফুল, ঝিলমিল, নীরব ব্যাকুলতা, আলোয় আলোয় এবং স্বপ্ন ফানুস কবিতাগুলোতে আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে উদাত্ত আহব্বান জানান।
(চ) যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনামূলক কবিতাগুলোতে কবির হৃদয় ছেঁড়া কথাগুলো বর্ণিত হয়েছে অত্যন্ত বর্ণিলভাবে। সুখে-দুঃখে মানুষের জীবন গড়া। সুখে মানুষেরা উদ্বেলিত হলেও দুঃখকে সহজে কেউ মেনে নিতে চায় না। কিন্তু তবু মানুষের জীবনে দুঃখ নেমে আসে, চরম আঁধার ঘিরে ধরে। তাই এর থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ মরিয়া হয়ে ছুটে। যাপিত জীবনে দুঃখ নিবারণে কবি লেখেনÑ
দুঃখের মিছিলে সঙ্গী হয় নিঃসঙ্গ রাত
ফিরে ফিরে আসে ভোর
হেঁটে যায় ত্রস্ত গতিতে
দুঃখ থাকে আজন্ম তিয়াসে
*** *** *** ***
আলোর মিছিল সদর্পে এসো
রাঙা করো আঁধারের শামিয়ানা
দুঃখে দুঃখে নিঃশেষ যেজন
সেজনে করো আকণ্ঠ অবগাহন। [রাত আর দুঃখের মিছিল]
কবি যাপিত জীবনে বিচিত্র উপলব্ধির অনুভব প্রকাশে বলেনÑ
দৌড় ঝাঁপ দিতে দিতে
এখন বিকেল
এই তো শুরু হয়েছিলো
রাঙা ভোর
এভাবেই বুঝি পার হয়
পার হয়ে যায়
পথিকের খেলাঘর। [এই তো জীবন]
(ছ) আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে কবি বিচিত্র বিষয়ে কবিতা লিখলেও অসাম্প্রদায়িকতার আবাহনেও লিখেছেন একটি কবিতা। সেখানে ফুটে উঠেছে আমাদের দেশের আবহমান অসাম্প্রদায়িক চিত্র। বহু ধর্ম ও বর্ণের লোক বাংলাদেশে বসবাস করলেও তাদের পরস্পরের মধ্যে রয়েছে বিনি সুতোর অসা¤প্রদায়িক চেতনাবোধ। এ বোধের কারণেই আবহমানকাল থেকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে এক ধর্ম-সহিষ্ণু ও অসা¤প্রদায়িক দেশ হিসেবে। আলোচ্য কবি এ বোধে উজ্জীবিত হয়ে লেখেনÑ
ঝরে যাক ঘুনে ধরা বিস্তীর্ণ পলেস্তারা
ফুটুক জুঁই চামেলি হরিৎ বুস্তান
ভোরের আলোয় বাজুক সনাতনি উলুধরা
আযানের মধুর সুরে সমতার জয়স্থান
*** *** *** *** ***
নতুন সূর্য হাসুক প্রতিদিন হররোজ
মানুষের মাঝে আসুক সাম্যের জয়গান
ভূপৃষ্ঠে নামুক স্বর্ণালি কোনো উৎসব ভোজ
নামুক শ্রাবণ ভিজুক সব মতাবলম্বী ধর্মপ্রাণ। [সাম্যের জয়ভেরি]
(জ) বহুরূপী রূপসী বাংলা তার রূপ কোথায় হারায়Ñ সে জিজ্ঞাসা কবির নিপুণ শব্দশিল্পে ভেসে উঠেছে এ কাব্যগ্রন্থে। ষড়ঋতুর এ প্রিয় বাংলাদেশ কালের আবর্তনে নানান রূপ ধারণ করে আমাদের সামনে ধরা দেয়। এ দেশের নৈসর্গিক রূপ বদল সত্যি অপূর্ব। কবি তখন তার কবিতায় লেখেন-
যে পাখি ধরেছিল গান ভোরের বাতাসে
যে ভোর ফুটেছিল আঁধারের নেকাব খুলি
চপল পায়ে লেগে আছে শিশিরের ঘাম
অজস্র ফুলঝরা যে পথ চলে গেছে বহুদূর
সে কনকঝরা ভোর হারায় কোন সুদূরে
কোন সুদূরে পথিক?
কবির আরো জিজ্ঞাস্য- দুপুর সরোবরে ডানা মেলা রাজহাঁস, কাশফুলের এলোচুলে নৈসর্গিক তট, হলুদিয়া দুপুরে রাখালের বাঁশির সুরের তন্মময়তা, বোশেখ দুপুরে আমকুড়ানো দস্যি ছেলের উচাটন, নীড়ফেরা পাখির ডানার ঝাপটা প্রভৃতি এক সময় কোথায় হারায়, কোন সুদূরে হারিয়ে যায়? কবি অনুভব করেন, রাতের আবর্তনে দিনের কোলাহল নিভে গেলে দুটি হিয়ার নিবিড় বন্ধনে ঘুমের ওম নেমে আসে। তখন কালের হেরেমে ওড়ে যায় স্বর্ণালি সংলাপ। তাই কবির ব্যাকুল জিজ্ঞাসা এসব কোথায় হারায়? কোন সুদূরে যায় চলে?
(ঝ) শুদ্ধতার আকাক্সক্ষায় কৃতজ্ঞ আত্মার সুরের অনুরণন শুনা যায় আলোচ্য কবির কবিতায়। কলুষিত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মানুষ নানা কৌশল অবলম্বন করে। কেউ গুহায় বসে ধ্যান করে, আর কেউ বাউল বেশে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। নির্বাণ লাভের আশায় অনেকে আবার বিভিন্ন সাধনায় নিমগ্ন হয়। এমনিতরো পরিবেশে কবি আমাদের শুনান বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতার শুচি বাণীÑ
অন্ধকার কেটে যাক ভোরের লাহান জোসনা ফুটুক
নৈঃশব্দ্যের ভেতর ফুটুক কুটুম পাখির শব্দাবলি
*** *** *** *** ***
যে ভোরে ডেকেছিল নিশিডাকা পাখি
তারও ঋণ আছে এই ঝলমলো দুপুর বেলায়
ঋণী করেছো ভোরের পাখি ভোরের মোয়াজ্জিন
তোমার কাছে আজন্ম কৃতজ্ঞ পদাংক পূর্বসুরী। [ভোরের লাহান]
নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনায় বিধাতার কাছে আত্ম-নিবেদন করা পৃথিবীর মহাপুরুষদের একটি নৈমিত্তিক ব্রত। এ রকম আত্ম-নিবেদনের ফলে মহাত্মারা হন আরো পরিশুদ্ধ। পাপ-পঙ্কিলতায় ভরা নশ্বর পৃথিবীতে মানুষও স্বভাবতই কলুষিত হয়ে পড়ে। তখন মহাত্মাদের দেখানো পথে পরিচালিত হয়ে নিজেরা হয়ে উঠেন একজন পুণ্যাত্মা। এর জন্য প্রয়োজন স্বীয় মানবীয় দুর্বলতা স্বীকার করে বিধাতার কাছে আত্মসমর্পণের। তারই চমৎকার নমুনা পাই আলোচ্য কবির নিচের কবিতায়Ñ
কোলাহল থেমে গেলে নেমে আসে
নিস্তব্ধ নীরবতা, একাকী কোনো ঋষির
মতো ধ্যানমগ্ন হই পারলৌকিক বন্ধনে
এতো বিপুল পরিধির মাঝে যিনি নিপুণ
চালকের আসনে সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে রত
তাঁর দিকে নতজানু হয়ে আসে উন্নত শির
বেভোলা অন্তরে জাগে অনুশোচনার তাপদাহ
উন্নত শির আরো নত হয় তারই মহিমা প্রত্যাশায়
অঝোর শ্রাবণের মতো চোখ বেয়ে নেমে আসে
অন্তঃসলিলা শ্রাবণের ধারা, হিমাদ্রির মতো
ঋজু থাকি দেহে আর মনে-
যাপিত জীবনের অযুত প্রাণের ভান্ডার খরস্রোতা
নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার জন্য মশগুলে রত
দুচোখ বেয়ে চলে তলহীন জল। [ঝরে শুধু তলহীন জল]
(ঞ) প্রয়াণ চিন্তায় অচেনা-লোকে চেনা জগতের সাদৃশ্য ভাবনায় কবি বিভোর। মহাকালের অমোঘ নিয়মে পৃথিবীর সকল প্রাণী একদিন বিলীন হয়ে যাবে। কবি-সত্তাও একদিন এর মুখোমুখী হবেন। চলে যাবেন পরপারে। কিন্তু সে অনিবার্য-লোকে কবি কি চেনা জগতের সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন? এ দ্বিধা ও সংশয়ে কবিচিত্ত সদা কম্পিত। কবির ঠিকুজি পাঠে আমরা জানতে পারি তিনি এখন বার্ধক্য অতিক্রম করছেন। তাই এ বয়সে পরপারের চিন্তা আসা স্বাভাবিক। সে প্রয়াণ চিন্তারই শৈল্পিক প্রয়াস এ কবিতাখানিÑ
গন্তব্য একটাই চলে যাবো অতঃপর
অন্ধকারের ডানায় করে ভর
সীমাহীন কোনো মৃত্তিকাগুহায়
ওখানে কি হবে ভোর?
গাইবে কি গান ভোরের বাতাসে
রকমারি পাখি?
উঠিবে কি আকাশদরিয়ায় নক্ষত্রপুঞ্জ?
চাঁদটি কি হাসিবে আমার ছোট্ট নানুটির মতো?
[পড়ন্ত বিকেলের ভাবনা]
এ কবিতায় কবি চেনা জগতের অনেক সাদৃশ্য কল্পনা করেছেন। তাঁর জিজ্ঞাস্য, পরজগতে কি ভোরের হাওয়ায় মেঠোপথে অজস্র ফুল ঝরে পড়বে? কাশফুল কি ঘুঙুর পায়ে নাচবে? ঝর্ণার কলগান, ফুলের মৌ মৌ গন্ধ কি সেখানে পাওয়া যাবে? মুয়াজ্জিনের আযানে কি ভোরের ঘুম ভাঙবে? কবিতার বই কি এলোমেলো পড়ে থাকবে শয্যায়? তাই কবি বলেন, “কী বিচিত্র হিসেব! বিচিত্র ভাবনা!! এই পড়ন্ত বিকেলে।”
মহাপ্রস্থানের প্রস্তুতি অনুভব করে কবি তার আরেক কবিতায় লিখেন-
দূরে সরে যায় বিকেলের আলো
নীড়ে ফিরে পাখি
চারদিকে বিষণ্ণতার সুরলহরি
আঁধার নেমে আসছে ক্রমাগত
দূরের আকাশে ক্ষীয়মান দৃশ্যাবলি
পাহাড় দিগন্ত নদীতট
ধুসর থেকে ধুসরতায় ক্ষীণ
রেখায় অস্পষ্ট কালো নেকাব
আঁধারে হারিয়ে যায় সবকিছু
আঁধারে হারায় সব কোলাহল
তারপর নিথর শূন্যতায় অবগাহন। [শেষ যাত্রা]
‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে প্রকাশকের মূল্যায়নটি পাঠকের উদ্দেশ্যে এখানে উল্লেখের দাবি রাখে বলে মনে করি। প্রকাশক বলেন, “শিক্ষকতার পাশাপাশি কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী লেখালিখির জগতে আছেন প্রলম্বিত সময় ধরে। তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ বেশ সাড়াজাগানিয়া। বিশেষ করে তাঁর কবিতারা। অলৌকিক উত্তাপ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বেশ প্রশংসার্হ। তাঁর কবিতা শুদ্ধতার উত্তাপ ছড়ায়। অলৌকিকতার পবিত্রতর সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। সুখ-দুঃখের ঘন বর্ষণ ছোঁয়া যায়। প্রকৃতই সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই প্রেম নবরূপে, নতুনতর হয়ে ফিরে আসে। কস্মিনেও পুরনো হয়না, সব সময়ই বর্তমান থাকে। কালিক-পরও প্রেম চিরনতুন চিরসবুজ। জগতে যত মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার কোনোটিই প্রেমবর্জিত নয়। কবিতা তো আরও উচ্চমান সাহিত্য। কবি চৌধুরীর প্রেম নিয়ে এমনই শুদ্ধতম উষ্ণতা-দহন আমাদেরকে পবিত্র করে; সেই সঙ্গে শুদ্ধতায় অবগাহন করায়। তাঁর কবিতার বয়ান-বর্ণন বর্ণিল, অনবদ্য ও সুখপাঠ্য নিঃসন্দেহে। সৃজনশীল শিল্পী-কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর হাত ধরে শুদ্ধতম প্রেমের এমনতরো আখ্যান আরো রচিত হোক। কবির প্রতি অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।”
প্রকাশকের মূল্যায়নের সাথে শ্রদ্ধা রেখে এ কাব্য গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু উৎসুক দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। কবি চৌধুরী তাঁর ‘সারথি’ কবিতায় লিখেছেন, “চাঁদেরও কলঙ্ক আছে নহে চাঁদ ঘৃণার পাত্র”Ñ সে আলোকে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ সম্বন্ধে বলতে চাই- ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর শৈল্পিক মনস্তাপের একটি কাব্যগ্রন্থ। এখানে কবির যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ এবং সর্বশেষ মৃত্যু ভাবনার জীবনালেখ্য খোঁজে পাওয়া যায়। তিনি এ গ্রন্থে সব কবিতা গদ্য ছন্দে লেখার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর শব্দ চয়ন, শব্দ গ্রন্থনা এবং পঙক্তি যোজনায় মুন্সিয়ানার ছাপ লক্ষ করা যায়। শব্দের কোমল রূপ গ্রহণ করে কবি তাঁর কবিতাগুলোকে সাধারণ পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। তবে বিভিন্ন কবিতায় কবি একই শব্দ বার বার ব্যবহার না করলেও পারতেন। তাছাড়া কবির কবিতাগুলোতে একটি আলো-আধাঁরি ভাব লক্ষণীয়। প্রত্যেক কবিতার শেষে কবিতার রচনাকাল লিপিবদ্ধ থাকায় আমরা জানতে পারি, কবি তাঁর কবিতাগুলো লিখেছেন ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। সাহিত্য যদি ‘সমাজের দর্পণ’ হয়, তাহলে বলতে হয়, কবির এ গ্রন্থভুক্ত কবিতা লেখার-সমকালকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি। তবে কি কবিরা ‘কাল নিরপেক্ষ?’ অথচ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আমার গোপন দহন”-এ সমকালীন সমাজ-বাস্তবতার আলোকে রচিত বেশ কিছু কবিতা আমরা দেখতে পাই। তাছাড়া ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থে কবিকে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে ঘুরপাক খেতে দেখা যায়। এতে কবির নতুনত্ব তেমন ধরা পড়ে না। অনেকটা গতানুগতিক পথেই কবি হেঁটেছেন বলে মনে হয়। তবু আমরা কবির যাবতীয় অপূর্ণতা দূর করে ভবিষ্যতে আরো সুন্দর সুন্দর সাহিত্য সম্ভার তাঁর কাছ থেকে পাওয়ার আশা রাখি। সাথে সাথে ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থের বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি। কবির প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও অফুরন্ত শুভেচ্ছা।

মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন

“শরীরে যদিও ভাটার টান/ মন এখনও তেজোময় বুনো উদ্দাম”- দৃঢ়চেতা এ উক্তিটি করেছেন কবিতার জন্য ২০১৯ সালে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিবার (বাসাসপ), ঢাকা কর্তৃক পুরস্কার প্রাপ্ত মননশীল কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর। উক্তিটি তিনি করেছেন তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “অলৌকিক উত্তাপ”-এর ‘হারিয়ে যাবো’ শিরোনামের কবিতায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন- “বার্ধক্যকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। …. …. …. …. আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি- যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই।” (যৌবনের গান, কাজী নজরুল ইসলাম) কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বেলায়ও বিদ্রোহী কবির অমর উক্তিটি প্রযোজ্য। কারণ যাপিত জীবনের বিকেল বেলায় এসে কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী একে একে সৃজন করে যাচ্ছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি সাহিত্য-সম্ভার। আজকের আলোচনা তাঁর স¤প্রতি প্রকাশিত “অলৌকিক উত্তাপ” কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে।
‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক কাজী সাইফুল হক তাঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘গলুই’ প্রকাশন, মাহমুদ কমপ্লেক্স- ২য় তলা, নজির আহমদ চৌধুরী রোড, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে। প্রথম প্রকাশ ফেব্রæয়ারি ২০২২। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪। চার রঙা আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ও একশ’ গ্রাম অফসেট কাগজে ছাপানো বোর্ড বাইন্ডিং লেমিনেশন কভার পেপার মোড়ানো বইটি বেশ চমৎকার। মূল্য ১৮০ টাকা মাত্র।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কবিকে পাঠকের কাছে পরিচিত করানো সমীচীন মনে করছি। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, পিতা: আলহাজ মাস্টার নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মাতা: আজবাহার বেগম। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কাকারা গ্রামে ৩০ জুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। বর্তমান বাসস্থান চকরিয়া পৌরসভার চিরিঙ্গা উপ-শহরের হাসপাতালপাড়ায়। শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো থেকেই সাহিত্য আর লেখালেখির দিকে প্রবল ঝোঁক। তাঁর রচিত প্রচুর গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনা করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছেন এমএ ডিগ্রি। পহরচাঁদা ফাযিল মাদরাসার বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক পদ থেকে বিগত ৩০ জুন ২০১৭ তারিখে অবসর গ্রহণের পর পুরোপুরি মগ্ন হয়েছেন লেখালেখিতে। লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। আমার গোপন দহন মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর প্রথম বই। এ গ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিবার (বাসাসপ) ঢাকা কর্তৃক সম্মাননা ২০১৯ লাভ করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশ ছোটগল্প ছোটো ছোটো দীর্ঘশ্বাস। তাঁর নতুন প্রভাত (নাটক) শিগ্গির প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
কবিরা সাধারণত সত্যনিষ্ঠ ও স্বপ্নচারী। কবিতার শরীর বুননে কবিরা হন একজন নিপুণ শব্দ-কারিগর। আলোচ্য কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও সে রকম একজন দক্ষ শব্দ-কারিগর। শব্দের বুননে তিনি কবিতাকে করে তুলেন বাক্সময় ও হ্রদয়গ্রাহী। সহজ বোধগম্যতার জন্য তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন শব্দের কোমলরূপ। এতে কবিতা পাঠে আপ্লুত হয় পাঠক হৃদয়। ৬৪ পৃষ্ঠার এ কাব্যগ্রন্থে মোট ৫৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতার ভাব, ভাষা, সৃজনপদ্ধতি ও বিষয়গত প্রকরণের দিক দিয়ে কবিতাগুলোকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। কাব্যগ্রন্থের ৯ম পৃষ্ঠা থেকে ৩৪তম পৃষ্ঠা পর্যন্ত প্রথম ভাগ এবং ৩৫তম পৃষ্ঠা থেকে ৬৪তম পৃষ্ঠা পর্যন্ত দ্বিতীয় ভাগ। উভয় বিভাগের কবিতাগুলো স্বমহিমায় ভাস্বর। তবে সাহিত্যের প্রথাগত প্রকরণ নয় বরং কবিতা সৃজন বিবেচনায় আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের সমগ্র কবিতাকে আমরা আরো বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমনÑ
(ক) প্রেমমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ২০টি। (১) সুখময় প্লাবন (২) অতৃপ্ত বেদন (৩) কাছে আছো (৪) দূরত্ব (৫) পুষ্পমালবিকা (৬) হাসি (৭) মল্লিকা ফুল (৮) জল ডুবুরি (৯) সুদূরিকা (১০) নিদহীন হিয়া (১১) অবেলায় (১২) সারথি (১৩) মায়াবতী (১৪) মিছে বেঁধোনা (১৫) ইচ্ছে জাগে (১৬) অতঃপর কাছে (১৭) দরোজায় কতদিন পর (১৮) বেলাজ হাত (১৯) প্রতীক্ষার শেষ দরোজায় (২০) পরশ পাথর।
(খ) বিরহমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৭টি। (১) অনাঘ্রাত সুখ (২) আজন্ম পিয়াস (৩) অনুক্ত (৪) নয়ন জলধি (৫) শূন্য মরুভূমি (৬) পাথর চোখ (৭) পিছুটান।
(গ) স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিক কবিতা: এর সংখ্যা ৪টি। (১) সীমান্তের ওপারে (২) যখন চলে যাবো (৩) নীরব দহন (৪) হারিয়ে যাবো।
(ঘ) নিসর্গপ্রীতিমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৩টি। (১) কাজল মেয়ে (২) শীতের বারতা (৩) তোমাকে আসতে হবে।
(ঙ) আশায় বসতিমূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৯টি। (১) তন্দ্রাচ্ছন্ন ফুল (২) চেতনার দ্বিপ্রহর (৩) ঝিলমিল (৪) নীরব ব্যাকুলতা (৫) আলোয় আলোয় (৬) স্বপ্ন ফানুস (৭) অলৌকিক উত্তাপ (৮) আমি চলে গেলে (৯) পালকি।
(চ) যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনামূলক কবিতা: এর সংখ্যা ৭টি। (১) ঝুলে থাকা জীবন (২) রাত আর দুঃখের মিছিল (৩) এই তো জীবন (৪) ধূসর ফুল (৫) আলিঙ্গনের নেশায় (৬) চেতনার বাঁশি (৭) দীপালি জ্বলুক।
(ছ) অসা¤প্রদায়িক চেতনামূলক কবিতা: ১টি। (১) সাম্যের জয়ভেরি।
(জ) স্বদেশপ্রেমমূলক কবিতা: ১টি। (১) কোথায় হারায়।
(ঝ) প্রশান্ত আত্মার কৃতজ্ঞতামূলক কবিতা: ২টি। (১) ভোরের লাহান (২) ঝরে শুধু তলহীন জল।
(ঞ) প্রয়াণ চিন্তা বিষয়ক কবিতা: ২টি। (১) পড়ন্ত বিকেলের ভাবনা (২) শেষ যাত্রা।
আমরা এখন উপরিউক্ত প্রকরণের আলোকে গ্রন্থের চুম্বক কবিতাগুলো আলোচনার প্রয়াস পাবো।
(ক) প্রেম চিরন্তন। প্রেমের কোন মেয়াদ উত্তীর্ণতা থাকেনা। প্রেম বয়সের ব্যবধান মানে না। তাই কবিকুল প্রেম নিয়ে নিজের সাহিত্য সম্ভার পূর্ণ করতে সচেষ্ট হন। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও এর থেকে মুক্ত নন। তাই “বেলাজ হাত” কবিতায় আমরা কবিকে নিজের অনুভবে প্রেমের উত্তাপে হৎপিÐের সবটুকু সুখ খোঁজতে ব্যস্ত হতে দেখি। কবি বলেনÑ
অন্ধকারে তোমাকে দেখি মেঘহীন আকাশের মতো
বেলাজ হাত উন্মুক্ত ওষ্ঠাধর খুঁজে খুঁজে ফিরে
অসম্ভব লোভাতুর যুথী কামিনীর পালক সায়রে
নেশাময় মাতাল অধীর ব্যাকুলতায় নিদজাগা রাত
শুধু খোঁজে, শুধু খোঁজে হৃদপিÐের সবটুকু সুখ এখানে সুন্দর সবটুকু সুন্দর যতটুকু পিপাসার্তময়। [বেলাজ হাত]
প্রেমের বাঁধন কিন্তু তাসের ঘর নয়Ñ এ অনুভূতিকে বুকে ধারণ করে কবি প্রতীক্ষায় থাকেন প্রিয়জনকে কাছে পেতে। তাই তিনি প্রেমের মাহাত্ম্যকে চির অটুট রাখার জন্য দয়িতাকে আহŸান জানান প্রেমের মিছে খেলাঘর না বাঁধতেÑ
ছলছল আঁখিতে যতই তৃষ্ণা ঢালো
বুঝে নিও আমি এখন অন্য গ্রহের আলো
অনুরাগের পানসি চড়ে স্রোতময় ধারায়
উজানভাটির টানে চলে গেছি দূর অজানায়
এখন যত ফেল জল সব দূরাশা
দূরের আকাশে আমি অনুজ্জ্বল ভালোবাসা
যতই কেঁদে কেঁদে ফেলো আঁখিজল
তোমার আমার মধ্যখানে আছে শুধু ছল
প্রতীক্ষার প্রহর ফুরিয়ে গেছে ধু ধু বালুচর
শূন্য মরুর বুকে মিছে বেঁধোনা খেলাঘর। [মিছে বেঁধো না]
কবি তার নিজের অনুভূতিকে এরূপ ব্যক্ত করেছেন ‘প্রেম বিষয়ক’ অন্যান্য কবিতাগুলোয়।
(খ) মানুষের মাঝে প্রেম-ভালোবাসা আছে বলেই অনেক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় বিরহের। এ রকম বিরহের মাঝেও কবি বাঁচতে চান স্বকীয় সত্তায়। কারণ পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিক হৃদয় বিরহকে ধারণ করে সুখের আবাস গড়তে চেয়েছেন যুগ থেকে যুগান্তরে। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। তৃপ্তির ঢেকুরেও সবকিছু না পাওয়ার বেদনায় কবি কখনো কখনো উন্মনা হন। সে ভাবটুকু ধরা দেয় কবির ‘অনাঘ্রাত সুখ’ কবিতায় এভাবেÑ
হয়তো বেলাজ হাতখানি খুলবে বেষ্টনির সবটুকু গিট
অধরা জবায় জাগবে প্রাণের অমিয় প্লাবন
নিষিদ্ধ লোবানের ঘ্রাণে ভেসে যাবে অপেক্ষমান রাত
জেগে উঠবে বৈশাখি ঝড় লোমশ শরীরে
পুবাকাশে তারাটি অস্ত যাবে পশ্চিম দিগন্তে
অচলায়তন দেহ পড়ে রবে এলোমেলো সীমানায়
নিশ্বাসে জাগবে ক্ষীণ হাওয়ার ক্লান্ত উদাস
শুধু অগোছালো পড়ে থাকবে নিদজাগা চোখ। [অনাঘ্রাত সুখ]
ভালোবাসা পাওয়া মানুষের চিরায়ত একটি আরাধ্য বিষয়। কিন্তু মানুষ কখনো তা পায় আবার কখনো পায় না। যখন পায় না তখন না পাওয়ার বেদনায় হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ঘটে অবিরত। এ ক্ষরণ ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝে না। তখন প্রেমিক হৃদয়ে হাহাকার উঠে মুহূর্তের মধ্যে। সে হয়ে পড়ে আনমনা। কখনো বাউল হয়ে হৃদয়ের সে ব্যথা প্রশমনের চেষ্টা করে। সে রকম একটি ভাব আমরা দেখি আলোচ্য কবির ‘অনুক্ত’ কবিতায়Ñ
বুকের মাঝে ধুপশিখা জ্বলে দুজনার হয়নি তো বলা অস্ফুট স্বরে ‘ভালোবাসি’ অন্তহীন দহন জ্বলে বুকের ঝালর বেদনার অতৃপ্ততার নিশিরাত থাকে শুধু বারোমাসি।
কবি আরো বলেনÑ কৌত‚হলী মনে জেগেছিল অযুত প্রশ্নের কুঞ্জ বালিকা বালিকা হলো না ষোড়শী, শুধু নীরব-নয়নে চেয়ে থাকা সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ায়, নেকাবে জড়ায় অকথিত কথা নিশ্বাসের সাথে নিশ্বাস লাগে তবু কথা হয়না সাবালিকা। [অতৃপ্ত বেদন]
রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, “ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়াÑ পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।” [বাঁশি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাব্যগ্রন্থ- পুনশ্চ] আলোচ্য কবিতায়ও কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী কাক্সিক্ষত প্রিয়জনকে না পাওয়ার বেদনায় স্বগত প্রকাশ করেছেনÑ “অতৃপ্তির দহনে জ্বলি দুজনে, মিছে ডাকি ভালো থেকো সজনি।” [অতৃপ্ত বেদন]
(চলবে)

অনাঘ্রাত সুখ, আজন্ম পিয়াস, নয়ন জলধি, শূন্য মরুভূমি, পিছুটানÑ এসব কবিতায় কবির বিরহপ্রিয়তা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।
(গ) প্রেম-ভালোবাসা মানুষের কাছে পরম আরাধ্য ও বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান বিষয়। এর থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে কেউ। আবার বয়োবৃদ্ধির কারণে অতীতের স্নেহ-ভালোবাসা ও ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি মানুষের এক প্রকার স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিক ভাব জন্ম নেয়। তাই উভয় কারণে ভাবুক মন পুরনো দিনের সুখ-দুঃখের অনুভূতির সাগরে সাঁতরে বেড়ায়। এ ক্ষেত্রে কবিরা একটু বেশি আগুয়ান। তখন তারা স্বীয় অনুভূতিগুলোকে কালো অক্ষরের বুননে কবিতা নামক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। আলোচ্য কবির ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থেও আমরা সে রকম কিছু কথামালার সন্ধান পাইÑ যেগুলোকে আমরা স্মৃতির তাড়নায় কাক্সিক্ষত চেতনা-বিলাস হিসেবে চিহ্নিহ্নত করতে পারি। যেমনÑ
যখন চলে যাবো চিরতরে
তুমি কি দেখবে আমার কবিতার খাতা?
কখনো যদি মনে পড়ে
মনে পড়ে যায় পুরানো স্মৃতি
পিদিমজ্বলা আলোতে
খুলে দেখো আমার পাÐুলিপি
হয়তো তোমার আমার অসমাপ্ত
কথাকলি খুঁজে পাবে সেখানে [যখন চলে যাবো]
আলোচ্য কবি বারংবার নস্টালজিয়ায় ভুগেন। ফেলে আসা দিনগুলো কবিকে পিছু ডাকে। ভাবনায় কুঠার আঘাতে তখন বিচ্ছুরিত হয় ‘মাতামুহুরী-সুত’ কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর স্মৃতির তর্পণÑ
আমি হারিয়ে যাবো মাতামুহুরির বুকে
যেখানে অগণন তারুণ্যদীপ্ত স্মৃতির পাপিয়া
ডুবসাঁতার খেলাঘরে নোঙর ফেলেছিলো
হারানো স্মৃতি কুড়িয়ে কুড়িয়ে আবার
চলে যাবো ষোড়শের কোটায়
জীবনের মাঝ বয়সী সময়
হরদম পিছুটানে দুরন্তপনায়
*** *** *** ***
শরীরে যদিও ভাটার টান
মন এখনও তেজোময় বুনো উদ্দাম। [হারিয়ে যাবো]
(ঘ) এ কাবগ্রন্থে আমরা কবির নিসর্গপ্রীতিরও সন্ধান পাই। কবিদেরকে যদি ‘নিসর্গ-সন্তান’ বলা হয়, তাহলে অত্যুক্তি হবেনা বোধ হয়। নিসর্গ কবিকে কবিতা লেখার প্রেরণা যোগায় দারুন ভাবে। কাব্য জগতে তাই নিসর্গ বর্ণনার ছড়াছড়ি। কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও তাঁর প্রিয়জনকে নিসর্গের স্বাদ গ্রহণের আহŸান জানান এভাবেÑ
তোমাকে আসতে হবে একবার
অজস্র নরম ঘাসফুলের দেশে
হরিদ্রাভ গালিচা বিছানো
থাকবে তোমার আতিথেয়তায়
তুমি হেঁটে যাবে অজস্রবার
শুয়ে শুয়ে দেখবে রুপোলি
চাঁদের খেলা মেঘের ফাঁকে। [তোমাকে আসতে হবে]
এ কবিতায় কবি তার প্রিয়জনকে শ্রাবণ-আকাশের বৃষ্টি পতনের শব্দ শুনাতে চান, আবীর রঙের আকাশ কীভাবে সাগরে ডুবে যায় তা দেখাতে চান, বাউলি সুরের বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ শুঁকাতে চান, শিশিরের চাঁদোয়ার ভেতর পথকলিরা কীভাবে শীতের তীব্রতা সরায় তা দেখাতে চান এবং রাতের নিস্তব্ধতায় ডাহুকের ডাক কৃষ্ণের বাঁশির মতো কীভাবে পড়শিদের ঘুম ভাঙায় তাও দেখাতে চান। ‘কাজল মেয়ে’ এবং ‘শীতের বারতা’ কবিতা দুটিও নিসর্গপ্রীতিতে ভরপুর।
(ঙ) মানুষ বেঁচে থাকে আশার বাস্তবায়ন নেশায়। যে স্বপ্ন সে দেখে একদিন সে স্বপ্নের বাস্তবায়নই হয় তার ব্রত। আশায় আশায় দিন গুণে বাকি জীবন কাটায়। এভাবেই মানুষ আশায় বসত করে। কবি এ ভাবনাকে তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেÑ
হঠাৎ চেতনার দ্বিপ্রহরে জেগে ওঠে দ্রোহের ঝড়
দুঃখময় গ্লানিতে নেমে আসে শারদীয় পূর্ণিমা
প্রশান্তির অশ্রæতে ডুবে যায় গ্লানিকর খড়
স্বপ্ন আলিঙ্গনে উড়বে শান্তির তেজোময় নীলিমা [চেতনার দ্বিপ্রহর]
‘অলৌকিক উত্তাপ’ এ গ্রন্থের নাম কবিতা। এ কবিতায় এক অশান্ত কবির লকারে সাহিত্য-রসের অলৌকিক উত্তাপ রয়েছে জমাটবাঁধা তিনি পথকলিকে সে উত্তাপ গ্রহণে আহŸান জানানÑ যারা তথাকথিত ভদ্র সমাজে অনাঘ্রাত, অবহেলিত এক দঙ্গল মানব সন্তান। তাদেরকে তিনি আহŸান জানান, তারা যেন খালি গায়ে মেঠো আলপথ ভেঙে কবির আহŸানে সাড়া দেয়। প্রসঙ্গত কবি সুকান্ত যেমন তীব্র শীতে অসহায় মানব শিশুকে উষ্ণ করার জন্য শক্তির আধার সূর্যকে ওম দেওয়ার জন্য আহŸান জানান, ঠিক তেমনি আলোচ্য কবিও সে রকম আহŸান জানাচ্ছেন। সুকান্ত যখন বলেনÑ “হে সূর্য / তুমি আমাদের উত্তাপ দিও/ শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিÐ/ তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে/ একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই/ এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিÐে পরিণত হব/ তারপর সেই উত্তাপে পুড়বে আমাদের জড়তা/ তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো/ রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে/ আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।” (প্রার্থী, সুকান্ত ভট্টাচার্য্য, কাব্যগ্রন্থ- ছাড়পত্র) আলোচ্য কাব্যগ্রন্থেও কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী সে রকম আহŸান জানাচ্ছেন পথশিশুকে সূর্যের উত্তাপ গ্রহণ করার জন্য। কারণ নির্দিষ্ট উত্তাপহীনতায় মানুষ বাঁচতে পারে না। নিঃসঙ্গ কবি মনে করেন, পথকলির উত্তাপহীন জীবন যেন নিবু নিবু ও নি®প্রাণ। কবিতার শেষে কবি কামনা করেন ঐসব ব্রাত্যজন যেন অসীম উত্তাপ তথা প্রাণশক্তি গ্রহণ করে শক্তির আধার সূর্য থেকে। কবি হয়তো তার জীবনে প্রত্যাশিত প্রাণশক্তি গ্রহণ করতে পারেন নি। তাই অনাগত পথকলিকে সে শক্তি গ্রহণ করার উদাত্ত আহŸান জানাচ্ছেন। কবিগুরুর ভাষায় বলতে গেলেÑ ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি/ এসো কবি অখ্যাতজনের/ নির্বাক মনের/ মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার *** *** *** *** অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি/ তাই তুমি দাও তো উদবারি/ সাহিত্যের ঐকতান সংগীত সভায়।” [ঐকতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাব্যগ্রন্থ- জন্মদিনে] ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থে কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীও যেন তা-ই বলতে চেয়েছেন।
কবি বলেনÑ
উত্তাপের উৎসবে তোমাদের আমন্ত্রণ
এসো মেঠো-আল ভেঙে উদোম শরীরে
নকশিকাঁথার ওম ফেলে অধরা জীবন
এসো একচিলতে উষ্ণতার দ্বিপ্রহরে
হে পথকলি রাতের হিমশীতল সায়রে
কখনো উঠে যদি অলৌকিক উত্তাপের ঢেউ
নিশ্চয় জেনো কোনো এক অশান্ত কবির লকারে
জমাট আশিস ঝরে পড়েছে অঝোর ধারায়
পথকলিহীন উত্তাপ উৎসব নি®প্রাণ নি®প্রভ
এইটুকু মানি নিঃসঙ্গ একাকিত্বের প্রহরে
তোমরা পারো তো উত্তাপ নিও সীমাহীন
উষ্ণতার আধার দানবীর সূর্যের বিলায়িত রশ্মি হতে। [অলৌকিক উত্তাপ]
কবি এভাবে তার সৃজিত তন্দ্রাচ্ছন্ন ফুল, ঝিলমিল, নীরব ব্যাকুলতা, আলোয় আলোয় এবং স্বপ্ন ফানুস কবিতাগুলোতে আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে উদাত্ত আহŸান জানান।
(চ) যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনামূলক কবিতাগুলোতে কবির হৃদয় ছেঁড়া কথাগুলো বর্ণিত হয়েছে অত্যন্ত বর্ণিলভাবে। সুখে-দুঃখে মানুষের জীবন গড়া। সুখে মানুষেরা উদ্বেলিত হলেও দুঃখকে সহজে কেউ মেনে নিতে চায় না। কিন্তু তবু মানুষের জীবনে দুঃখ নেমে আসে, চরম আঁধার ঘিরে ধরে। তাই এর থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ মরিয়া হয়ে ছুটে। যাপিত জীবনে দুঃখ নিবারণে কবি লেখেনÑ
দুঃখের মিছিলে সঙ্গী হয় নিঃসঙ্গ রাত
ফিরে ফিরে আসে ভোর
হেঁটে যায় ত্রস্ত গতিতে
দুঃখ থাকে আজন্ম তিয়াসে
*** *** *** ***
আলোর মিছিল সদর্পে এসো
রাঙা করো আঁধারের শামিয়ানা
দুঃখে দুঃখে নিঃশেষ যেজন
সেজনে করো আকণ্ঠ অবগাহন। [রাত আর দুঃখের মিছিল]
কবি যাপিত জীবনে বিচিত্র উপলব্ধির অনুভব প্রকাশে বলেনÑ
দৌড় ঝাঁপ দিতে দিতে
এখন বিকেল
এই তো শুরু হয়েছিলো
রাঙা ভোর
এভাবেই বুঝি পার হয়
পার হয়ে যায়
পথিকের খেলাঘর। [এই তো জীবন]
(ছ) আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে কবি বিচিত্র বিষয়ে কবিতা লিখলেও অসা¤প্রদায়িকতার আবাহনেও লিখেছেন একটি কবিতা। সেখানে ফুটে উঠেছে আমাদের দেশের আবহমান অসা¤প্রদায়িক চিত্র। বহু ধর্ম ও বর্ণের লোক বাংলাদেশে বসবাস করলেও তাদের পরস্পরের মধ্যে রয়েছে বিনি সুতোর অসা¤প্রদায়িক চেতনাবোধ। এ বোধের কারণেই আবহমানকাল থেকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে এক ধর্ম-সহিষ্ণু ও অসা¤প্রদায়িক দেশ হিসেবে। আলোচ্য কবি এ বোধে উজ্জীবিত হয়ে লেখেনÑ
ঝরে যাক ঘুনে ধরা বিস্তীর্ণ পলেস্তারা
ফুটুক জুঁই চামেলি হরিৎ বুস্তান
ভোরের আলোয় বাজুক সনাতনি উলুধরা
আযানের মধুর সুরে সমতার জয়স্থান
*** *** *** *** ***
নতুন সূর্য হাসুক প্রতিদিন হররোজ
মানুষের মাঝে আসুক সাম্যের জয়গান
ভূপৃষ্ঠে নামুক স্বর্ণালি কোনো উৎসব ভোজ
নামুক শ্রাবণ ভিজুক সব মতাবলম্বী ধর্মপ্রাণ। [সাম্যের জয়ভেরি]
(জ) বহুরূপী রূপসী বাংলা তার রূপ কোথায় হারায়Ñ সে জিজ্ঞাসা কবির নিপুণ শব্দশিল্পে ভেসে উঠেছে এ কাব্যগ্রন্থে। ষড়ঋতুর এ প্রিয় বাংলাদেশ কালের আবর্তনে নানান রূপ ধারণ করে আমাদের সামনে ধরা দেয়। এ দেশের নৈসর্গিক রূপ বদল সত্যি অপূর্ব। কবি তখন তার কবিতায় লেখেনÑ
যে পাখি ধরেছিল গান ভোরের বাতাসে
যে ভোর ফুটেছিল আঁধারের নেকাব খুলি
চপল পায়ে লেগে আছে শিশিরের ঘাম
অজস্র ফুলঝরা যে পথ চলে গেছে বহুদূর
সে কনকঝরা ভোর হারায় কোন সুদূরে
কোন সুদূরে পথিক?
কবির আরো জিজ্ঞাস্যÑ দুপুর সরোবরে ডানা মেলা রাজহাঁস, কাশফুলের এলোচুলে নৈসর্গিক তট, হলুদিয়া দুপুরে রাখালের বাঁশির সুরের তন্মময়তা, বোশেখ দুপুরে আমকুড়ানো দস্যি ছেলের উচাটন, নীড়ফেরা পাখির ডানার ঝাপটা প্রভৃতি এক সময় কোথায় হারায়, কোন সুদূরে হারিয়ে যায়? কবি অনুভব করেন, রাতের আবর্তনে দিনের কোলাহল নিভে গেলে দুটি হিয়ার নিবিড় বন্ধনে ঘুমের ওম নেমে আসে। তখন কালের হেরেমে ওড়ে যায় স্বর্ণালি সংলাপ। তাই কবির ব্যাকুল জিজ্ঞাসা এসব কোথায় হারায়? কোন সুদূরে যায় চলে?
(ঝ) শুদ্ধতার আকাক্সক্ষায় কৃতজ্ঞ আত্মার সুরের অনুরণন শুনা যায় আলোচ্য কবির কবিতায়। কলুষিত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মানুষ নানা কৌশল অবলম্বন করে। কেউ গুহায় বসে ধ্যান করে, আর কেউ বাউল বেশে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। নির্বাণ লাভের আশায় অনেকে আবার বিভিন্ন সাধনায় নিমগ্ন হয়। এমনিতরো পরিবেশে কবি আমাদের শুনান বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতার শুচি বাণীÑ
অন্ধকার কেটে যাক ভোরের লাহান জোসনা ফুটুক
নৈঃশব্দ্যের ভেতর ফুটুক কুটুম পাখির শব্দাবলি
*** *** *** *** ***
যে ভোরে ডেকেছিল নিশিডাকা পাখি
তারও ঋণ আছে এই ঝলমলো দুপুর বেলায়
ঋণী করেছো ভোরের পাখি ভোরের মোয়াজ্জিন
তোমার কাছে আজন্ম কৃতজ্ঞ পদাংক পূর্বসুরী। [ভোরের লাহান]
নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনায় বিধাতার কাছে আত্ম-নিবেদন করা পৃথিবীর মহাপুরুষদের একটি নৈমিত্তিক ব্রত। এ রকম আত্ম-নিবেদনের ফলে মহাত্মারা হন আরো পরিশুদ্ধ। পাপ-পঙ্কিলতায় ভরা নশ্বর পৃথিবীতে মানুষও স্বভাবতই কলুষিত হয়ে পড়ে। তখন মহাত্মাদের দেখানো পথে পরিচালিত হয়ে নিজেরা হয়ে উঠেন একজন পুণ্যাত্মা। এর জন্য প্রয়োজন স্বীয় মানবীয় দুর্বলতা স্বীকার করে বিধাতার কাছে আত্মসমর্পণের। তারই চমৎকার নমুনা পাই আলোচ্য কবির নিচের কবিতায়Ñ
কোলাহল থেমে গেলে নেমে আসে
নিস্তব্ধ নীরবতা, একাকী কোনো ঋষির
মতো ধ্যানমগ্ন হই পারলৌকিক বন্ধনে
এতো বিপুল পরিধির মাঝে যিনি নিপুণ
চালকের আসনে সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে রত
তাঁর দিকে নতজানু হয়ে আসে উন্নত শির
বেভোলা অন্তরে জাগে অনুশোচনার তাপদাহ
উন্নত শির আরো নত হয় তারই মহিমা প্রত্যাশায়
অঝোর শ্রাবণের মতো চোখ বেয়ে নেমে আসে
অন্তঃসলিলা শ্রাবণের ধারা, হিমাদ্রির মতো
ঋজু থাকি দেহে আর মনেÑ
যাপিত জীবনের অযুত প্রাণের ভাÐার খরস্রোতা
নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ার জন্য মশগুলে রত
দুচোখ বেয়ে চলে তলহীন জল। [ঝরে শুধু তলহীন জল]
(ঞ) প্রয়াণ চিন্তায় অচেনা-লোকে চেনা জগতের সাদৃশ্য ভাবনায় কবি বিভোর। মহাকালের অমোঘ নিয়মে পৃথিবীর সকল প্রাণী একদিন বিলীন হয়ে যাবে। কবি-সত্তাও একদিন এর মুখোমুখী হবেন। চলে যাবেন পরপারে। কিন্তু সে অনিবার্য-লোকে কবি কি চেনা জগতের সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন? এ দ্বিধা ও সংশয়ে কবিচিত্ত সদা কম্পিত। কবির ঠিকুজি পাঠে আমরা জানতে পারি তিনি এখন বার্ধক্য অতিক্রম করছেন। তাই এ বয়সে পরপারের চিন্তা আসা স্বাভাবিক। সে প্রয়াণ চিন্তারই শৈল্পিক প্রয়াস এ কবিতাখানিÑ
গন্তব্য একটাই চলে যাবো অতঃপর
অন্ধকারের ডানায় করে ভর
সীমাহীন কোনো মৃত্তিকাগুহায়
ওখানে কি হবে ভোর?
গাইবে কি গান ভোরের বাতাসে
রকমারি পাখি?
উঠিবে কি আকাশদরিয়ায় নক্ষত্রপুঞ্জ?
চাঁদটি কি হাসিবে আমার ছোট্ট নানুটির মতো?
[পড়ন্ত বিকেলের ভাবনা]
এ কবিতায় কবি চেনা জগতের অনেক সাদৃশ্য কল্পনা করেছেন। তাঁর জিজ্ঞাস্য, পরজগতে কি ভোরের হাওয়ায় মেঠোপথে অজস্র ফুল ঝরে পড়বে? কাশফুল কি ঘুঙুর পায়ে নাচবে? ঝর্ণার কলগান, ফুলের মৌ মৌ গন্ধ কি সেখানে পাওয়া যাবে? মুয়াজ্জিনের আযানে কি ভোরের ঘুম ভাঙবে? কবিতার বই কি এলোমেলো পড়ে থাকবে শয্যায়? তাই কবি বলেন, “কী বিচিত্র হিসেব! বিচিত্র ভাবনা!! এই পড়ন্ত বিকেলে।”
মহাপ্রস্থানের প্রস্তুতি অনুভব করে কবি তার আরেক কবিতায় লিখেনÑ
দূরে সরে যায় বিকেলের আলো
নীড়ে ফিরে পাখি
চারদিকে বিষণœতার সুরলহরি
আঁধার নেমে আসছে ক্রমাগত
দূরের আকাশে ক্ষীয়মান দৃশ্যাবলি
পাহাড় দিগন্ত নদীতট
ধুসর থেকে ধুসরতায় ক্ষীণ
রেখায় অস্পষ্ট কালো নেকাব
আঁধারে হারিয়ে যায় সবকিছু
আঁধারে হারায় সব কোলাহল
তারপর নিথর শূন্যতায় অবগাহন। [শেষ যাত্রা]
‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে প্রকাশকের মূল্যায়নটি পাঠকের উদ্দেশ্যে এখানে উল্লেখের দাবি রাখে বলে মনে করি। প্রকাশক বলেন, “শিক্ষকতার পাশাপাশি কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরী লেখালিখির জগতে আছেন প্রলম্বিত সময় ধরে। তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ বেশ সাড়াজাগানিয়া। বিশেষ করে তাঁর কবিতারা। অলৌকিক উত্তাপ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বেশ প্রশংসার্হ। তাঁর কবিতা শুদ্ধতার উত্তাপ ছড়ায়। অলৌকিকতার পবিত্রতর সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। সুখ-দুঃখের ঘন বর্ষণ ছোঁয়া যায়। প্রকৃতই সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই প্রেম নবরূপে, নতুনতর হয়ে ফিরে আসে। কস্মিনেও পুরনো হয়না, সব সময়ই বর্তমান থাকে। কালিক-পরও প্রেম চিরনতুন চিরসবুজ। জগতে যত মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার কোনোটিই প্রেমবর্জিত নয়। কবিতা তো আরও উচ্চমান সাহিত্য। কবি চৌধুরীর প্রেম নিয়ে এমনই শুদ্ধতম উষ্ণতা-দহন আমাদেরকে পবিত্র করে; সেই সঙ্গে শুদ্ধতায় অবগাহন করায়। তাঁর কবিতার বয়ান-বর্ণন বর্ণিল, অনবদ্য ও সুখপাঠ্য নিঃসন্দেহে। সৃজনশীল শিল্পী-কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর হাত ধরে শুদ্ধতম প্রেমের এমনতরো আখ্যান আরো রচিত হোক। কবির প্রতি অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।”
প্রকাশকের মূল্যায়নের সাথে শ্রদ্ধা রেখে এ কাব্য গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু উৎসুক দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। কবি চৌধুরী তাঁর ‘সারথি’ কবিতায় লিখেছেন, “চাঁদেরও কলঙ্ক আছে নহে চাঁদ ঘৃণার পাত্র”Ñ সে আলোকে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ সম্বন্ধে বলতে চাইÑ ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কবি মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর শৈল্পিক মনস্তাপের একটি কাব্যগ্রন্থ। এখানে কবির যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ এবং সর্বশেষ মৃত্যু ভাবনার জীবনালেখ্য খোঁজে পাওয়া যায়। তিনি এ গ্রন্থে সব কবিতা গদ্য ছন্দে লেখার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর শব্দ চয়ন, শব্দ গ্রন্থনা এবং পঙক্তি যোজনায় মুন্সিয়ানার ছাপ লক্ষ করা যায়। শব্দের কোমল রূপ গ্রহণ করে কবি তাঁর কবিতাগুলোকে সাধারণ পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। তবে বিভিন্ন কবিতায় কবি একই শব্দ বার বার ব্যবহার না করলেও পারতেন। তাছাড়া কবির কবিতাগুলোতে একটি আলো-আধাঁরি ভাব লক্ষণীয়। প্রত্যেক কবিতার শেষে কবিতার রচনাকাল লিপিবদ্ধ থাকায় আমরা জানতে পারি, কবি তাঁর কবিতাগুলো লিখেছেন ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। সাহিত্য যদি ‘সমাজের দর্পণ’ হয়, তাহলে বলতে হয়, কবির এ গ্রন্থভুক্ত কবিতা লেখার-সমকালকে পুরোপুরি স্পর্শ করতে পারেনি। তবে কি কবিরা ‘কাল নিরপেক্ষ?’ অথচ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আমার গোপন দহন”Ñএ সমকালীন সমাজ-বাস্তবতার আলোকে রচিত বেশ কিছু কবিতা আমরা দেখতে পাই। তাছাড়া ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থে কবিকে নির্দিষ্ট গÐির মধ্যে ঘুরপাক খেতে দেখা যায়। এতে কবির নতুনত্ব তেমন ধরা পড়ে না। অনেকটা গতানুগতিক পথেই কবি হেঁটেছেন বলে মনে হয়। তবু আমরা কবির যাবতীয় অপূর্ণতা দূর করে ভবিষ্যতে আরো সুন্দর সুন্দর সাহিত্য সম্ভার তাঁর কাছ থেকে পাওয়ার আশা রাখি। সাথে সাথে ‘অলৌকিক উত্তাপ’ কাব্যগ্রন্থের বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি। কবির প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও অফুরন্ত শুভেচ্ছা।