অর্থ আত্মসাতে সমবায় সমিতি

36

তুষার দেব

আমানত সংগ্রহ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রাপ্তির সহজ ব্যবস্থার দ্রুত বিকশিত হওয়া মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি বা সমবায় সমিতিকে একশ্রেণির লোকজন অর্থ আত্মসাতের নিরাপদ মাধ্যমে পরিণত করেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা ও মার্কেটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এ ধরনের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে গেছে। আবার নিবন্ধন ছাড়াও কোনও কোনও সমিতি গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে। এ কারণে চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা মুরাদ আহম্মেদ নিবন্ধন বাতিলের সত্যতা নিশ্চিত করে পূর্বদেশকে বলেন, এ ধরনের সমিতির কার্যক্রম পরিচালনার সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। কোনও সমিতির বিরুদ্ধে গ্রাহক অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। যেসব সমিতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, সেগুলোর গ্রাহকদের জামানত কিভাবে ফিরিয়ে দেয়া যায়, সে চেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি। ইতোমধ্যে অফিসের পক্ষ থেকে অবসায়ক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের সম্পত্তি এবং ব্যাংকের টাকা স্থানান্তর ঠেকাতে স্থানীয় ভূমি অফিস ও ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
প্রতারণার শিকার একাধিক ভুক্তভোগী জানান, বাহারি নামে শহরের অলিগলিতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সমবায় সমিতির পরিচালনা পরিষদের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের অর্থলোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি, গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ, উপযুক্ত জামানত না নিয়ে ঋণদান, নিয়ম না মেনে অধিক লাভের আশায় গ্রাহকের আমানতকৃত টাকার ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে মাল্টিপারপাস সমিতির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। অনেকেই গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকরা দীর্ঘদিনের সঞ্চিত টাকা মাল্টিপারপাসে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
জেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার কারণে ২০১৪ সালের পর থেকে অঘোষিতভাবে মাল্টিপারপাস সোসাইটির নিবন্ধন বন্ধ রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলায় তিন হাজারের অধিক নিবন্ধিত মাল্টিপারপাস থাকলেও বর্তমানে তা এক হাজারের নিচে এসে ঠেকেছে। অডিটে বিভিন্ন অনিয়ম ও গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় নিবন্ধন বাতিল হয়েছে আট শতাধিক সমিতির। চলতি অর্থ বছরের জুনের মধ্যে এ ধরণের আরও সাতশ’ সমিতির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৯টি ক্যাটাগরির আর্থিক সমিতির মধ্যে মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি (বহুমুখী সমবায় সমিতি) একটি। অন্য ২৮টি ক্যাটাগরির আর্থিক সমিতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভোগ্যপণ্য সমবায় সমিতি, সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি, কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন, কো অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, উপজেলা বা থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি, কো অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ, হকার্স সমবায় সমিতি, পরিবহন মালিক বা শ্রমিক সমবায় সমিতি, কর্মচারী সমবায় সমিতি, দুগ্ধ সমবায় সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি, যুব সমবায় সমিতি, পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি, সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি, গৃহায়ন(হাউজিং) সমবায় সমিতি, ফ্ল্যাট বা এপার্টমেন্ট মালিক সমবায় সমিতি, দোকান মালিক বা ব্যবসায়ী বা মার্কেট সমবায় সমিতি, কৃষি বা কৃষক সমবায় সমিতি, মৎস্যজীবি বা মৎস্যচাষী সমবায় সমিতি, শ্রমজীবি সমবায় সমিতি, মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতি, তাঁতী সমবায় সমিতি, ভূমিহীন সমবায় সমিতি, মহিলা সমবায় সমিতি, বিত্তহীন সমবায় সমিতি, অটোরিক্সা, অটো-টেম্পো, টেক্সি ক্যাব, মটর, ট্রাক বা ট্রাক লরী চালক সমবায় সমিতি এবং বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক প্রভৃতি। বর্তমানে জেলা সমবায় কার্যালয়ের আওতাধীন জেলার ১৪টি উপজেলা ও নগরের তিনটি সমবায় থানার মধ্যে বিভাগীয় সমবায় সমিতি রয়েছে তিন হাজার ছয়শ’ পাঁচটি। বিআরডিবিভুক্ত (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড) তিন হাজার একশ’ নয়টি। নিবন্ধনকৃত মাল্টিপারপাস আছে এক হাজার দুইশ’ ৮৮টি। গত সাত বছরে বিভিন্ন অনিয়ম ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে আটশ’ ৬৯টির নিবন্ধন বাতিল করা হয়। এর মধ্যে মাল্টিপারপাস নিবন্ধন বাতিল হয়েছে চারশ’ ১৯টি। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সমবায় দপ্তরের জোন রয়েছে তিনটি। পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও কোতোয়ালি থানাকে জোন ধরে সমবায় ও ঋণদান এবং বহুমুখী সমবায় সমিতি নিবন্ধন দেয় সমবায় কার্যালয়। এর মধ্যে ডবলমুরিং থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি তিনশ’ ৬৩টি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক লেনদেনের নিবন্ধন নিয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পাঁচলাইশ জোনে একশ’ ৭১টি এবং কোতোয়ালি জোনে একশ’ ছয়টি প্রতিষ্ঠান সমবায়ের নিবন্ধন নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মাল্টিপারপাসের নামে সবচেয়ে আলোচিত অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে নগরীর ইপিজেড এলাকায়। এলাকার রূপসা সমবায় ও ঋণদান সমিতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইপিজেড এলাকায় ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অতিমুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই এলাকার বেশকিছু গ্রাহক অর্থ ফেরত নিতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি তা দিতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত না দিয়ে কার্যালয়ে তালা দিয়ে পালিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা। একইভাবে সিইপিজেডের সামনের চৌধুরী মার্কেটে ভাড়া অফিসে কার্যক্রম শুরু করে প্রাইম স্টার। এ প্রতিষ্ঠানও হাজার হাজার গ্রাহকের কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার দুবাইয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে ইপিজেড থানা পুলিশ রূপসার চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান এবং একই মাসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে। জামিনে মুক্তি লাভের পর থেকে তারাও পলাতক রয়েছেন।