অর্থই অনর্থের মূল

14

 

পঞ্চাশ বছর আগের কথা। দেশ তোলপাড় করা বাংলা ছায়াছবি ‘ময়নামতি’র একটি গান, ‘আরে টাকা তুমি সময় মতো আইলা না’র একটি পঙক্তি ছিল ‘টাকা তুমি দেখতে গোল করো তুমি গন্ডগোল…’। গানের চরিত্রের নামটি মনে নেই, ধরি তার নাম মনা। মনা ভীষণ দরিদ্র কিন্তু কাজকাম কিছু করে না, কেবল লটারির টিকিট কেনে। ময়না ভীষণ রূপসী, মনার তাকে বিয়ে করার অতি শখ। কিন্তু গাঁয়ের জমিদার ময়নাকে বিয়ে করে ফেলেন, আর ঠিক তখনই মনা লটারিতে দুই লক্ষ টাকা পেয়ে যায়। এখন এ টাকা দিয়ে সে কি করবে? তার পাখি তো চলে গেছে পরের ঘরে, তাই মনের দুঃখে তার এ গান গাওয়া। আসলে প্রেম বড়ই আজিব এক বিষয়। পাখি উড়ে গেছে, মনার আর টাকা দরকার নাই। আবার আরেক জাতের মনা আছে যাদের পাখি দরকার নাই দরকার টাকা। কত পাখি বিক্রি করে যে তারা টাকা কামায় তার হিসাব নাই। অর্থাৎ প্রেমের অভিনয় করে মেয়ে পটিয়ে ঐসব মনারা ধান্ধা করে। সেদিন দেখলাম হাফ ভাড়া নিয়ে হয়ে গেল তুমুলকান্ড। বাসচালক ছাত্রীকে দস্তুরমত ধর্ষণের হুমকি দিয়ে বসল! আর এটি হলো ঐ টাকার জন্যেই। কত হবে সে ভাড়া, সর্বোচ্চ বিশ টাকা? একজন ছাত্রীর বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব এর বেশী হওয়ার কথাতো না। তাহলে হাফ হলে দশটাকা হবে। বাকি থাকল দশটাকা, এ দশটাকার জন্য ধর্ষণের হুমকি? হায় খোদা কোথায় আমরা, হাহাহা। সম্প্রতি আবার ইডেন কলেজের এক ছাত্রীকে নাকি ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে আরেক বাসচালক। আল্লাহ্ এসব কি হচ্ছে, এভাবে ধর্ষণের হুমকি শুরুহল কেন? সম্ভবত বিচারক কামরুন্নাহারের ৭২ ঘণ্টার ফল। এ হুমকি কোন টাকা-পয়সার জন্য নয়। মেয়েটি রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের সামনে পড়েছে ফলে চালককে অযাচিত ব্রেক কষতে হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মেয়েটির উদ্দেশে চালকের ঐ সৌজন্যতা। মনে হয় চালক ‘সময়ের মূল্য’ সম্পর্কে সচেতন। সচেতন থাকা ভাল, বিশেষ করে সময় সম্পর্কে। কারণ টাইম ইজ মানি, সময়ই টাকা।
দেশে চলছে ইউপি সহ বিভিন্ন স্থানীয়সরকার নির্বাচন। মাশাল্লাহ্ প্রার্থীদের গলায় দেখাযাচ্ছে ইয়া বড় বড় টাকার মালা। ফলে নিন্দুকদল নিন্দায় হল লিপ্ত। তাদের তো আর কাজ নাই, খালি নিন্দা করে বেড়ায়। ফলে সম্মানিত প্রার্থীগণ হচ্ছেন অপমানিত। পাবলিককে তাদের বুঝাতে হচ্ছে, এই মালা তারা বানাননি, জনগণ বানিয়ে ভালবেসে তাদের পরিয়ে দিচ্ছে। মারহাবা, অদ্ভুত ভালবাসা। অন্ধর বউ ল্যাংড়াইয়্যার সাথে পালিয়ে গেল। বোবাইয়্যা এটি দেখল, কিন্তু অন্ধইয়্যাকে একথা সে কেমনে বুঝাবে? এখন পাবলিক বোবা আর প্রশাসন অন্ধ, ফলে প্রার্থীদের টাকার মালা কারা পরাচ্ছে- একথা পাবলিক প্রশাসনকে বুঝাবে কেমনে বলুন। যে দেশে মাত্র দশটাকার জন্য চালক মহিলা যাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেয় সে দেশে এত বড় টাকার মালা, যা পাঁচশ আর হাজার টাকার নোটে গাঁথা, জনগণ বিনামূল্যে প্রার্থীর গলায় পরিয়ে দেবেÑ একথা বিশ্বাস করার মতো দুর্ভাগ্য মনে হয় এখনও আমাদের আসেনি, হিহিহি। অতএব বোবা জনগণ ও অন্ধ প্রশাসন মিলে যে রসায়ন, তার নাম নির্বাচন। নির্বাচনে চলবে টাকার মেলা এটিই এখন বিধির খেলা। টাকা বড় বেইমান, যখন যার তখন তার। রূপ পাল্টাতে সে দেরি করে না। তাই টাকা নিয়ে বাহাদুরি করে লাভ নাই। ক্যাপশনে বলা হয়েছে টাকা তুমি দেখতে গোল। এখন সবাই বলবেন টাকা গোল কোথায়, টাকা তো আয়তকার। বলতে গেলে টাকা আয়তকার হয়েছে মাত্র সোয়াশ বছর, তার আগে বহু হাজার বছর ধরে টাকা গোল। এবং এখনো প্রচুর গোল টাকা রয়েছে। ক্যাপশনের উদ্ধৃতিটির অর্থ- অর্থই অনর্থের মূল। তাই টাকা করে গন্ডগোল, সে জন্যে শেক্সপীয়র টাকা ধার দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ টাকা ধার দেবেন হাসিমুখে, আদায় করবেন রক্তচোখে, হেহেহে। এই যে প্রার্থীগণ টাকার মালা পরেছেন, তা নাকি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে না। যতটুক জানি নির্বাচনী মাঠে টাকা পেলেই গ্রেফতার করা হয়- এমন বহু নজির প্রচুর দেখেছি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে টাকা হারাম, টাকার মালা হালাল। হযরত দাউদের (আঃ) যুগে শনিবার ছিল পবিত্র দিন, ফলে সে দিন মাছ ধরা নিষেধ ছিল। জেলেরা তখন করত কি শনিবারে মাছেরা যখন নদীর তীরে খেলা করতে আসত, বেড়া দিয়ে তাদের ঘেরাও করে রাখত। পরদিন যখন রবিবার আসত, গিয়ে তারা মাছগুলো ধরে নিয়ে চ্যাঙারিতে ভরত।
যেহেতু শনিবারে মাছ ধরা নিষেধ তাই তারা রবিবারে ধরেছে, হেহেহে। আমাদের নির্বাচনেও তেমন টাকা নিষেধ, মালা বিশেষ। মানে পরা যাবে, ধরা যাবে না। এক জায়গায় লিখা আছে এখানে হাঁটা নিষেধ। ভাতিজা দৌড়ে সেদিকে যাচ্ছে, চাচা তখন হাত ধরে তারে, ‘এই সেদিকে কোথায় যাচ্ছিস, দেখস না লিখা আছে এখানে হাঁটা নিষেধ?’ ভাতিজা তখন, ‘চাচা আমি তো হাঁটি না, দৌড়ি।’ আমাদের নির্বাচনের মাঠে পুলিশ এসে যখন ভোটার কিংবা প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করবে, ‘এই টাকা ধরস ক্যান?’ তখন তারা বলবে, ‘স্যার আমরা তো টাকা ধরি না, পরি।’ এখন তারা টাকা ধরে, না পরে, সেটি পুলিশ কেমনে নির্ণয় করবে? হযরত দাউদ (আ.) ঐ সকল জেলেদের নাকি অভিশাপ দিয়েছেন। ফলে তারা বানর হয়ে তিনদিন পর মারাগেল। বিষয় হল হয়রত দাউদ (আ.) তো ছিলেন নবী তাই তাঁর সাথে ছলাকলা চলেনি, অভিশাপ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু আমাদের পুলিশতো কোন নবী নয়, সঙ্গত কারণে তাদের অভিশাপ দেওয়ার ক্ষমতা নাই। সুতরাং তারা কি করবেন? টুকে দেবেন ক’টি গায়েবী মামলা!
আসলে টাকা বড়ঝামেলা, সাদা না কালা প্রমাণ করাও কষ্ট মেলা। টেকনাফ স্থলবন্দরে দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে চাকরি করে নুরুল ইসলাম ৪৬০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর ধরা পড়েছে সে দুর্নীতিবাজ। ভেবে দেখুন কত তাড়াতাড়ি ধরা পড়লো। অনেকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে দুর্নীতিবাজ গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন কথা হল ৪ হাজার টাকার কম মাসিক বেতন পাওয়া একজন লোকের দুর্নীতি ধরতে তাকে ৪৬০ কোটিটাকার মালিক হতে হয়েছে। এইযে দীর্ঘ সময় লাগল তাতেই বুঝা যায় আমাদের প্রশাসন কত করিৎকর্মা এবং দূরদর্শী? নুরু যদি বেশী লোভ না করত তাহলে চারশ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যেত পারত। দেশের ভাগ্যভাল সে আরো বেশী টাকার লোভ করেছে নইলে কর্তৃপক্ষ তার কৃতিত্বটা পেত না। এক ডাক্তার রোগী আসার সাথে সাথে ঔষধ খাইয়ে দিলেন,কিছুক্ষণের মধ্যে রোগী ভালহয়ে বিল দিয়ে চলে গেল। রোগী চলে যাওয়ার পর কম্পাউন্ডার জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার রোগী না দেখে আপনি ঔষধ খাইয়ে দিলেন যে?’ ডাক্তার; ‘আরে গাধা ঔষধ না খাওয়ালে তো আমি বিলই পেতাম না, কারণ রোগী এমনিতেই ভাল হয়ে যেত।’
মনে হয় নুরুল ইসলাম সম্পদের কারণে ধরা খায়নি, ভাগের কারণে ধরা খেয়েছে। সম্ভবত উপরে ভাগ কম পাঠিয়েছে, হেহেহে। বছর চারেক পূর্বে জানলাম ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি পানি পান করেন, লিটার ৭শ টাকা দাম। শুনে তো আমি বেহুঁশ, কারণ পানি কেমনে এত দাম হয়? কদিন হল হুঁশ হলাম মুকেশ আম্বানির বউ নিতা আম্বানির পানির দামÑ ৭৫০ মিলি তথা ১ লিটারের ৩/৪ ভাগ মাত্র ৫১ লক্ষ টাকা শুনে! কারণ মুকেশ আম্বানি নিজে ক’টাকা দামের পানি খান এবং পৃথিবীতে পানির মূল্য সর্বোচ্চ কত টাকা পর্যন্ত আছে তা জানার জন্য। কেননা পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন যিনি বছরে মুকেশ আম্বানির সারা জনমের আয়ের চাইতে বেশী আয় করেন! তিনি হলেন ইলন মাস্ক। এখন ইলন মাস্কের স্ত্রী কত টাকা দামের পানি পান করেন সেটি জানার ইচ্ছে হচ্ছে। টাকা তুমি দেখতে গোল করো তুমি গÐগোল। টাকা আছে বলে যেনতেন ভাবে আলোচনায় আসতেই হবে? আরবের শেখদের কথাও শুনি, তারাও প্রচুর অপব্যয় করেন। অথচ আজ হতে মাত্র ৭০ বছর আগেও তারা প্রচন্ড অভাবী ছিলেন।
৭৫০ মিলি মানে ৭৫০ গ্রাম। এই পরিমাণ স্বর্ণের দামই বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩২ লাখ টাকা হতে পারে। অথচ পানির দাম ৫১ লক্ষ টাকা! কি হবে ঐ পানি পান করে, দুইদিন কি বেশী বাঁচা যাবে? মাইকেল জ্যাকসন নাকি দেড়শ বছর বাঁচার জন্য অক্সিজেন চেম্বারে থাকতেন। আরো কত কি নাকি করতেন কিন্তু ৫০ বছরও অতিক্রম করতে পারলেন না। আলোচনায় আসতে চাইলে অনেক উপায় আছে। আসলে ভোগে নহে ত্যাগেই আনন্দ। নিজের তরে নহে, করতে হবে মানুষের তরে। তাহলেই টাকা রাখবে সদা সুখে মশগুল, নইলে বাধাবে মহাগন্ডগোল।
লেখক: কলামিস্ট