অর্জনের আনন্দে আওয়ামী লীগ বর্জনে বিপাকে বিএনপি

40

নিজস্ব প্রতিবেদক

পদ্মা সেতু নির্মাণকে রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই সেতুর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের বিশাল রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন হয়েছে মনে করছে। সাধারণ মানুষের মাঝেও পদ্মা সেতু নিয়ে ইতিবাচক একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। এর সুফল যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘরে। অন্যদিকে শুরু থেকে নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে পদ্মা সেতু সম্পর্কে নানা সময়ে বিরূপ মন্তব্য করে বিপাকে পড়েছে বিএনপি। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু তৈরি হয়ে যাওয়ার পর যে বিষ্ময় এবং উৎসবের সৃষ্টি হয়েছে তাতেও নিরপেক্ষ কোনো অবস্থানেও যেতে পারছে না বিএনপি। ফলে এই নেতিবাচক দিকটা যোগ হচ্ছে বিএনপির ঘরে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এখন বিএনপি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কোনো জায়গায় যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে সিলেট অঞ্চলে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়েছে। দৃশ্যত পদ্মা সেতু নিয়ে উৎসবে আছে আওয়ামী লীগ আর বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াবার কথা বলে বিএনপি ‘নো কমেন্ট’ জাতীয় একটা পরিস্থিতির মধ্যেই আছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প নেয়া হয়। নির্বাচনের আগের বছর সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু চালু করা হয়েছে। সেতুটি চালুর মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল, তখন এর নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমালোচনার মুখে যেমন পড়েছিল, একইসাথে এই সেতু নির্মাণের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ তেরি হয়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দাতাদের অর্থায়ন ছাড়াই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে সরকার। সমস্ত সমালোচনাকে পেছনে ফেলে দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্থাপনাটি রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর সেতুটির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল রাজনৈতিকভাবে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বিবিসি বাংলার সাথে সম্প্রতি আলাপকালে বলেন, তাদের দলের সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেতু নির্মাণ করেছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের মুখে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জে জয়লাভ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেছি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে যেভাবে সরে গিয়েছিল, তার সাথে বিরোধীদল বিএনপি এবং বিভিন্ন ব্যক্তির যোগসূত্র থাকার অভিযোগ করে আসছিল সরকার এবং আওয়ামী লীগ। যদিও তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে এখন পদ্মা সেতু নির্মাণের পর এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি সহ বিরোধীদলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি সেই অনুষ্ঠানে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় । যদিও পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপির অবস্থান সব সময় ছিল সমালোচমুখর। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর বিএনপি সোচ্চার ছিল দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। পরে তারা বলেছেন, সরকার এই সেতু করতে পারবে না, করলেও সেটা জোড়াতালির সেতু হবে। এই সেতুতে না উঠতে নেতাকর্মীদের সাবধানও করে দেন দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’ এ নিয়ে সে সময়ে তুমুল সমালোচনা হয়। তবে দিনে দিনে এগিয়েছে পদ্মা সেতুর কাজ। সেতুর কাজের সাথে সাথে সমালোচনাও আস্তে আস্তে বন্ধ হতে থাকে। পরবর্তিতে দৃশ্যমান সেতুর কাজ হলে সরকারি দল থেকে ‘বিএনপির বুকের জ্বালা হচ্ছে’ ও ‘অন্তর্জ্বালায় ভুগছে’ এমন মন্তব্য আসে। এরপর বিএনপি সমালোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বুকের জ্বালার একটা ব্যাখ্যা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভিন্নভাবে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু হচ্ছে বলে আমাদের গায়ে জ্বালা হচ্ছে না। আমাদের গায়ের জ্বালা হচ্ছে যে তারা পদ্মা সেতু থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে সম্পদ করছে। এটা আমাদের টাকা, জনগণের টাকা। এভাবে সমস্ত মেগা প্রজেক্ট থেকেই তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে।’ এরপর বিএনপির বিভিন্ন নেতার মুখে আবার দুর্নীতির অভিযোগ আসলেও হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায় দলটি। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণের পর এ নিয়ে তাদের কোনো মন্তব্য নেই বললেই চলে। সেতুর দিকে কোনো মনোযোগ না দিয়ে সিলেটের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছেন।
এদিকে গতকাল জাতিসংঘ ঘোষিত নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবসের এক বাণিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে অবৈধ শাসকগোষ্ঠী জনগণের ওপর এখন ফ্যাসিবাদী জুলুম চালাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাই হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর প্রধান অস্ত্র। বিভিন্ন অভিযানের নামে সারাদেশে বেআইনি হত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। আর এসব অভিযানে বিএনপিসহ বিরোধী দল ও মতের মানুষেদেরও বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। দেশে মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের উৎসবমুখর এই দিনে বিএনপি কার্যত নির্মোহ এবং মির্জা ফখরুলের বক্তব্যেও এই সম্পর্কে কোনো কথা নেই।
২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতি’ হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি জাইকা, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। বিএনপিসহ সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি সরকারের সমালোচনায় মেতে ওঠেন। নানান ধরনের মন্তব্য ও উপহাস হয় পদ্মা সেতুকে নিয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত এসব অভিযোগগুলো মথ্যা ও ষড়যন্ত্র বলে প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে ‘ষড়যন্ত্রের খেলা’ বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অভিযোগ তোলা হয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাংকে ঋণ সহায়তা প্রদানে বাধা দেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুতে টাকা দিতে বিশ্বব্যাংক সব সময় রাজি ছিল। কিন্তু ইউনূসের কারণে সেটি হয়নি। বিশ্বব্যাংক যেন টাকা না দেয়, সে জন্য ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে সংস্থাটিকে চাপ দিয়েছিলেন। বহির্বিশ্বে সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অনবরত অভিযোগ করে যাওয়ায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অবাক লাগে, একজন নোবেলজয়ী কী করে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন?’ তাছাড়া বিএনপিও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে একাধিক সময়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে ব্যয় বহুল এই উন্নয়নে বিএনপিও কখনো তাদের অবস্থান থেকে সাধুবাদ জানায়নি। বরং শুরু থেকেই বিএনপি পদ্মা সেতুর বিপক্ষে নানা মন্তব্য করেছিলেন। এমনকি পদ্মা সেতু উদ্বোধন নিয়ে সারা দেশে যখন আনন্দ আয়োজন চলছে, তখন সিলেটে বন্যার পানিতে মানুষ ভেসে যাচ্ছে সেদিকে সরকারের নজর নেই মন্তব্য করেছে বিএনপি।
বিশ্লেষকদের মতে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। আওয়ামী লীগ সরকার এই উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা অর্জন করবে। বিএনপি রাজনৈতিকভাবে এই উন্নয়ননের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারেনি। নানা কটূক্তির মাধ্যমে দলটির সেতুর বিপক্ষে অবস্থান চলে যায়। শুরু থেকে কটূক্তি করে আসা দলটি শেষে এসেও ইউটার্ন নিতে পারেনি। পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপি এখন নিরব ভূমিকা একটি কৌশল। সিলেটের বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বা গুম-খুনের মতো অভিযোগের মাধ্যমে বিএনপি মূলত একদিকে নিজেকে ‘অ্যানগেজ’ করে রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন। ফলে আগামী নির্বাচন এবং নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে পদ্মা সেতু একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে বড় দুই দলের জন্য।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের অন্য সবকিছুর সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণেও আসবে মাইলফলক গতি। গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। গতি ও মাত্রা বাড়বে অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় যান চলাচলের। সব মিলিয়ে সেতুর উভয়পাশে বিকাশ ঘটবে সুষম অর্থনীতির। গবেষণা বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১.২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে সারাদেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এ সেতু। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সীমা ছাড়ানো অবদান রাখবে। পদ্মা সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় সূতিকাগার হিসেবে কাজ করবে। এ সেতুর মাধ্যমে দুই প্রান্তে বিদ্যুৎ, গ্যাস, অপটিক্যাল ফাইবারসহ পরিষেবাসমূহের সংযোগ স্থাপিত হবে। দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ সেতু অনন্য অবদান রাখবে। নিজস্ব অর্থায়নে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর সফল নির্মাণ দেশের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।