অরক্ষিত টার্মিনাল ঘিরে মাদক ও কিশোর গ্যাং-এর উৎপাত

22

মনিরুল ইসলাম মুন্না

বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল। সন্ধ্যা নামতেই যেন তৈরি হয় ঘুটঘুটে অন্ধকার। টার্মিনালের চারপাশে নেই কোন দেয়াল। নেই বড় লাইট বা ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। একটি বাস টার্মিনালে ঢোকার সময় বা বাহির ওয়ার সময় কিছুক্ষণ আলোকিত থাকে। এর অল্প পরেই নেমে আসে আবার অন্ধকার। আর এতেই চলে মাদকের কারবার, সেবন, জুয়া ও পতিতাবৃত্তিসহ অনৈতিক কর্মকান্ড। এসব কারণে সাধারণ যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের মাঝে বিরাজ করে উদ্বেগ-আতঙ্ক।
এছাড়া সেখানে দিনের বেলায় চলে উঠতি বয়সী ছেলেদের তথা কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডা। বাসের ফাঁকে, টার্মিনালের নানা চিপায় চলে তাদের কর্মকান্ড। এসব ছেলেদের হাতে থাকে ধারালো ছোঁড়া থেকে শুরু করে দেশে তৈরি অস্ত্র। অনেক সময় তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। এতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় পুরো টার্মিনালে। তেমনি গত শুক্রবার স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এসব ছেলেদের দুই গ্রুপের ঝগড়ার সময় টার্মিনালের এক পরিবহন শ্রমিক নেতা ঝগড়া থামাতে গেলে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। মারাত্মক জখম অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি চান্দগাঁও থানায় গিয়ে একটি অভিযোগ দাখিল করেন।
চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুর রহমান বলেন, কিশোরদের মধ্যে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের পর পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
গত শুক্রবার রাতে ও গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিনে বহদ্দারহাট টার্মিনালে গেলে নানা তথ্য উঠে আসে।
টার্মিনালের এক দোকানি জানিয়েছেন, এ টার্মিনাল ঘিরে চলে জুয়া ও মাদক সেবন ও মাদকের কারবার। রাতে টার্মিনালের চারপাশ ঘিরে শুরু হয় জুয়া, মাদক সেবন ও কেনা-বেচার কাজ, রাতভর চলে এই কর্মযজ্ঞ। পুলিশের টহল তৎপরতা তেমন নেই বললেই চলে। এক সময় টার্মিনালের দ্বিতীয় তলায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাসের ওখানে ফাঁড়িটি সরিয়ে নেয়া হয়। তাই খুব কমই পুলিশ আসে এখানে। যার সুযোগে কিশোর গ্যাং ও মাদক সেবনকারীদের উৎপাত বেড়েছে।
আরেক দোকানি বলেন, এখানে স্থানীয় বখাটে যুবক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মেতে ওঠে মাদকের নীল নেশায়। টার্মিনালটি যেন এখন রীতিমতো মাদক বিক্রির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই চলছে মাদক বাণিজ্য। শুধু মাদক কেনাবেচা নয়, পাশাপাশি সন্ধ্যার পর থেকে রাতভর চলে জুয়ার আসর। ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন চলে হরহামেশাই। টার্মিনালের পাশে পুলিশ থাকলেও মাদকবাণিজ্য বন্ধে নেই তৎপরতা।
যাত্রী মো. আতাউর রহমান বলেন, প্রায় সময় আমি পরিবার নিয়ে কক্সবাজার যাওয়া-আসা করি। টার্মিনাল থেকে টিকেট কেটে গাড়িতে উঠি। কিন্তু বখাটে ছেলেরা স্ত্রী-কন্যার দিকে অন্য রকম চোখে তাকিয়ে থাকে। যা খুবই বিরক্তিকর। এছাড়া বখাটে, মলম পার্টি ও মাদক সেবনকারীদের আনাগোনায় আমরা আতঙ্কের মধ্যে থাকি। টার্মিনালে শৃঙ্খলা থাকলে এমন হওয়ার কথা নয়। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, টার্মিনাল থেকে যেন বখাটে, মলম পার্টি ও অন্যান্য খারাপ বিষয়ে যেন তাদের নজরদারি থাকে।
আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সম্পাদক মো. নিজামুল ইসলাম খান পূর্বদেশকে বলেন, শুক্রবার (২৪ জুন) টার্মিনালের পূরবী কাউন্টারের সামনে ১৭-১৮ বছর বয়সী কিছু ছেলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া চলায় আমি তাদেরকে থামতে বলি এবং টার্মিনাল থেকে চলে যেতে বলি। কিন্তু তারা আমার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে একজন এসে আমাকে ছুরি মেরে দেয়। এতে হাতের রগ কেটে যায় এবং রক্তপাত হতে থাকে। তাৎক্ষণিক মাথা ঘুরে আমি মাটিতে পড়ে গেলে আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাতে আমি থানায় গিয়ে ওসি বরাবর একটি অভিযোগ দিই। ওসি বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন বলে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এসব ছেলেরা এখানে এসে নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। তারা কিশোর গ্যাং। এসব ছেলে স্থানীয় চান্দগাঁও আবাসিক, খাজা রোড, খরম পাড়া, পুরাতন চান্দগাঁও থানা এলাকার। পুলিশ যদি ব্যবস্থা না নেয়, তবে এদের তৎপরতা আরও বেড়ে যাবে।
একই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি নুরুল কবির বলেন, আগে থেকে এখানে মাদক, কিশোর গ্যাং, পতিতাবৃত্তিসহ নানা অপরাধ ছিল। আমরা মাঝখানে পুলিশের সহায়তায় এসব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু করোনা মহামারির সময় থেকে আবারও অনৈতিক কর্মকান্ড ও তৎপরতা বেড়ে যায়। তবে আমরা গাড়ির মালিকদের মাধ্যমে সরকারের নানা দপ্তরে সীমানা দেওয়াল, লাইটিং ও সিসি ক্যামেরার বিষয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু এ নিয়ে নেই কোন উদ্যোগ।
চান্দগাঁও থানার ওসি মঈনুর রহমান বলেন, এরা আসলে কিশোর গ্যাং নয়। ছেলেরা মারামারি করতে গেছে সেখানে নিজামুল ইসলাম ছুটাতে গিয়ে আহত হয়েছেন। বিষয়টি জানার পর আমরা টার্মিনাল এলাকায় পুলিশের তৎপরতা বাড়িয়েছি।
টার্মিনালে মাদক, জুয়া ও অনৈতিক কর্মকান্ড বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, শুধু আমাদেরকে দোষারোপ করলে হবে না। টার্মিনালে নেই কোন ফেঞ্চিং (বেড়া) ব্যবস্থা, নেই কোন সিসি ক্যামেরা। গাড়ির চিপাচাপাই তো ক্রিমিনালরা খোঁজে। তারা অপকর্ম করতে এসব জায়গায় সুযোগ পায়। তারপরও আমি ওখানে আমাদের টিম পাঠিয়ে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করবো।