অমর একুশে

72

পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা/ আমার এ দেশ ভাই রে/ ধানের মাঠে ঢেউ খেলানো এমন কোথাও নাই রে/ ছল ছল ছলিয়ে নিরবধি/ রূপালী হার বইছে নদী/ দখিন হাওয়ায় দোল জাগানো/ পরশ বুকে পাই রে/ ঝর ঝর ঝরিয়ে বাঁশের পাতা/ চোখে স্বপন আনে/ অনেক কথার রূপকথা যে/ নীরব মায়ায় টানে/ গুন গুন গুনিয়ে বাতাস এসে/ কলমি ফুলের গন্ধে মেশে/ ফসল ভরা মাঠের ডাকে/ মন হারিয়ে যায় রে…
বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশ একদিকে যেমন মুক্তিকামী চেতনার উজ্জ্বল কাব্যগাঁথা, অন্যদিকে তেমনি বেদনাবিধূর ও শোকাবহ অধ্যায়।
যার পথ ধরে রচিত হয়েছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। নিজেদের একটি পতাকা। নিজেদের একটি মানচিত্র। ভাষাসৈনিকরাই মনে করছেন, ভাষা আন্দোলন আজও শেষ হয়নি। কেননা, অফিস-আদালতে ব্যবহারের জন্য পরিভাষা তৈরির কাজ এতদিনেও শেষ হয়নি। এটা জাতির জন্য লজ্জার কথা। আজও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশে আমাদের আফিস-আদালতে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা নয়, ইংরেজির ব্যবহার চলে। তাছাড়া এদেশেরই বহু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যম স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এটা আনন্দের কথা। কিন্তু আজও আমাদের আশপাশের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেনি।
বাংলা শুধু উপমহাদেশের নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম বহুল-ব্যবহৃত ভাষা। সর্বত্র বাংলার ব্যবহার যেহেতু নিশ্চিত ও কার্যকর করা যায় নি; সেহেতু ভাষা আন্দোলনও শেষ হয়নি। বাংলা ভাষা আন্দোলনের কর্মী ও সমর্থকদের বরকত, রফিক, শফিক, সালাম, জব্বারসহ নাম না জানা ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে আরও বহু সংগ্রাম ও সাধনা করতে হবে। সেই গৌরবময় লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে হবে।
আমরা সবসময়ই দাবি করে থাকি, বাংলা ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল আজকের স্বাধীন রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তাই ভাষা আন্দোলনের সাথে আমাদের এই প্রিয় রাষ্ট্রটির উন্নত ও শক্তিশালী হওয়ার প্রশ্নও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিধাতা বাংলাদেশকে দিয়েছে পৃথিবীর ঊর্বরতম জমি এবং পাহাড় ও দরিয়ার নিচে সাজানো প্রাকৃতিক খনিজ অমূল্য সম্পদের সুবিশাল ভান্ডার। সর্বোপরি রয়েছে অল্পে তুষ্ট পরিশ্রমী বিপুল মানবসম্পদ। এত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি স্বাধীন দেশের তো এতদিনেও পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশসমূহের তালিকায় আটকে থাকা সমীচীন বা কাম্য হতে পারে না।
বাঙালি জাতির স্বাধিকার চেতনার শিকড় একুশের গর্ব ও অহংকারে সমৃদ্ধ আমাদের এই বিপুল সম্ভাবনাময় দেশের পিছিয়ে থাকার জন্য একশ্রেণীর রাজনীতিককেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করে হয়ে থাকে। এমনও অভিযোগ শোনা যায় যে, স্বাধীন দেশে আজও গণতন্ত্র শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে কিংবা শিকড় গাড়তে পারছে না এক শ্রেণীর রাজনীতিকের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও স্বার্থপরায়ণতার কারণে। তারা নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এতটাই শত্রু ভাবেন যে, তাদের শায়েস্তা করতে তারা অনায়াসে সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী অপশক্তির কাছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও কার্পণ্য করেন না। এতে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী অপশক্তিসমূহ এই সম্ভাবনাময় দেশটির সম্পদ লুটপাটের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের সাথে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে বলেই যতদিন ভাষা আন্দোলনের গৌরবজনক ফসল বাংলাদেশ বিশ্বসমাজে অন্যতম শ্রেষ্ঠ, উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে না ওঠে, ততদিন ভাষা আন্দোলনের কাছে দেশবাসীর ঋণ পরিশোধ হওয়ার নয়। ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস ফেব্রুয়ারিতে সেই অনাগত সুদিন ত্বরান্বিত করার সাধনাই হোক আমাদের সবার প্রধান লক্ষ্য।