অভিনন্দন ব্রিটেনে কিং চার্লস যুগের সূচনা

5

সাত দশকের সফল রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রানী (রাজ শাসক) দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত ৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের ব্যালমোরাল প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। এর কয়েকদিন আগেই ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন হয়। নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে তিনি সরকার গঠনেরও আহবান জানিয়েছিলেন। এরমধ্যে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার চলাফেরা সীমিত হয়ে গিয়েছিল, এমনকি রাজকীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বৈঠকেও যোগ দিতে পারেননি তিনি। যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি রাষ্ট্রের রানি এবং রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি যুক্তরাজ্যের শাসনকর্তা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধানও ছিলেন। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁর শেষ কৃত্যানুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মর্যাদয় সম্পন্ন করা হবে। ইতোমধ্যেরানীর শেষ বিদায়ের আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে বলে ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানান। পাশাপাশি রানীর উত্তরাধিকারের অভিষেকের আয়োজন চলছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজ পরিবারের সিংহাসনে বসেছেন তার বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস। জানা গেছে প্রিন্স চার্লস ‘রাজা তৃতীয় চার্লস’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেছেন এবং ১৪টি কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে দেশের শোক-পালনে নেতৃত্ব দেবেন। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের সেন্ট জেমসের প্রাসাদে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রিন্স চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জকে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার স্থানীয় সময় সকালে সেন্ট জেমসের প্রাসাদে অ্যাকসেশন কাউন্সিল নামে একটি আনুষ্ঠানিক পরিষদের সামনে রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লসের অভিষেক হয়। এই অ্যাকসেশন কাউন্সিল ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য, দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ এবং ক্যান্টারবারির আর্চবিশপকে নিয়ে গঠিত। সেন্ট জেমসের প্রাসাদ সার্বভৌম রাজার সরকারি বাসভবন। বিবিসি বলছে, শনিবার এই কাউন্সিলের সবার উপস্থিতিতে নতুন রাজার নাম ঘোষণা করা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এবারই ঐতিহাসিক এই ঘোষণা টেলিভিশনে সরাসরি স¤প্রচার করা হয়েছে। নতুন রাজা সেন্ট জেমসের প্রাসাদের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিলেন না। তবে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধ্বে রাজাকে পরামর্শদানকারী জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত প্রিভি কাউন্সিলের বৈঠকে অংশ নেন তিনি।
পরে প্রিভি কাউন্সিলের ক্লার্ক রিচার্ড টিলব্রæক চার্লসকে ‘রাজা, কমনওয়েলথের প্রধান, বিশ্বাসের রক্ষক’ ঘোষণা করেন। চার্লসের অভিষেকের ঘোষণাটি যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনসহ স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ, উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট, ওয়েলসের কার্ডিফ এবং অন্যান্য শহরে জনসমক্ষে পাঠ করা হবে। শনিবারের আনুষ্ঠানিকতার শুরুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে রানীর মৃত্যু হয়েছে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় চার্লসকে রাজা ঘোষণার প্রক্রিয়া। ‘গার্টার কিং অব আর্মস’ প্রাসাদের ব্যালকনি থেকে নতুন রাজার ঘোষণা পাঠ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাম্পেটে বাজানো হয় ‘গড সেভ দ্য কিং’ এবং উপস্থিত জনতাও এতে কণ্ঠ মেলান। একদিকে চলে ট্রাম্পেটের ধ্বনি অন্যদিকে লন্ডনের হাইড পার্ক ও টাওয়ার অব লন্ডন থেকে তোপধ্বনি করা হয়। বিবিসি জানিয়েছে, তৃতীয় চার্লসকে রাজা ঘোষণার পর ঘোষণায় স্বাক্ষর করা শুরু হয়। প্রিন্স উইলিয়াম ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস এবং আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি তা প্রত্যক্ষ করেন। রাজা তৃতীয় চার্লস আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শপথ নেওয়ার আগে প্রয়াত রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। রানীর আদর্শ অনুসরণ করে যাওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার, প্রিন্স উইলিয়াম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি। প্রথমে মৃত রানীর শোকে যুক্তরাজ্যের জাতীয় পতাকা ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ অর্ধনমিত রাখা হলেও শনিবার নতুন রাজার অভিষেকে সেগুলো পুরোপুরি উত্তোলন করা হয়। এরপর রবিবার পর্যন্ত যুক্তরাজ্যজুড়ে তৃতীয় চার্লসের রাজা হওয়ার ঘোষণা প্রচারের পর পতাকাগুলো ফের অর্ধনমিত হবে। উল্লেখ্য যে, রানী এলিজাবেথ আলেক্সান্দ্র্রা মেরি উইন্ডসর ও প্রিন্স ফিলিপ দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান চার্লসের পুরো নাম চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ উইন্ডসর। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর জন্ম হয় তার। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ায়, বিষয় ছিল প্রতœতত্ত¡, নৃতত্ত¡ এবং ইতিহাস। ষাটের দশকের শেষ দিকে রাজপরিবারের প্রথা অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন চার্লস এবং পাইলট হিসেবে দশ বছর দেশের বিমান বাহিনীতে কাজ করেন। অবসর নেওয়ার পর ১৯৮১ সালে লেডি ডায়ানা স্পেনসারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চার্লস। ওই সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর, আর ১৯ বছর বয়সী ডায়ানা ছিলেন যুক্তরাজ্যের একটি নার্সারি স্কুলের শিক্ষিকা। ১৯৮১ সালে যখন তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছরই প্রথম সন্তান প্রিন্স উইলিয়ামের মুখ দেখেন এই দম্পতি, তার দু’বছর পর ১৯৮৪ সালে জন্ম নেন তাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হ্যারি। ডায়ানার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে চার্লস-ডায়ানার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর ২০০৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চার্লস ও ক্যামিলা।
ব্রিটেন একমাত্র দেশ যেখানে রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রেও সমান্তরাল চর্চা হয়। একদিকে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য প্রতীক রাজা বা রানীর প্রতি আনুগত্য অপরদিকে গণতান্ত্রিক রীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি পালন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ দেশে সুশাসন ও জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ব্রিটেন। রানীর সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে চার্লসের প্রতি ব্রিটেনের নাগরিকদের শ্রদ্ধা আগে থেকেই ছিল। এখন একজন পরিপক্ষ রাজনীতিক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিদীপÍ কর্মকাÐ ও রাজপরিবারের সংস্কার ও রীতির প্রতি সাধারণের আনুগত্য অব্যাহত রাখাসহ ব্রিটেনকে অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী করাই হবে তার প্রধান লক্ষ্য। আমরা চার্লসের দীর্ঘায়ু কামনা করি। অভিনন্দন কিং চার্লস।