অবৈধ বাস-ট্রাক টার্মিনাল ঘিরে ‘চাঁদার সিন্ডিকেট’

30

মনিরুল ইসলাম মুন্না

পাহাড়তলী থানার অলংকার মোড় থেকে বিটাক, শফি মোটর্স ও বিসিক শিল্প নগরীর সামনের সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ বাস-ট্রাক টার্মিনাল। আর এ টার্মিনাল ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। তারা নিয়মিত রাস্তার উপর পার্কিং করা গাড়িগুলো থেকে চাঁদা আদায় করে আসছে। আর চাঁদার একটি অংশ যায় স্থানীয় নেতা, থানা ও ট্রাফিক পুলিশের হাতে। গত বুধবার ওই এলাকার চালক, গ্যারেজ মিস্ত্রি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
সরেজমিন দেখা গেছে, অলংকার মোড় থেকে পশ্চিমমুখী আলিফ গলি সড়ক ধরে হাঁটতে গেলে নতুন কারও মনে হতে পারে এটি একটি বাস টার্মিনাল। কারণ, প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের দু-পাশেই শতাধিক বাসের সারি। এই সড়কের শেষ মাথায় গিয়ে তিন রাস্তার আগ পর্যন্ত বাস থাকলেও তারপর থেকে বাসের দখলে নেই। বিটাক মোড় থেকে বিসিক শিল্প নগরী পর্যন্ত বিস্তৃত ওই সড়কটির দু’পাশ দখল নিয়েছে ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যান। সড়কের ওপর বাস, ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যান রাখায় দুই তৃতীয়াংশ জায়গা সারাক্ষণই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়ক সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় একদিকে গাড়ি চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে, অন্যদিকে মানুষকে হাঁটাচলায়ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আর এসবের পেছনে কাজ করছে একটি সিন্ডিকেট, যারা বাস-ট্রাক থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম চালিয়ে আসছে। স্থানীয়রা প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও এ সিন্ডিকেটের নাম এলাকার সবারই জানা।
স্থানীয়রা জানান, যুবলীগ নামধারী নেতা এবং তার অনুসারীরা ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলে। তবে চাঁদার পুরোটা এদের পকেটে ঢুকে না। এর মধ্যে অর্ধেক টাকা চলে যায় পুলিশের হাতে। ‘ক্যাশিয়ার মাসুদ’ নামের এক ব্যক্তি সংগ্রহ করে পুলিশের সেই ভাগটা পৌঁছে দেন। এছাড়াও প্রতিদিন ট্রাক থেকে ২০০ টাকা চাঁদা আদায়ের নেতৃত্ব দেন রকি, মামুন, জনি ও ইলিয়াস। আর বাস থেকে টাকা আদায়ের নেতৃত্ব দেন তৈয়ব। আবার ফুটপাতে বসা সকল দোকান থেকেও দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা আদায়ের দায়িত্বও তৈয়বের।
টাকা উত্তোলনের বিষয় পরিষ্কার করতে বিটাক মোড়ে কথা হয় জাকির হোসেন নামে এক ট্রাক চালকের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখানে গাড়ি (ট্রাক) রাখলেই ইলিয়াসকে ২০০ টাকা দিয়ে দিতে হবে। এ ২০০ টাকার সময় মাত্র ১২ ঘণ্টা। ১২ ঘণ্টা অতিবাহিত হলে সাথে আরও ২০০ টাকা যুক্ত হবে। দিনের মধ্যে আপনি গাড়ি এক ঘণ্টা রাখেন আর ১২ ঘণ্টা রাখেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। তবে ২০০ টাকা ইলিয়াসকে দিয়ে দিতেই হবে। তাহলে সরকারি রাস্তায় গাড়ি রেখে চাঁদাবাজকে টাকা দেব কেন? এখানে ট্রাফিক, থানা পুলিশ ম্যানেজ হয় বলে তারা কোন ব্যবস্থা নেন না।’
টাকা তোলার বিষয়টিও স্বীকার করেন ইলিয়াস। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা ট্রাকগুলো পাহারা দিই। এখানে পার্কিং করা ট্রাকগুলোর যন্ত্রাংশ চুরি হওয়ার ভয় রয়েছে। সেগুলো পাহারা বাবদ ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আদায় করি। আর এটাকে চাঁদাবাজি বলা যাবে না।’ তাহলে চাঁদার অংশ পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের কেন দেয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আপনার সাথে দু-একদিনের মধ্যে দেখা করব। আপনি সংবাদটি প্রকাশ করবেন না।’
এদিকে বিসিক শিল্প নগরীতে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০০টি প্লট রয়েছে। এসব কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। প্রতিদিন সকাল-বিকেল আসা যাওয়ার সময় তাদের বাস-ট্রাক শ্রমিকদের হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়।
মিনা নামে এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছি। পেছন থেকে ট্রাক ও বাসের হেলপাররা শীষ দিয়ে আমাদেরকে বিরক্ত করে। পুলিশকে কয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিবো? চালক-হেলপারদের সবাই তো একই নৌকার মাঝি।’
কয়েকজন গ্যারেজ মিস্ত্রি ও দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চুরি, ছিনতাই আর গ্রæপভিত্তিক মারামারি নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা এখানে। অলংকার শপিং কমপ্লেক্সের সামনে থেকে আলিফ গলি হয়ে বিটাকের মোড় পর্যন্ত ফুটপাতের দোকানগুলোও চাঁদাবাজি থেকে বাদ পড়েনি। প্রতি দোকান থেকে দৈনিক ১০০ টাকা আদায় করে আরিফ, নাজিম ও মাহবুব নামে তিন চাঁদাবাজ। তিনজনে টাকা তুলে তৈয়বের হাতে তা জমা দেয়। শুধু তাই নয়, বাসের কোন যাত্রী যদি তাদের পণ্য গাড়িতে উঠাতে চায় তবে এখানে শাহিন, কবির ও ফারুক নামে লেবারের একটি গ্রæপ হাজির থাকবে। এ গ্রæপ ছাড়া আর কেউ গাড়িতে পণ্য উঠাতে-নামাতে পারবে না। বলতে গেলে এক কথায় তাদের হাতে জিম্মি যাত্রীরাও।
এসব বিষয়ে জানতে তৈয়বের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রতিবেদক। মুঠোফোনে চেষ্টা করেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ক্যাশিয়ার নাম দিয়ে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে মাসুদ বলেন, ‘আমি পিকআপের গ্যারেজে কাজ করি। থানার কোন কাজ করি না। আর আমি কোন ক্যাশিয়ার না।’
পাহাড়তলী থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) এস ধামেই (সন্তোষ ধামেই) বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েকদিন হল এখানে যোগদান করেছি। এলাকা সম্পর্কে কোন ধারণা আমার নেই। যদি অবৈধ টার্মিনাল বা পার্কিং হয়ে থাকে তবে অভিযানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ট্রাক-বাস সংশ্লিষ্ট কারও সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। রাস্তায় পার্কিং বিষয়টি ট্রাফিক বিভাগের কাজ। তারপরও আমরা রাস্তায় অভিযান দিলে গাড়িগুলো চলে যায়, পুনরায় এসে রাস্তা দখল করে বসে। চাঁদাবাজির বিষয়েও আমি কিছু জানি না।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার তারেক আহম্মেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘নগরীতে বাস টার্মিনাল ও পার্কিং সংকটের কারণে আলিফ গলিতে এক সাড়িতে বাস পার্কিং করার অনুমতি দেয়া আছে। তবে এক সারির বেশি হলে তা আমরা অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নিই। আর পার্কিং ঘিরে চাঁদাবাজির বিষয়ে আমি অবগত নই। সেটা দেখার বিষয় ক্রাইম বিভাগের। তারপরও এতে যারা জড়িত রয়েছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করব। ট্রাফিকের কেউ যদি এতে জড়িত থাকে তবে ছাড় পাবে না।’