অবৈধ অর্থ এবং অবৈধ ব্যবসা বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে

31

ডা. হাসান শহীদুল আলম

প্রথমেই নি¤েœর সংবাদচিত্র সমূহের প্রতি সম্মানিত পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
সংবাদচিত্র: ১. জানা যায়, বারিধারা, বনানী ও গুলশান এলাকার দেড় শতাধিক গেস্ট হাউজে রাতের বেলায় চলে মদ জুয়া ও দেহব্যবসা। কাজ হাসিলের জন্য এখানে দেয়া হয় ওমমা ওমমা নাইট, থার্সডে নাইট ও ককটেল পার্টি। এসব পার্টিতে দেশী বিদেশী কলগার্লরা অংশ নিয়ে আগত ভিআইপি অতিথিদের মন রাংগিয়ে তোলে।এ ছাড়া ৪ শতাধিক হোটেলের পাশাপাশি ২ সহ¯্রাধিক রেস্তোরাঁ, বিউটি পার্লার, ম্যাসেজ পার্লার, ক্লাব, বার, রেস্ট হাউজ, ফ্ল্যাট বাসাবাড়ীতে চলছে দেহ ব্যবসা। জানা যায়, নগরীর ৮৫ ভাগ আবাািসক হোটেলে প্রতিদিন সাড়ে সাত হাজার খদ্দেরের সমাগম ঘটে। আর এদের যৌনানন্দ দেবার জন্য সাড়ে ৫ হাজার ললনা নিজেদেরকে বিলিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেহ ব্যবসার পাশাপাশি মাদক ও মদ গ্রহণ করা হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে মোবাইলের মাধ্যমে খদ্দের ও পতিতা সংগ্রহ করা হয়। অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে পুলিশ বাহিনীকে ম্যানেজ করেই চলে এ ধরনের অবৈধ ব্যবসা [ফেসবুক ডট কম, ৩০-০৪-২১ ]।’
২. ‘পাঁচ তারকা হোটেলের প্রেসিডেন্ট কক্ষটি ভাড়া নেন ক্ষমতাধরটি।তিন মাসে ঐ কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। সবচেয়ে দামী বারটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিয়েছিলেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল পরিশোধ করতেন। যারা হোটেলে আসতো তাদের কাছে মেয়ে পাঠিয়ে দেয়া হতো। পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই ছিল তার আয়ের মূল উৎস। নিজেকে পরিচয় দিতেন ক্ষমতার রাঘব বোয়ালদের কর্মী হিসাবে। প্রেসিডেন্ট স্যুটের ভাড়া ৫৯ দিনে তিনি ৮১ লাখ ৪২ হাজার টাকা নগদ পরিশোধ করেছিলেন [৭১ সংবাদ ডট কম,২৩-০২-২০ ]। ‘তদন্তে উঠে আসছে অনেক প্রভাবশালীর সাথে ক্ষমতাধরটির ব্যবসার সম্পর্ক বিষয়ে। বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ ছিল তার [নতুন সময়,২৫-০২-২০]।’
কালো টাকা : কালো টাকা হচ্ছে এ্কটি অবৈধ লেন দেন থেকে প্রাপ্ত আয়, যার উপর ভিত্তি করে আয়কর ও অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি,যা শুধু মাত্র কিছু প্রকারের অর্থ পাচারের মাধ্যমে বৈধ করা যায়।
কালো টাকার সাথে অবৈধ ব্যবসার সম্পর্ক: যে সমস্ত ব্যবসায়ে সীমাহীন লাভ হয়, লেনদেন নগদে হয়, কোন দলিল প্রমান রাখার প্রয়োজন হয় না যেমন, মাদক ব্যবসা,পতিতাবৃত্তি,অবৈধ মুদ্রা লেনদেন, মানি লন্ডারিং, মানব পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, জুয়া বা ক্যাসিনো ইত্যাদি ব্যবসার সাথে কালো টাকার সম্পর্ক একচেটিয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে অস্ত্র চোরাচালান বাদে অন্যান্য ব্যবসাসমূহ প্রায় ঝুঁকিহীন বলা যায় এবং হোটেল ব্যবসাকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে দিব্যি চালিয়ে নেয়া যায়। সে সংগে উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক আমলা, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ গডফাদার ও ধনকুবের ব্যবসায়ীদের যাতায়াত হোটেলে যেহেতু নির্বিঘেœ চলতে দেয়া যায় সেহেতু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ অথবা মাস্তানচক্রের ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বর্তমানে দেশে আবাসিক হোটেল, ম্যাসেজ পার্লার, ফিজিওথেরাপী সেন্টার, ক্যাসিনো ইত্যাদির ব্যবসা বৃদ্ধি পাবার পেছনে কালো টাকা বৃদ্ধি পাবার সম্পর্ক রয়েছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ লাভবান হতে পারতো যদি এ সব ব্যবসায়ে বিনিয়োজিত অর্থ রাতারাতি পাচার না হতো।যেহেতু বিনিয়োজিত টাকাটা কালো অতএব অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এ বিপুল অর্থ পাচার হতেই হবে।
কালো টাকার পরিমান: ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বরকত বলেন, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমান ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এই ৪৬ বছরে বিদেশে অর্থপাচারের পরিমান ৮ লাখ কোটি টাকা [ সাম্প্রতিক দেশকাল, ২২-০৫-২২ ]।’ বছরে পাচারকৃত কালো টাকার পরিমান: ‘২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা ] যুগান্তর,০৪-০৩-২০ ]।’ বিগত সাত বছরে টাকা পাচার বেড়েছে বই কমেনি। বলা যায় বর্তমানে বছরে পাচারকৃত টাকার পরিমান প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা।
হোটেল ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে: ‘সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য অনুযায়ী,দেশে এখন হোটেল রেষ্টুরেন্টের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪। এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৪ [ প্রথম আলো, ১৩-০৬-২১ ]।’
মাদক ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে: ১. মাদক নিয়ন্ত্রন অধি দফতর সম্প্রতি দেশের মাদক গডফাদারদের একটি তালিকা প্রনয়ন করে।দেশ জুড়ে যার সংখ্যা ১৪১ জন। এতে ক্ষমতাধর অনেক রাজনীতিকের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসে [যুগান্তর, ০৮-০১-১৮]। ২. বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি [যুগান্তর, ২৭-০২-২১]। ৩. নেশার পেছনে বছরে খরচ হয় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। অবৈধ মাদক আমদানীতে প্রতি বছর বিদেশে পাচার হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশী [নতুন দিগন্ত,৩০-০৮-২০] ৪. বিশ্বে মাদকাসক্ত বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ, কিন্তু বাংলাদেশে ৩.৮ শতাংশ [ জনকন্ঠ, ০২-০১-১৮ ]।
হোটেলভিত্তিক দেহব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে: দুর্জয় নারী সংঘের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা নগরী এবং আশেপাশে ৪০০ আবাসিক হোটেল ও ৫০টি রেস্ট হাউসে চলছে দেহব্যবসা। এ খাতে মাসে লেনদেন হয় প্রায় ১২ কোটি টাকা। বিগত বছরের তুলনায় দিন দিন বাড়ছে এ ব্যবসা [ কালের কন্ঠ, ২৮-০৫-১১ ]।
হোটেল ব্যবসার আড়ালে মানবপাচার চলছে: আবাসিক হোটেল ব্যবসার আড়ালে চাকুরীপ্রার্থী অসহায় নারীদের জোর করে আটকে রেখে দেহব্যবসা করতে বাধ্য করছে একটি মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে অসহায় নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পাচার করছে চক্রটি [ নিউজ ২৪ ডট কম, ১২-০৯-২১]
ক্যাসিনো এর আড়ালে দেহব্যবসা চলছে: রাজধানীর উত্তরার এক অভিজাত হোটেলে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জামাদি,মাদক ও দেহব্যবসার সংগে জড়িত অন্তত ৩১ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। যার মধ্যে ২৬ জন পুরুষ এবং ৫ জন নারী রয়েছে। র‌্যাব জানায়, উক্ত অভিজাত হোটেলের মালিক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা [কালের কন্ঠ, ২৯-০৩-২১ ]।
অপরাজনীতির সাথে কালোটাকার সম্পর্ক রয়েছে: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ বজলুল করীম মনে করেন,’ রাজনীতি এখন অর্থকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফলে যারা রাজনীতিতে আসেন, তারা মনে করেন,টাকা না হলে টিকে থাকা যাবে না। তাই তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেন টাকা আয়ের উপায় হিসাবে, সেটা বৈধ আর অবৈধ যেভাবেই হোক। এর সংগে রাজনীতির প্রভাবশালীরা যেমন জড়িত, তেমনি পুলিশ বা প্রশাসনের লোকও জড়িত। প্রকাশ হয় তখনই যখন আর সামলানো যায় না [ ডি ডাবলিউ ডট কম, ২৮-০২-২০ ]।
হোটেলভিত্তিক অস্ত্রব্যবসা চলছে: চট্টগ্রামের রাংগুনিয়া থেকে নগরীতে অস্ত্র বিক্রি করতে এসে ধরা পড়েছেন এক রাজনৈতিক নেতা। ক্রেতা সেজে অস্ত্র কেনার ফাঁদ পেতে কৌশলে তাঁকে নগরীর ডবলমুরিং থানার দেওয়ানহাট ডিটি রোডের একটি হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয় [ যুগান্তর,০২-১২-২১ ]।
পর্যালোচনা: উল্লিখিত সংবাদচিত্রসমূহে দেখা যাচ্ছে, কালো টাকা বৃদ্ধির সাথে অবৈধ ব্যবসার বিস্তারের সম্পর্ক রয়েছে। এর সংগে সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ আমলা, ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদ এবং ধনকুবের ব্যবসায়ীরা জড়িত রয়েছে। আড়াল হিসাবে আবাসিক হোটেল, ম্যাসেজ পার্লার, ফিজিওথেরাপী সেন্টার, ক্যাসিনো ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিজাত আবাসিক এলাকাও বাদ যাচ্ছে না। গডফাদারদের হাত এতই লম্বা যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এখানে অসহায়।
উপসংহার: আলোচনার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, কালো টাকার উৎস বন্ধ করতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তবে কালো টাকা যাতে পাচার না হয় এবং অর্থনীতির মূল ¯্রােতে এ টাকা যাতে প্রবাহিত হতে পারে তার জন্য বৈধ কোন উপায় অর্থনীতিবিদদের বের করতে হবে।
লেখক: চর্ম যৌন রোগ ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ