অবাঞ্চিত

38

জোবায়ের রাজু

আম্মা এক প্লেট বিরিয়ানি আমার সামনে এনে বললেন, ‘খেয়ে নে।’ আমি আম্মাকে বললাম, ‘আপনার শরীর খারাপ। কষ্ট করে বিরিয়ানি করতে গেলেন কেন?’ কোনো কথা না বলে আম্মা শুধু হাসলেন। বিরিয়ানি আমার পছন্দ বলে আম্মা প্রায়ই আয়োজন করে আমার জন্যে বিরিয়ানি রাঁধেন। কিন্তু নিজে কখনো খান না। কখনো চেখেও দেখেন না। বিরিয়ানি তার পছন্দ নয় বলে। কত করে বলি, ‘একটু খেয়ে দেখেন।’ কে শোনে কার কথা! সারা দুনিয়ায় সম্ভবত আম্মাকেই দেখলাম, যে কিনা বিরিয়ানির মত উন্নত খাবার পছন্দ করেন না।
বিরিয়ানি খেতে খেতে ফেসবুক ওপেন করলাম। ‘রিনা আক্তার’ নামে একজন আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রোফাইল পিকচারে ভদ্র মহিলার সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে কোনো ধনীর রাঙা বধূ। অ্যাকসেপ্ট করার কিছুক্ষণ পর ভদ্র মহিলা আমায় মেসেজ দিয়ে লিখলেন, ‘তুমি কী শাহনাজ আপার ছেলে?’ ওমা! ভদ্র মহিলা আম্মার নামও জানেন! আমাদের পরিচিত কেউ! আমি রিপ্লাই লিখলাম, ‘জি। আপনি কে?’ আবার মেসেজ এলো, ‘হা হা হা। আমি রিনা। তোমার আন্টি হবো। তোমাদের বাড়িতে অনেক গেছি। তখন তুমি ছোট ছিলে। শাহনাজ আপাকে আমার সালাম দিও।’
রিনা আক্তারের ছবি দেখালাম আম্মাকে। আম্মা ছবির দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, ‘রিনা! আমাদের রিনা! আমার বোন। ও কোথায় আছে এখন?’
রাতে আম্মার কাছে পুরো কাহিনী শুনলাম। সৎমায়ের ঘরে অনাদরে বেড়ে ওঠা আমার আম্মার সৎবোনই হচ্ছে ফেসবুকের এই রিনা আক্তার। বিয়ের আগে আম্মার জীবন ছিল খুবই যন্ত্রণার। সৎমায়ের অনাচারে রোজদিন কাটতো। ঠিক মত ভাত পেতেন না, কাপড় পেতেন না, পড়ালেখায়ও বেশী দূর এগোতে দেয়া হয়নি। এতো কঠিন মুহুর্ত পার করা আম্মা তার সৎবোন রিনাকে বুকের সবটুকু মমতা বিলিয়ে দিতে কখনো কার্পন্য করেননি। বিয়ের পর ওই বাড়ি ছেড়ে আসতে আম্মার যত কষ্ট ছিল, সব নাকি বোন রিনার জন্যই ছিল। রক্তের টান বলে কথা। বিয়ের পর আব্বা মাত্র দুইবার তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছেন। ওই পরিবারে আব্বাকে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হতো না বলে আর সেখানে যাননি এবং আম্মাকেও যেতে দেননি। এই নিয়ে স্বামীর কাছে আম্মার লজ্জার অন্ত থাকত না বলে সব সময় গোপনে কাঁদতেন। জীবনে আমি কখনো নানার বাড়ি যাইনি।
২.
ফেসবুকে আমি এখন আম্মার সেই সৎবোনকে খালা ডাকি। রিনা খালা। ফেসবুকে দারুণ সময় কাটে তার সাথে। রিনা খালা ব্যক্তিজীবনের আলো ঝলমলে খবর জানাতে সব সময়ে প্রস্তুত। তার স্বামী নাকি শিল্পপতি, মার্কেট থেকে কোন শাড়ি কত টাকায় কিনেছেন, তার দুই ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র, আলিশান ফ্ল্যাটে কী কী ফার্ণিচার আছে, এসব হাবিজাবি খবর তিনি মহাউৎসবে জানান। আমি আম্মার কাছে এসব খবর পৌঁছে দেই। বোন সুখে আছে জেনে আম্মা তৃপ্তির হাসি দেন।
আগামীকাল ১৫ তারিখ। রিনা খালার জন্মদিন। কেক কাটা হবে জেলা শহরের গ্রীন হলে। বিরাট আয়োজন হবে। গন্যমান্যরা এসে হল ভরে যাবে। রিনা খালার অনুরোধ, আমি যেনো ওই আয়োজনে হাজির থাকি। আম্মাকে এই তথ্য জানালাম। আম্মা বললেন, ‘যাবি মানে, অবশ্যই যাবি।’
আজ ১৫ তারিখ। সন্ধ্যায় গ্রীন হলে আসার আগে আম্মা আমার হাতে একটি বকুলের মালা দিয়ে বললেন, ‘এটা রিনাকে দিস। ছোটবেলায় ও বকুলের মালা পছন্দ করতো। কত গেঁথে দিয়েছি।’
গ্রীন হলের দ্বিতীয় তলায় এসে আমি মুগ্ধ। বিশাল এক কেক সাজানো। পার্লারের গর্জিয়াস সাজে রিনা খালাকে দেখেও আমি মুগ্ধ। রিনা খালা এতো সুন্দর। হল ভর্তি মানুষ। এতো মানুষের ভিড়ে রিনা খালা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বেশ আন্তরিকতা দেখালেন। বোনের খবরও জানতে চাইলেন। আমি উৎসুক চোখে এই এলাহী কান্ড দেখছি। রিনা খালার বান্ধবীরা তাকে ঘিরে রেখেছে। এককোনে অনেকগুলি বিরিয়ানির প্যাকেট দেখতে পাচ্ছি। বয়রা সেইগুলি টেবিলে সাজাচ্ছে। কেক কাটার পর সবাই আয়েস করে প্যাকেট খুলে বিরিয়ানি খাবে। রিনা খালা আমাকে ডেকে বললেন, ‘আয় আমার সাথে ছবি তুলবি। ফেসবুকে ছাড়তে হবে।’ আমি এগিয়ে গেলাম। আম্মার দেয়া বকুলের মালাটি পকেট থেকে বের করে রিনা খালাকে দিতেই তার বান্ধবীরা অট্টহাসিতে মেতে তাচ্ছিল্যে বলল, ‘সামান্য একটি বকুলের মালা জন্মদিনে কেউ গিফট করে? হিহিহি!’ আমি লজ্জা পেলাম। রিনা খালা বকুলের মালা গ্রহণ করার সময়ে ছোট্ট করে বললাম, ‘আসার সময় আম্মা এটা গেঁথে দিয়েছেন যতœ করে।’
পার্টি শেষে আমি গ্রীন হল বিদায় নিচ্ছি। রিনা খালা হাতে এক প্যাকেট বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা আপার জন্যে নিয়ে যা।’
গ্রীন হলের নিচতলায় এসে দেখি গেটের পাশে পড়ে আছে বকুলের মালাটি। রিনা খালা কখন যে জানালা দিয়ে ওপর থেকে সেটা নিচে ফেলে দিয়েছেন।
৩.
আম্মা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন গ্রীন হলে কী কী প্রোগ্রাম হয়েছে। মোবাইলে তোলা সব ছবিও দেখালাম আম্মাকে। রিনা খালার দেয়া বিরিয়ানির প্যাকেট আম্মাকে দিয়ে বললাম, ‘নেন, আপনার বোন পাঠিয়েছে আপনার জন্যে।’
আম্মা বিরিয়ানি খান না। আমি ধরেই নিয়েছি তিনি এই বিরিয়ানি খাবেন না। কিন্তু ঠিকই প্যাকেট খুলে বিরিয়ানি খাচ্ছেন আর কেঁদে বলছেন, ‘আমি সবটুকু খাবো। এটা আমার বোন পাঠিয়েছে।’ আম্মা বিরিয়ানি খাচ্ছেন আর তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।