অপ্রতিরোধ্য মাদক ব্যবসা! আবারও শুরু হোক লড়াই

55

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভবত জাতীয় এবং স্থানীয় বেশ কয়েকটি দৈনিকে একটি খবর ছাপা হয়। খবরটি ছিল, ওয়াহিদুল ইসলাম স্বপন নামের এক ব্যক্তিকে খুন করেছেন তাঁর স্ত্রী মৌসুমী। একটি ইট দিয়ে মৌসুমী স্বপনের মাথার পেছনে উপর্যুপরি আঘাত হানলে তাঁর মাথা থেঁতলে যায় এবং তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মৌসুমী বলেছেন, মাদক থেকে ফেরাতে না পেরে তিনি স্বামীকে হত্যা করেছেন। স্বামী নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। এতে বাধা দিলেই তিনি স্ত্রীকে মারধর করতেন। নির্যাতন আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই তিনি স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এদের সংসারে নিলয় নামের কলেজপড়–য়া একজন ছেলে আছে। উপরোক্ত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণে যেটি প্রতিয়মান হওয়া যায়, শুধু মাদক নামক নেশা একটি জীবনকে নিঃশ্বাসহীন করেছে, একটি জীবনকে লৌহকপাটে বন্দি করেছে। আরেকটি সম্ভাবনাময় জীবন প্রিয় মা-বাবার ¯েœহ ও ভালোবাসার আঁচলছেড়া হয়ে হতাশার জীবন খুঁজে নিয়েছে। একজন সাধকের অমূল্যবাণী হচ্ছে, তুমি যদি কাউকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে তার সামনে এক পিয়ালা শরাব (মদ)দিয়ে দাও। আজ আমাদের যুব সমাজ মাদক নামের নেশার পেছনে নিজেদের সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে, আর নেতৃত্ব ও মেধাশূন্য হবে দেশ-এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান সরকার প্রধান মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন গত বছরের শুরুতে। ব্যাপক অভিযান, ধরপাকড় ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্যে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহার কিছুটা কমলেও সম্প্রতি করোনাকালে অভিযান কিছুটা স্তিমিত হওয়ার পর আবারো মাদকের ব্যবসা ও ব্যবহার সমানতালে বেড়ে গেছে তা সাম্প্রতিক বেশকিছু ঘটনাপ্রবাহ থেকে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। বিশেষ করে, বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় এ মাদক ব্যবসার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে, আর রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিরাপদ আস্তানা হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বান্দরবান সীমান্তসংলগ্ন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম দিয়ে অবাধে আসছে ইয়াবা, হেরোইন, ড্রাইজিন ও হুইসকিসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যেও রোহিঙ্গা ক্যাম্প মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, এসব ব্যবসায়ী শুধু মাদকের ব্যবসাই করছেনা তাদের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্রও আসছে দেশে। এতে একদিকে যেমন আমাদের যুব ও তরুণসমাজের ধ্বংসের আশঙ্কা করা হচ্ছে, অপরদিকে দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার বিষয়টি সামনে চলে আসছে। মিয়ানমার সীমান্তে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার ঘটনা নতুন না হলেও সরকারের ব্যাপক াভিযানেও তা বন্ধ না হওয়ায় আজ প্রশ্ন এসেছে, তা হলে মাদক ব্যবসায়ীদের শিকড় কত গভীরে! সরকারের কঠোরতার মধ্যে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হওয়ায় দেশবাসীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে চলছে। আমরা জানি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ অনুযায়ী, অ্যালকোহল ছাড়া অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি, রপ্তানি, সরবরাহ, কেনা, বিক্রি, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার করা যাবে না। এই আইন ভঙ্গকারীদের জন্য যাবজ্জীবন থেকে শুরু করে মৃত্যুদÐের বিধান রাখা হয়েছে। অথচ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাদকের অবাধ ব্যবসা চলছে। এমন অভিযোগও রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা বা কমিশন আদায় করেন পুলিশের সদস্যরা। সীমান্তে চলছে মাদকের অবৈধ জমজমাট ব্যবসা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের চোখের সামনেই। দেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় পৌনে এককোটি মানুষ মাদকাসক্ত। তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ পুরুষ, ১৬ শতাংশ নারী। আর দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোরেরাও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ। যার মধ্যে ৯০ শতাংশ কিশোর ও তরুণ। মাদকাসক্তদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। পথশিশুদের একটি বড় অংশ মাদকে আসক্ত।
আমরা মনে করি, মাদক ব্যবসা ও ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে আবারও কঠোর হতে হবে। তবে শুধু সরকার কঠোর হলে চলবে না, পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকেও সচেতন হতে হবে। সর্বনাশা এই মাদককে রুখতেই হবে।