অপ্রতিরোধ্য বন ধ্বংসের প্রতিযোগিতা

2

নিজস্ব প্রতিবেদক

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, বন ধ্বংস করে উন্নয়ন করা যাবে না। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের যেটুকু বনাঞ্চল আছে সেটার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি খালি ও পতিত জায়গায় গাছ লাগাতে হবে। ‘বন সংরক্ষণের অঙ্গীকার, টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার’ প্রতিপাদ্যে গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক বন দিবস উপলক্ষে বন অধিদপ্তরে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামেও উদযাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বন দিবস। এ উপলক্ষ্যে নগরীতে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। গতকাল সকালে আয়োজিত র‌্যালিতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন। র‌্যালিটি নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে চট্টগ্রাম বন অঞ্চলের বন সংরক্ষকের দপ্তরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগীয় কর্মকর্তা সফিকুল ইসলামসহ বন অঞ্চলের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
ভূমি মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য, সামুদ্রিক মৎস্য ও বন্যপ্রাণী গবেষণার জন্য কক্সবাজারের দরিয়ানগরের ঘন জঙ্গল চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স ইউনিভার্সিটিকে ইজারা দেয় সরকার। ২০১৮ সালে পাঁচতলা ডরমিটরি তৈরির কাজ শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক নেতারা কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে ৪৪টি কক্ষের এ ডরমিটরিতে রাতযাপন করেন। যে এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটি বিপন্ন এশীয় হাতি, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বন্য কুকুর ও বানরের আবাসস্থল। এভাবে দেশের বনভূমি ধ্বংসে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ২৪০ একর বনভূমি। আর ৯০ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে জবরদখল করেছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভূমি। এ হিসাব বন বিভাগের। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যাদের বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই একর, দেখা যায় বাস্তবে তারা ৮/১০ একর দখল করে বসে আছেন।
এভাবে দেশে প্রতিদিন কমছে সবুজ। বাড়ছে দালানকোঠা, রাস্তাঘাট ও বসতি। কোথাও আবার গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও বনের ভেতরেই ইটভাটার চুল্লিতে জ্বলে কাঠ। বন ধ্বংসের ঘটনায় মামলা ও আদালতের রায় মানা হচ্ছে না। এ অবস্থায় গতকাল পালিত হয় বিশ্ব বন দিবস। দিবসটি ঘিরে সরকারি ও বেসরকারি নানা সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
দেশে বনভূমি কমে যাওয়ার তথ্য ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর প্রকাশ করে বন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভ‚মি বেদখল হয়ে আছে বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। সবচেয়ে বেশি বনভ‚মি বেদখল হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। জেলাটিতে ৫৯ হাজার ৪৭১ একর বনভূমি বেহাত হয়েছে। বেদখল হওয়া বনভূমির তথ্য জানালেও কারা এসব জমি দখলে রেখেছেন- তা জানায়নি বন অধিদপ্তর।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অধিদপ্তর কর্তৃক সর্বশেষ পাঁচ বছরে মাত্র আট হাজার ৭৯২ একর (৩%) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ন কাজের নামে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে বন মন্ত্রণালয়। বড় বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা), বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি), গ্যাসক্ষেত্র ও সড়ক কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে ধ্বংস হওয়া বনভূমি এ হিসাবের বাইরে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের বনভূমি নিয়ে এক বছর ধরে গবেষণা করছে। এতে ১৯ মার্চ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে উঠে এসেছে, কক্সবাজারে বন ধ্বংসে এগিয়ে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। জেলার দুই লাখ ৬০ হাজার ৪৬ একর বনভূমির মধ্যে দখল হয়ে গেছে ৪৫ হাজার ৯৯০ একর জমি। অবৈধ দখলদার ৪৩ হাজার ৫৬৮ ব্যক্তি ও ৬৯৬ প্রতিষ্ঠান। রোহিঙ্গাদের দখলে যাওয়া জমির পরিমাণ ছয় হাজার ১৬৪ একর।
গবেষণায় দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ১৪ হাজার ৩৭২ একর বনভূমি। বন বিভাগ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করা হয়েছে ১০ হাজার ৪৬০ একর। সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) আট হাজার ৮৮৪ একর, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে ২০২ একর ও ডুলাহাজারা খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হসপিটালকে ১৪ একর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বরাদ্দের তালিকায় আছে হর্টিকালচার, সড়ক ও জনপথ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, আবহাওয়া অধিদপ্তর, পর্যটন করপোরেশন, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বেশ কিছু সংস্থা। সব প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১৯২৭ সালের বন আইন দিয়ে এখনও বন বিভাগ চলছে। এ আইনে নেই বনের সংজ্ঞা, বনের ধরন, বন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন কাজে বনের জমি ব্যবহার এবং বরাদ্দ প্রদানের বিষয়। এ-সংক্রান্ত কোনো বিধিমালা নেই। ফলে ঢালাওভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বনভূমি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বন আইন যুগোপযোগী করা দরকার। দায়িত্ব ও কর্তব্য সে আইনে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। সংরক্ষণভিত্তিক বন করা দরকার। বনকে বন ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। একান্ত প্রয়োজনে বন ব্যবহার করতে হলে, সেখানে কী রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়- সেটি আইনে থাকতে হবে। আইনে আছে, জলাশয় ভরাট করা যাবে না, পাহাড় কাটা যাবে না। কিন্তু বন কাটা যাবে না- এ রকম আইন নেই।
রিজওয়ানা হাসান ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বনবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ‘ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট-২০০৬’ করা হয়েছে। আর আমাদের দেশে বনবাসীদের ওপর ঐতিহাসিকভাবে অবিচার করা হয়েছে। আমাদের বন বিভাগ বলছে, এরা দখলদার।