অপরাজেয় একাত্তর

70


আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের অস্থিমজ্জায় আর আমাদের রক্ত ধারায় মিশে আছে একটি নাম বাংলাদেশ। একটি সাল ১৯৭১। মায়ের গর্ভে যেমন আগামীরা থাকে, তেমনি বাংলাদেশের বুকে ৭১ থাকবে। যতদিন না থাকবে রবি ঠাকুরের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, নজরুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, জীবনানন্দের ধান সিঁড়ি আর শামসুর রাহমানের অবিনাশী গান।
১৯৭১ একটি সাল। বিশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত, বিশ্বজুড়ে আলোড়িত, হাসি-কান্না, দুঃখ বেদনায় সিক্ত সাল ১৯৭১। সালটির অংক কয়টি পাশাপাশি যোগ করলে দাঁড়ায় ১৮। আবার চার অংক বিশিষ্ট এ সালটির প্রথম দুই অংকের সমষ্টি আর দ্বিতীয় দুই অংকের সমষ্টির বিয়োগ ফল হলো ২। ১৮ কে যদি আমরা ২ দ্বারা ভাগ করি তাহলে যে ফল পাই তা হলো ৯। আর নয় অংকটাকে যদি একটু জোর দিয়ে উ”চারণ করি যা দাঁড়ায় তা হলো ন-অয়-মানে হতে পারে না। কিন্তু আমরা পেরেছি। শুধু তাই নয়, আরো মজার বিষয় হলো আমরা এই বাঙালিরা এই ন-অয় কে হয় করে ছেড়েছি। তাও নয় মাসের কম সময়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাত থেকে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর সূর্যের আলো ফোটার আগেই। এই হিসেবে মাত্র ৮ মাস ১৯ দিনের মাথায় আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়ে পৃথিবীর দ্রুততম স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছি। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি বড় কৃতিত্ব কোন দেশ বা জাতির জন্য আর কিছুই হতে পারে না। আমরা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছি তিতুমীর-সূর্যসেন-মুজিবের দুর্জয় ঘাঁটি বাংলার মাটির মানুষেরা সবই পারে। পারে স্বাধীনতার মতো মহার্ঘ, দুর্লভ প্রাণের তাগিদকে সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আপন করে নিতে।
পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা একটি পতাকা, একটি সুন্দর সমৃদ্ধশীল ভূখÐ, আর সাড়ে সাত কোটি সোনার মানুষ পেয়েছি। কিন্তু এই পাওয়ার বিনিময়ে আমাদের যা কিছু দিতে হয়েছে তা চাক্ষুষ্মান ব্যক্তি ছাড়া অন্যের কাছে আকাশ কুসুম হতেই পারে। কী বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্য দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের একেকটা দিন আর একেকটা রাত কেটেছে তা ভাবতেই হাজার হাজার মানুষ আজও শিউরে উঠে। কবির কল্পনা আর আবেগ হার মানে সে সব দিনের কাছে। শিল্পীর তুলি, ভাবুকের ভাবনা আর গানের কথায় তার কতটুকুই বা ধারণ করা যায়। তবু কবি কবিতা লেখেন, গল্পকার গল্প বলেন, উপন্যাসিক উপন্যাস রচনা করেন। নাট্যকার নাটক আর শিল্পী ছবিতে প্রাণময় করে তোলার চেষ্টা করেন একাত্তরের সে হার না মানা দিনগুলোর কথা। ১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ মধ্যরাত। নিরস্ত্র মানুষের উপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা চিরতরে মুছে দিতে তারা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় নির্বিচারে মানুষ মারা শুরু করে। বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। দু’টো হাত ছাড়া তাঁদের আর কোন হাতিয়ার ছিল না। তার ওপর ঘনঘোর রাত। পালাবার এতটুকু পথ খোলা নেই- জানা নেই গন্তব্য। প্রথমে ঢাকায়, তারপর চট্টগ্রাম, একে একে বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ল এই হত্যাকান্ড। একজন মানুষ, আরেকজন মানুষকে এভাবে পিঁপড়ের মতো মারতে পারে। একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে বেয়নেটে খোঁচাতে পারে। বুকটা ঝাঁঝরা করে দিতে পারে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ ১৯৭১। এই যে শুরু নির্বিচারে মানুষ হত্যা তাতে কয়েকদিনের মধ্যেই গোটা দেশ মহাশ্মশানে পরিণত হয়। এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে প্রতি মূহূর্তে মানুষের কাছে হয়ে উঠে বিভীষিকাময়। হায়েনার ট্রাক আর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিতে ১,৪৭,৫৭০ বর্গমাইলের পঁয়ষট্টি হাজার গ্রাম প্রতিদিন প্রতি মূহূর্ত রক্তাক্ত হয়। যে মেয়েটির হাত মাত্র গতরাতে মেহেদীর রঙে রঞ্জিত হয়। রাত না পেরোতেই দেখা যায় তার লাশ পড়ে আছে পানের বরজে। দরদর করে খুন ঝরছে আর সে খুনে পুষ্পিত মাটি লালে লাল হয়ে উঠেছে। যে কৃষাণের কাল মাঠে লাঙ্গল চষে বেড়ানোর কথা ছিল সেও নেই- পড়ে আছে উঠানের মধ্যখানে লাঙ্গল আর মাথাল। সে ভাইটির কাল ভোরে শহরের যাওয়ার কথা ছিল, কথা ছিল মায়ের জন্য সাদা নামাযের শাড়ি কিনবে। তাতো তার কেনাই হলো না, উপরন্ত নিজেই সে সাদা শাড়ির ছায়ায় শায়িত হলো পরীর দিঘির পাড়ে।
দু’ এক মাসের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারা দেশটাকে হিরোসীমা-নাগাসাকি বানিয়ে ছাড়ল। একদিকে হিংস্র শকুন, অন্যদিকে ঘরের শত্রট্ট বিভীষণ। যে দিকে তাকাই নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি। মাটি ছাড়া এ বাংলার আর কিছুই রাখবে না। এ ছিল তাদের ধনুক ভাঙা পণ, আর তাই তারা নির্বিচারে মানুষ মেরেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা আর সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ী। তছনছ করেছে মুক্তিকামী জনতার ভিটেমাটি। লুট করেছে সোনা-গহনা, টাকা কড়ি। শুধু তাই নয় তাঁরা আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে। হাজার হাজার বোনকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে। সংসার ভেঙেছে হাজারো নারীর। জীবনের সমস্ত সুখ আহলাদ চির জীবনের মতো কেড়ে নিয়েছে অগুণিত মা-বোনের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এসব বর্বরতা আর অপকর্মে ইন্ধন যুগিয়েছে, সার্বিক সহযোগিতা করেছে, পথ দেখিয়েছে এ দেশের বাঙালি নামের কলংক কিছু কুলাঙ্গার। যারা রাজাকার, আল বদর, আল সামস্ নামে পরিচিত। এদের প্রত্য সহযোগিতা না পেলে পাকিস্তানি নর পিশাচদের দ্বারা কখনো সম্ভব হতো না এ সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করা। সম্ভব হতো না তরতাজা মুক্তিকামী জোয়ানকে ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা। সম্ভব হতো না হাজার হাজার মা-বোনকে বে আবরু করা। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ল ল ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া। বৃদ্ধা পিতা-মাতাকে বেয়নেটে খুঁচিয়ে মারা। আর তাই কম সময়ে আমরা পাকিস্তানি হায়েনাকে পরাভূত করতে পারলেও আমাদের অর্জনের চেয়ে বিসর্জনের পরিমাণ খুবই বেশি। এক সাগর রক্ত, ত্রিশ ল শহীদ, ত্রিশ ল মা-বোনের ইজ্জত, অগণিত মানুষের পঙ্গুত্ব; সমান একটি পতাকা। মাত্র ৮ মাস ১৯ দিনে একটি দেশের জন্ম, একটি অপুষ্ট শিশুর জন্মের মতোই সীমাহীন প্রসব বেদনার ফসল। এ ফসল ঘরে তুলতে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐ অপুষ্ট শিশুর মায়ের মতোই দুঃসহ বেদনায় কাতরাতে হয়েছে। প্রতি পলকে ম”ত্যুর হাতছানি নিয়ে এগুতে হয়েছে। দেখতে হয়েছে মায়ের আহাজারি, বাবার আর্তনাদ, বোনের বুকভাঙা বিলাপ- যা হিরোসীমা, নাগাসাকিকেও হার মানিয়েছে। তবু জানাতে হয় অভিবাদন। সকল দুঃখ, ত্যাগ, তিতিা, কষ্ট ভুলে একটা নতুন সূর্যের অভ্যূদয়ে।-
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ
তুমি ফিরে এসেছো তোমার লাল সূর্য আঁকা পতাকার ভেতরে
যার আলোয় এখন রঞ্জিত হয়ে উঠছে সাহসী বদ্বীপ। (সৈয়দ শামসুল হক)

লেখক : শিশু সাহিত্যিক, প্রবন্ধিক