অপচয় কমিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে আসুন

3

 

যে জন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি
আশু গৃহে তার দেখিবে না আর
নিশীথে প্রদীপ ভাতি।
কবিতাংশটি কার লেখা এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। তবে একটি বিষয় খুব ভালো করে মনে পড়ছে ছাত্রজীবনে এ চারটি পঙক্তির অনেক বার ভাবস¤প্রসারণ করেছি। আক্ষরিক অর্থে এ চারটা পঙক্তির সহজ ব্যাখ্যা হলো, কোনো লোক বা পরিবার যদি শুধু মনের আনন্দ বা যেমন খুশি তেমন করার অভিপ্রায়ে দিনের বেলায় আলো জ্বালিয়ে রাখে একদিন দেখা যাবে রাত নিশীথে অতি প্রয়োজনের সময় তার ঘরে আলো জ্বালাবার সামর্থ্য থাকবে না। আর যদি আমরা কবিতাংশের গভীরে যাই তাহলে বুঝতে পারব এর বিস্তৃতরূপ। পঙক্তি কয়টিতে অপচয়ের সুদূরপ্রসারী ফল সম্পর্কে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি দেশকে সতর্ক করে সচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
অপচয় এমন একটি শব্দ যার মধ্য নিহীত আছে অনেকগুলো ব্যাপার। ব্যক্তির মর্জি বা ইচ্ছায় এ বিষয়টির অবতারণা হলেও এর অর্থনৈতিক ও পারিপাশ্বিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু সুদূরপ্রসারী। আমরা সবাই কমবেশি অপচয়ের সঙ্গে জড়িত। খেয়াল করলে দেখা যাবে আমরা অনেকটা ইচ্ছে করে পানির কলটি বন্ধ করি না। আর করলেও ভালোভাবে করি না। মনে করে থাকি কয়েক ফোঁটা পানি পড়লে তেমন আর ক্ষতি কি? অথচ আমরা নিজেরাই আবার পাÐিত্য জাহির করতে গিয়ে স্বগর্বে কবিতা আওড়াই, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকণা / বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ে তোলে মহাদেশ/ সাগর অতল। ঘরের গৃহিণীরা মাত্র একটি ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলোটি জ্বালিয়ে রাখেন। এর পরিণাম কী অফুরান ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে তা আজ শহুরে মানুষেরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। গ্যাস প্রকৃতির দান। মানুষ চাইলেই এর মজুদ বাড়াতে পারে না। প্রকৃতি প্রদত্ত এ সম্পদ সুষ্ঠু ও সঠিক ব্যবহারের উপর নির্ভর করে এর মেয়াদ। আমরা যদি গ্যাস ব্যবহারে মিতব্যয়ী হই, অপচয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকি তাহলে প্রকৃতি প্রদত্ত এ নেয়ামত হয়তো অনেকদিন ভোগ করতে পারব। আর যদি গ্যাস ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারি হই তাহলে অচিরেই গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসবে অথবা গ্যাসসংকট নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
এবার আসা যাক বিদ্যুতের কথায়, বিদ্যুৎ থাকলে আমরা অনেক সময় অপ্রয়োজনে বাতি জ্বালিয়ে রাখি। নামি দামি মার্কেটে গেলে বোঝা যায় কী পরিমাণ বিদ্যুৎ এরা রাতদিন অপচয় করে চলেছেন। একটা বাতি যেখানে প্রয়োজন সেখানে পাঁচটা, দশটা বাতি যেখানে দরকার সেখানে বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে একশটা। এ বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিল তারা দিয়ে থাকলেও এটা মোটেই ন্যায্য নয়। অথচ সে সময় লোডশেডিং এর ধকলে পড়ে অন্য এলাকার হাজার হাজার মানুষ বিদ্যুতের অভাবে তাদের অনেক জরুরি কাজকর্ম করতে পারেন না। এ হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয়ের দু, একটি চালচিত্র।
এবার আসা যাক, বাঙালির রসনা বিলাস এবং বিপুল পরিমাণ খাবার অপচয়ের কথা। বিয়ের অনুষ্ঠানে সবার জন্য সমান মাংস এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়। সাধারণত মুরগির মাংস, খাসির মাংস, গরুর মাংস, ঝাল মাংস, চাইনিজ সবজি বা মুগডাল সবার জন্য সরবরাহ করা হয়। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে শতকরা ২৫ জন থাকে ছোটো ছোটো শিশু। যাদের সবার পাতে বয়স্কদের মতো সব আইটেম তুলে দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায় মেহমান বা বর-কনে পক্ষ কিছু মনে করতে পারে এ ভয়েও সবার পাতে সবকিছু পরিবেশন করা হয়। এতে ছোটোদের যতটা আগ্রহ তার চেয়ে বেশি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় মা-বাবা -অভিভাবকদের। তারা যেন তাদের ছেলেমেয়েদের আজকের জন্য খাওয়াবেন আর কোনোদিন খাওয়াবেন না। এ মানসিকতায় সবার পাতে সমান খাবার দিতে গিয়ে পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি খাবার অপচয় হয়। পাশাপাশি বড়রা নষ্ট করে শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি খাবার। এভাবে প্রতি হাজারে ৩২৫ জনের মতো খাবার নষ্ট হয় – যা গরিব দেশে একটা বড় ধরনের অপচয়। অর্থমূল্যে এ অপচয়ের পরিমাণ ১,৩০,০০০ টাকা। আর বাড়তি বর্জ্যরে পরিমাণ আনুমানিক ১৬২ কেজি। শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোর সামনে যদি ডাস্টবিন থাকে এবং বিকালে বা সকালে কারো দেখার সুযোগ হয় তাহলে উচ্ছিষ্টের পরিমাণ এবং পরিবেশের যে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা আঁচ করতে পারা যায়।
এভাবে প্রতিনিয়ত খাবারের অপচয় হচ্ছে দেশে বিদেশে বিশ্বব্যাপী। শুধু খাবার টেবিলে নয় -খাদ্য অপচয় হয় রান্নাবান্নায়, অপচয় হয় কাটার সময়- ধোয়ার সময়। অপচয় হয় ক্ষেত থেকে শুরু করে টেবিলে বা পাতে উঠা পর্যন্ত। আবার নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও অনেক খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়। এটাকে অপচয় বলা না গেলেও খাদ্যের মজুদ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। খাদ্য অপচয়ের যেসব পরিসংখ্যান মাঝেমধ্যে পত্রিকার পাতায় পরিলক্ষিত হয় তা রীতিমত গা শিউরে উঠার মতো। অথচ পৃথিবীর অঞ্চল বিশেষে খাদ্য সংকট লেগেই আছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ৩০% থেকে ৫৫% খাদ্য প্রতি বছর নষ্ট বা অপচয় হয় নানাভাবে। পৃথিবীর মোট খাবারযোগ্য খাদ্যের ১.২ থেকে ২.৫ বিলিয়ন টন খাদ্য মানুষের মুখে উঠতে পারে না। এগুলো নষ্ট বা অপচয় হয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে গিয়ে পরিবেশের দূষণ ঘটায়। শুনতে অবাক লাগলেও এ পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে পানি খরচ হয় প্রায় পাঁচশত পঞ্চাশ বিলিয়ন কিউবেক মিটার পানি। যেহেতু ঐ উৎপাদিত খাদ্য ভোক্তার কাজে লাগেনি সেহেতু ঐ পানিও অপচয়ের তালিকায়। পানির এ অপচয়ের ফলে আমরা নিরাপদ বা সুপেয় পানির সংকটে ভুগছি। পৃথিবীতে এখনও অনেক অঞ্চলের মানুষ খাবার জন্য নিরাপদ পানি নিয়মিত পায় না। আগামীদিনে মানুষের জীবনে নিরাপদ পানির সংকট আরো তীব্র হবে এ বিপুল পরিমাণ পানির অপচয়ের ফলে।
অপচয় মানেই ক্ষতি, সম্পদের ক্ষতি, অর্থের ক্ষতি। বিপুল বর্জ্যের সৃষ্টি এবং তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শুধুমাত্র একটি সাধারণ পরিবারে যে পরিমাণ উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য তৈরি হয় তা যদি পুরো দেশকে মিলিয়ে হিসাব করা হয় তার পরিমাণ কী দাঁড়ায় এই দেশের জন্য কম ভাবনার নয়। তাই আসুন আমরা অপচয় সম্পর্কে সচেতন হই। পরিবেশে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন কর্মকাÐ থেকে নিজেদের বিরত রাখি। বাড়িতে বা কোনো উৎসবে খাবার টেবিলে বসে ভেবেচিন্তে যেটুকু খাবার প্রয়োজন সেটুকু নিই। এমন কোনো খাবার নেওয়া উচিত হবে না যে খাবার খেতে পারব না -থালায় রেখে দিতে হবে। থালায় রেখে দেওয়া খাবার তো অন্য কেউ খাবে না। নিজের পাত থেকে তুলে রাখা খাবার অবশ্যই উচ্ছিষ্ট এবং অপচয়। অপচয় মানে কিছু মানুষের পাতে খাবার পৌঁছে দিতে না পারা। এ অপচয় কমাতে পারলে আমরা ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবীকে গদ্যময় হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারি। সুতরাং ব্যক্তির জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য সর্বোপরি পৃথিবীর তাবৎ অভুক্ত মানুষের জন্য এবং পরিবেশের সুক্ষার জন্য আমাদের সকলের অপচয়রোধে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক