অন্ধজন

23

– চিনি ছাড়া চা খাচ্ছ। কেমন হল কে জানে !
– চা খাচ্ছি এটাই আসল! চিনি ছাড়া চা শরীরের জন্য ভালো।
– চা পাতাও শেষের দিকে।
মতিন সাহেব চায়ের কাপটায় চুমুক না দিয়েই টেবিলে রেখে দিলেন। চা-তে যে চিনি নেই মনে হচ্ছে বিষয়টা এখন তার জিহŸা গভীর ভাবে টের পেয়েছে। চোখের চশমাটা খুলে পকেটে থাকা রুমালে বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা কপাল মুছলেন। এই রুমালটা সব সময় যত্ন করে তিনি পকেটে রাখেন। বাসর রাতে এই রুমাল স্ত্রী থেকে উপহার পেয়েছিলেন। বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়। মতিন সাহেবের উচ্চ বংশ এবং শহুরে চাকরি দেখে মেয়ে পক্ষ এক কথাতেই রাজি হয়েছিল। ৩০ বসন্ত আগের কথা এসব। এখন তার শুভ্র চুল। গোঁফে পাক ধরেছে বহু আগেই। মাস ছয়েক আগে অফিসের ম্যানেজার তার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়।
– আমার উপরে রাগ রাখবেন না প্লিয! আমি মালিক পক্ষের গোলাম। আপনি এ্যাকাউন্টস থেকে বাড়তি দু মাসের বেতন নিয়ে যাবেন। সব বলা আছে। ফ্যানের নিচে ও তার কপালে এমন ঘাম জমেছিল। রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।
– করোনায় কোম্পানী বন্ধ থাকায় বহু লোক সান হয়েছে। এত কর্মীকে বেতনে আরো ১ বছর রাখা সম্ভব নয়। আপনার তো বয়স হয়েছে এখন বিশ্রাম দরকার।
চাকরি যাবার পর ব্যাংকে জমানো কিছু টাকায় সংসার চলছে। বাড়ি ভাড়াও বাকি পড়েছে ২ মাসের। বের হবার আগে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখেন বাড়িওয়ালা নীচে আছে কিনা যাতে মুখোমুখি না হতে হয়।
– এত চিন্তা কেন করছ! ফরহাদ একটা চাকরি পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
– এই বাজারে চাকরিকী এত সহজ! সারা জীবন অনেষ্ট থেকেও কাউকে তেল দেইনি। আজ তাই ছেলের চাকরির সুপারিশের জন্য কেউ নেই! প্রাইভেটভার্সিটি থেকে টেক্সটাইলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেল মার্চেন্ডাইজিং এ ১০,০০০ টাকার বেতনেতাও সেটা ছেড়ে দিল।
– এভাবে বলছ কেন। চাকরিটা তো আর ইচ্ছে করে ছাড়েনি। দিন নেই রাত নেই অমানবিকের মত ছেলেটাকে খাটাতো। এখনতো সরকারি চাকুরির জন্য পড়ছে। দেখবে পেয়ে যাবে।
দরজায় কারো সাথে কথা বলার শব্দ হচ্ছে। কে এসেছে এই সময়ে ? মেহমান এলে রক্ষে নেই।
– ফরহাদ কার সাথে কথা বলছিস ?
ফরহাদ চশমা মুছতে মুছতে বাবার কাছে এল।
– পাড়ার ছেলেরা এসেছিল ত্রাণ নিয়ে। সয়াবিন তেল, আলু, ডাল, আর ৩ কেছির মত চাল।
মতিন সাহেবের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠলো।
– কী যে বলবাবা !
– কেন নিসনি? সংসার কিভাবে চলছে তা জানিস? খাচ্ছিস তো বাবার ঘাড়ে। টের পাবি কিভাবে!
ফরহাদ মাথা নীচু করে রইল।
-প্রথমে নিয়ে ছিলাম পরে ওরা যখন এসব নিয়ে ছবি তুলতে চাইলুখন জোর করেই ফেরত দিয়েছি।
গলায় কান্নাটা এসে জমে গেল। চোখ যেন বাধ্য হচ্ছে না। মতিন সাহেব কথা না বলে ব্যালকনিতে চেয়ারে বসলেন। সন্ধ্যার আবছা কালোয় রক্ত চন্দনের লাল রক্তে থোকায় থোকায় সেজেছে আকাশ। পাখিদের যেন ঘরের ফেরার তাড়া বেড়েছে। শিশিরের মত শব্দে অশ্রু গড়াচ্ছে চোখ থেকে।
অনেকক্ষণ পার হওয়ার পর চোখ মুছলেন। শরীরটা বড্ড খারাপ যাচ্ছে গত তিনদিন যাবত। কাউকে কিছুই বলেননি। তবে জ্বরটা এবার প্রকাশ্যেই এল।
– এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লে যে ?
– শরীরটা বড্ড খারাপ, জ্বর এসেছে।
থার্মোমিটার নিয়ে স্ত্রী কাছে আসতেই দূর থেকে স্ত্রীকে থামালেন।
– কী পাগলামি করছ !
– সময় ভালো না। যদি আমার জন্য তোমাদের কিছু হয়ে যায়!
তার স্ত্রী দ্রুত ফরহাদের কাছে গেল।
– দেখতো! তোর বাবার জ্বর আজ কয়দিন ধরে। কিছুই বলেনি, এখন কাছে যেতে দিচ্ছে না।
– মা কিছু টাকা দাও। কিছু গ্লাভস, মাস্ক আর বাবার জন্য প্যারাসিটেমল নিয়ে আসব।
ফরহাদ কিছু গ্লাভস আর মাস্ক আনলো। জোর করে মাকে এসব পরিয়েছে। এরপর সারারাত দুজন তার পাশে ছিল। শরীরের তাপমাত্র প্রথমে কম হলেও পরে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। প্রথমে ভয়না পেলেও বাবর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বাবাকে নিয়ে ভীষণ ভয় শুরু হয়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য বের হয়ে যায়। ভাগ্য জোরে পেয়েও যায় দ্রæত। জ্বরের কথা শুনে ড্রাইভার রোগীকে চার তলা থেকে নীচে নামাতে সাহায্য করতে চায় না। দুই তলায় বাড়িওয়ালাকে বললে সে মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাকিরাও এগিয়ে এল না। শেষে বাবাকে কাঁধে বয়ে একাই নামালো। সারাদিন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘুরেছে। ড্রাইভার ভীষণ বিরক্ত। চোখের ভ্রু কুচকে গেছে তার। মতিন সাহেবের স্ত্রী কেবল সূরা ইয়াসীন পাঠ করে যাচ্ছে সমানে। অক্সিজেনও শেষ। মতিন সাহেব কাটা গরুর মত খানিক বাদে বাদে শরীর ঝাকিয়ে লাফ দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে ফরহাদকে ইশারা করল অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিতে। আধো-আধো স্বরে কিছু বলতে চাইছেন। ফরহাদ কাছে কান নিল। বাবা কি বলতে চাইছেন ?
– শোন ফরহাদ! গত সপ্তাহে স্বপ্নে দেখি তোর সরকারি চাকুরীটা হয়েছে। যতদিন বাঁচবি সততা নিয়ে থাকবি। সততার চেয়ে বড় অলংকার জীবনে আর কিছু নেই।
ফরহাদ বাবার হাত ধরে রইল। ধীরে ধীরেতা ক্রমশহিম হয়ে আসছে। নিজের হাতের তালু দিয়ে বার বার বাবার হাতের তালু ঘষছে কখনো পায়ের তালু। ফরহাদের মা আরো জোরে জোরে সূরা ইয়াসিন পাঠ করা শুরু করল। ফরহাদ জীবনে অনেক মিরাকলের কাহিনী শুনেছে চাইছে এখন এমন কিছু হোক। এক সময় ফরহাদ বাবার হাত ছাড়লুতক্ষণে তিনি এই জন্মের দাবি মিটিয়েছেন। পরম মমতায় বাবার মুখে বারবার হাত বুলাতে লাগল। জন্ম- মৃত্যুর মাঝে এই টুকুই বুঝি ব্যবধান! এ্যাম্বুলেন্স বাসার দিকে রওনা দেয়। ফরহাদের মা কাঁদছেন। ফরহাদের ইচ্ছে করছে মাটিতে লুটিয়ে কাঁদতে কিন্তু এখন অনেক কাজ। মৃতের গোসল, জানাযা, দাফন, আত্মীয় স্বজনদের খবর দেয়া। মুয়াজ্জিন আর ইমাম সাহেব গোসল দিতে রাজি হলেন। জানাযা শেষে মুয়াজ্জিন তারদিকে চেয়ে বলল, খাটিয়া ধরতে আরেকজন লাগে যে বাবা !
পেছন থেকে একজন তার দিকে ছুটে এল। দেখেই বোঝা যায় সরকারি পিয়ন।
– আপনার নাম ফরহাদ জামিল ?
– জি !
– চিঠি আছে।
খাম খুলে ফরহাদ দেখে অডিট ভবনে তার অডিটর পদে যোগদানের অফার লেটার। চৈত্রের শোকে মাখা তপ্ত রৌদ্রের মাঝে এই শ্রাবণধারা ও তার মনের খরাকে বিন্দুমাত্র ভেজাতে পারলনা। আচমকা তার মনেএল- মৃত্যু আছে বলেই জীবন সুন্দর এবং পরিপূর্ণ নয়তো তা অবসাদগ্রস্থ হত। বেঁচে থাকাকেই স্বার্থক করে মৃত্যু তাই একে গ্রহণ করা উচিত সে যত কঠিন হোক।
-ভাই আমার বাবার লাশের খাটিয়া ধরার লোক নাই।
-দূর থাইকা যখন দেখলাম জানাযায় লোক নাই তহন বুঝলাম বেবাকে ডরাইছে। মানুষগুলা নটাহার লাইগা পাগলা ঘোড়ার লাগান ছুটে। মানুষের লাইগা তাগোর সময় কই!
কালেমার ধ্বনি ঘুমন্ত সভ্যতার বিবেকে বার বার ধাক্কা খেল। চার জোড়া পায়ের শব্দ ছাড়া আপাতত বাকি কিছু নেই। ফের আকাশ সেজেছে রক্ত চন্দনে। পাখিদের ঘরে ফেরার তাড়া শুরু হল। আবছা অন্ধকার গ্রাস করছে চারপাশ। এ শহরে রাতের পর আলো আসে। সে আলো রক্তে-মাংসে খেলে মনুষ্যত্বে না।