অনিবার্য পরিণতির রূপ নিচ্ছে অগ্নিদুর্ঘটনা

28

 

শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিদুর্ঘটনা যেন অনিবার্য পরিণতির রূপ নিচ্ছে। কেবল সহায়-সম্পদহানিই নয়, প্রাণসংহারীও হয়ে উঠছে অগ্নিকান্ড। নতুন ইংরেজি বছরের শুরুতেই নগরী ও জেলায় একের পর এক সংঘটিত হচ্ছে অগ্নিদুর্ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রান্নার চুলা ও বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিদুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটছে। সচেতনতা ও সতর্কতার অভাবই এসব দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানিয়েছে, গত এক পক্ষকালে নগরী ও জেলায় অন্তত চারটি বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের খবর তারা জানে। সেসব দুর্ঘটনায় সম্পদহানির পাশাপাশি একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিও আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে গত ৩ জানুয়ারি দিবাগত রাতে ইপিজেড থানার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন জেলেপাড়ায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে অব্যাহত থাকা অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় অন্তত ২৭টি দোকানঘর। এসব দোকানঘরের মধ্যে রয়েছে- ১১টি মাছের আড়ত, ১৩টি জালের দোকান, দুটি হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এবং একটি মুদি দোকান। এসব দোকান পৃথক ২৭ জনের মালিকানাধীন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটি অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে না জানালেও জেলেপাড়ার বাসিন্দারা রান্নার চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত এবং এতে আনুমাানিক ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন।
এর আগে নতুন ইংরেজি বছরের প্রথম দিন পয়লা জানুয়ারি দিবাগত রাতে জেলার উপকূলীয় জনপদ বাঁশখালীর কাথারিয়া বাজারে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সৃষ্ট আগুনে দগ্ধ হয়ে বাদশা (৫০) নামে একজন বৃদ্ধ মারা যান। তিনি আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকানের কর্মচারী ছিলেন। এ অগ্নিদুর্ঘটনায় বাজারের মোট ছয়টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তার আগের রাতে কালুরঘাট শিল্প এলাকার বাদামতলে কাদের ট্রেডিং নামের একটি ফোম কারখানায় অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সৃষ্ট অগ্নিদুর্ঘটনায় কারাখানার ভেতরে থাকা ফোম ও ম্যাট্রেসসহ কয়েক লাখ টাকা মূল্যের মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দমকল বাহিনীর পক্ষ থেকে অগ্নিকান্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাঁশখালী উপজেলার জলদী সদরে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে সৃষ্ট আগুনে তিনটি সেমিপাকা দোকান পুড়ে গেছে। দোকানগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনিক্স, ফটোকপি ও মুদি দোকান রয়েছে। এতে তিন লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলেও কোনও প্রাণহানি খবর পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা বলছেন, নগরীতে বর্তমানে শিল্প-কারখানা, গুদাম, মার্কেট ও বসতি মিলিয়ে চার শতাধিক স্থাপনা অতিমাত্রায় অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ বা অধিকতর ঘিঞ্জি এলাকা হিসেবে পরিচিত রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, কর্ণফুলী সিঙ্গাপুর মার্কেট এবং আগ্রাবাদের মোগলটুলী, মাদারবাড়ি, বাকলিয়ার মিয়াখাননগর, পাহাড়তলীর আমবাগান, ইপিজেডের কলসী দীঘির পাড়, বায়েজিদ শেরশাহ এলাকার বেশকিছু কলোনি রয়েছে ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে। এসব এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতিরও শঙ্কা রয়েছে। কারণ এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা চলাচলের সড়কগুলো এতই সরু ও সংকীর্ণ যে, ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও দমকল কর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছানো একপ্রকার অসম্ভব।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। আমরা অভ্যাসগত কারণেই অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি তৈরি করে রাখি। এছাড়া, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। যে কারণে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হলেও তা নির্বাপণে ফায়ার কর্মীদের বেগ পেতে হয়। ফায়ার সনদ নিলেও নির্দেশনা অনুসরণে অভ্যস্ত হচ্ছে না। একইভাবে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করা হয়না। ভবন নির্মাণে ত্রূটি থাকায় কোন কোন সময় প্রাণহানি বেশি ঘটে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ত্রূটিমুক্ত নয়। খরচ কমাতে ভবনে নিম্নমানের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। আবার একবার লাগালে অকেজো না হওয়া পর্যন্ত আর বদলানোর অভ্যাস নেই। যে কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পাওয়া যায়। অপরদিকে, নগরে নির্বিচারে জলাশয় ভরাটের কারণে পানির উৎস কমে যাওয়ায় অগ্নি নির্বাপণে পানি সংকটে ভুগতে হয়।
তিনি বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। একটু সচেতন হলেই অনেক অগ্নি-দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম রাখা, ফায়ার ডোর ব্যবহার করা, বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিবছর নিয়মিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র পরীক্ষা করিয়ে রাখা এবং ছোট অবস্থাতেই আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
এদিকে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বাণিজ্যিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা গুদাম স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা লংঘন করেই নগরীতে শত শত কেমিক্যাল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ও গুদাম গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর আছাদগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় টিনশেড ও ঘিঞ্জি পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যাল এবং স্পিরিটের দোকান ও গুদাম। এসব দোকান ও গুদাম মালিকদের অনেকেরই অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেই। আবার যারা ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছেন সেখানেও রয়েছে গোলমাল। অন্যের অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদর্শন করেই সংগ্রহ করা হয়েছে অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র। কেউবা ছাড়পত্র নেয়ার পর সেটা আর নবায়ন করেন নি। নগরীর বৃহত্তম পাইকারি বাণিজ্যকেন্দ্র আছদগঞ্জের সবকটি কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম মালিক অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র সংগ্রহ করলেও তাদের ৭০ শতাংশ গুদামে কোনও অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই।
অগ্নি-দুর্ঘটনার অত্যধিক ঝুঁকির তালিকায় থাকা রেয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে ছোট-বড় একশ’ ৪০টি মার্কেটে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানে পোশাক-আশাক, প্রসাধনী, কাপড় ও ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রি করা হয়। মার্কেটের গলিগুলো এতই সংকীর্ণ যে মানুষের হাঁটা-চলারও সুযোগ নেই। কোথাও দখল করে নেয়া হয়েছে গলির একাংশ। কোথাও চলাচলের পথেই অবৈধভাবে দোকান তুলে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দু’জন মানুষ হাঁটা যায় না- এমন গলিপথও রয়েছে কোনও কোনও মার্কেটে। এসব মার্কেটে কখনো আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি-নির্বাপক গাড়ি ও কর্মীরা প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মার্কেট ঘিরে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে এলোমেলো অবস্থায় আছে। মার্কেটের ওপরের তলার কক্ষগুলো গুদাম এবং আবাসিকের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া, মার্কেটের ভেতরে বা আশপাশে আগুন নেভানোর মত পানির কোন উৎস নেই। রাতের বেলা গেটগুলো বন্ধ থাকে। ফলে, মধ্যরাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ভেতর থেকে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসারও সুযোগ নেই।