অনলাইন সংবাদ এবং সাংবাদিকতার গুরুত্ব

450

 

সাংবাদিকতায় এখন তথ্যপ্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। আধুনিক এই যুগে পৃথিবীর যে প্রান্তেই ঘটনা ঘটুক না কেন, তা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের নাগালে চলে আসছে। সেই খবর তখনই পাঠকের জন্য পরিবেশন করা হচ্ছে। এই গোটা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখছে অনলাইন পত্রিকা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে অনলাইন সাংবাদিকতা।
অনলাইন সাংবাদিকতা, যাকে আমরা ডিজিটাল সাংবাদিকতাও বলি সেটি আসলে কী? অনলাইন সাংবাদিকতা হচ্ছে, হালের সাংবাদিকতার একটি ধরন যার বিষয়বস্তু কাগজ বা স¤প্রচার মাধ্যমের বদলে ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। ডিজিটাল সাংবাদিকতার সংজ্ঞা নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট বিতর্ক আছে। খবর বা ফিচার যখন পাঠ্য বিষয়, অডিও, ভিডিও ও ইন্টারঅ্যাকটিভিটির সহায়তায় ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে আমরা অনলাইন বা ডিজিটাল সাংবাদিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। অন্যভাবে বলতে গেলে, অনলাইন পত্রিকা হলো একটি সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ যা এককভাবে শুধু অনলাইনে প্রকাশিত অথবা কোনো মুদ্রিত সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ হিসেবেও প্রকাশিত হতে পারে। ইতিহাস বলে, ১৯৭৪ সালে ব্রæস পারেলউ ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনলাইন সংবাদপত্র চালু করেন। ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া সরকারি মালিকানাধীন ব্রাজিলীয় সংবাদপত্র ‘জর্নালদোদিঅ্যা’ ৯০ দশকের দিকে অনলাইন সংস্করণের সূচনা করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক সংবাদপত্র অনলাইনে প্রকাশনা শুরু করে ১৯৯০ সালের শেষ দিকে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার শুরু ২০০৫ সালের দিকে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা না থাকায় ২০১০ সাল পর্যন্ত এ মাধ্যমের পাঠক ছিল হাতে গোনা। এরপর মানুষের হাতের নাগালে সহজে ইন্টারনেট চলে আসে। বাড়তে থাকে অনলাইন পত্রিকার পাঠক। দেশে বর্তমানে কয়েক ধরনের নিউজ পোর্টাল বা অনলাইন পত্রিকা রয়েছে : ১. ডেইলি ইভেন্ট নিউজ পোর্টাল ২. বিশেষ সংবাদভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ৩. বিশেষায়িত নিউজ পোর্টাল ৪. মিশ্র নিউজ পোর্টাল। অনলাইন সাংবাদিকতা আসলে পাঠককে সময়ের সঙ্গে চলতে সাহায্য করে। যে কোনো সময়ে যে কোনো খবর অনলাইন পত্রিকা সবার আগে প্রকাশ করতে পারে। সে কারণে অনলাইন সাংবাদিকতা হচ্ছে সবচেয়ে আধুনিক। এই সাংবাদিকতা চতুর্মাত্রিক। অনলাইন পত্রিকায় সাধারণত চারটি মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। লেখা, ছবি, অডিও এবং ভিডিও। অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে এই সুযোগ নেই বললেই চলে। সংবাদপত্রকে অনেকে বলেন তাড়াতাড়ির সাহিত্য। অনলাইন সাংবাদিকতাকে সেক্ষেত্রে বলতে হবে অতি তাড়াতাড়ির সাহিত্য। কারণ এখানে প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন সাংবাদিকতায় সময় যেহেতু মূল বিবেচ্য বিষয়, সেকারণে অনলাইন সাংবাদিকদের চাপের মধ্যেই কাজ করতে হয়। যেকোন সংবাদ দ্রুততার সঙ্গে পাঠাতে হয়। পাশাপাশি অনলাইন পত্রিকার সুবিধা অনেক। ছাপা খরচ নেই। পত্রিকা বিলি করা বা পৌঁছে দেয়ার ঝক্কি নেই। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে খবরটি অনায়াসে পাঠককে জানিয়ে দেয়া যায়। তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় কোন নিউজটি কতজন দেখেছে। সহজেই জানা যায়, কোন স্থান থেকে, কোন দেশ থেকে কত পাঠক সেই মুহূর্তে ওই অনলাইনটি দেখছে। কোন খবর পাঠক বেশি দেখছে বা পড়ছে সেটাও সহজে জানতে পারে অনলাইন পত্রিকা। ফলে চাহিদা অনুযায়ী খবর দেয়ার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া অনলাইন পত্রিকায় পাঠক সংবাদের বিষয়ে সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। পাঠক ইচ্ছা করলে ওই সংবাদসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য দিতে পারেন, ছবি, ভিডিও, অডিও শেয়ার করতে পারেন।
এছাড়া অনলাইন পত্রিকায় খবরের যে কোনো ভুলভ্রান্তি সহজেই শুধরানো বা সংশোধনের সুযোগ থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা টেলিভিশনে একটি সংবাদ একবার প্রচার হয়ে গেলে তা দ্বিতীয়বার দেখতে পরবর্তী সংবাদ স¤প্রচারের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। আর কাগজের পত্রিকা প্রকাশ হয় ২৪ ঘণ্টা পরপর। অনলাইন পত্রিকা চলমান ঘটনার সংবাদ প্রকাশের একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। এতে আর্কাইভ থাকে, যে কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় তার পছন্দের সংবাদটি পড়তে পারেন। প্রয়োজন হলে প্রিন্ট করতে পারেন, খবরের লিংক অন্যকে পাঠাতে পারেন ইচ্ছে মতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন অনেক ক্ষেত্রে খবরের উৎস হিসেবে কাজ করছে। সেখানে এখন অনেকেই নিউজ শেয়ার করছেন। শিরোনাম পছন্দ হলে অনেকেই লিংকে ক্লিক করে বিস্তারিত পড়ে নিচ্ছেন। এছাড়া যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে, মোবাইল ফোনেই অনলাইন পত্রিকা পড়তে পারছেন পাঠক। যে কারণে প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে এখন অনলাইন মিডিয়ার প্রতি পাঠক ঝুঁকছেন। বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা হাজার হাজার। পেশাদারিত্ব কিংবা মোটামুটি পেশাদারিত্ব আছে এমন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা হাতে গোনা। আস্থা তৈরি করা এই পোর্টালগুলো বাদে বাকিগুলো খবর কপি করে হুবহু বা কিছুটা পরিবর্তন করে প্রকাশ করে। বিনিয়োগের তেমন কোনো বালাই নেই। নিজস্ব সংবাদকর্মী নেই বললেই চলে। কপি আর পেস্ট তাদের মূল পূঁজি। ‘কপি করা’ ঠেকানোর ব্যবস্থা থাকলে বেশ হতো। তাহলে কি এত অনলাইন পত্রিকা থাকত? অনলাইন পত্রিকা বের করার দুঃসাহসও হয়ত তখন অনেকে দেখাতো না। হাজারও অনলাইন পত্রিকার ভিড়ে কিছু নিউজ পোর্টাল অবশ্য পেশাদারিত্ব নিয়েই এগোতে চায়। কিন্তু যোগ্য কর্মীর অভাবে এগোতে পারছে না সেগুলো। মালিকপক্ষের পরিকল্পনার ঘাটতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমন্বয়হীনতার কারণে যোগ্য সংবাদ কর্মীরা ওই সব প্রজেক্টে যোগ দিতে ততটা আগ্রহী নন। এমন ধারণা অবশ্য অনেকের মাঝেই আছে যে, কয়েকটা ল্যাপটপ দিয়ে কয়েকজনকে বসিয়ে দিলেই একটা অনলাইন পত্রিকা চালানো যায়। দেশে-বিদেশে দুই ধরনের বাংলা অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে। মূল ধারার অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইচ্ছে পূরণের নিউজ পোর্টাল। এই ইচ্ছে পূরণের নিউজ পোর্টালগুলোর কারণেই অনলাইন পত্রিকার যত দুর্নাম হয়। খায়েশ পূরণের কয়েক ধরনের পোর্টালের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ১. শখের পোর্টাল ২. ধান্দাবাজির পোর্টাল ৩. প্রেস্টিজ প্রদর্শনের পোর্টাল ৪. ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর মতাদর্শ প্রকাশের পোর্টাল এবং ৫. প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর পোর্টাল। এসব অনলাইন পত্রিকার সংবাদ পড়ে পাঠক বিভ্রান্ত হন। বিরক্ত হয়ে পুরো অনলাইন গণমাধ্যমের সমালোচনা করেন। ডোমেইনের দাম কম হওয়ায় আজকাল প্রায় ঘরে ঘরে অনলাইন পোর্টাল। অনলাইন পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক হিসেবে নিজেকে জাহির করার একটা প্রবণতা এই সময়ে খুব বেশি করে চোখে পড়ছে। যাই হোক, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দিয়ে অনলাইন সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের বিষয়ে যথেষ্ট সর্তক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যম আর বিকল্প গণমাধ্যমের ফারাক অনেক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তেমন একটা থাকে না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত সেটা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সেক্ষেত্রে ওই তথ্যকে সংবাদ নয়, বড় জোর সংবাদসূত্র বলা যেতে পারে। অনলাইন এখন গণমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিককে এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে। সচেতন হতে হবে তার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও মাথায় রাখতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। একটি অনলাইন পত্রিকার চালকের আসনে যারা থাকবেন, তাদের আসলে সময়ের সঙ্গে চলতে হবে। পাঠকের চাহিদার কথা বুঝতে হবে, প্রযুক্তি বুঝতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা তাদের খবরের মানুষ হতে হবে। আর তাতেই সাংবাদিকতার মঙ্গল, সমাজের মঙ্গল। দেশ, জাতি সবার মঙ্গল।
‘অনলাইন সাংবাদিকতায় নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের বিষয়ে লেখার এ পর্যায়ে জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হয়। তা করতে গিয়ে নীতি নৈতিকতার ওপরই অধিক গুরুত্ব দিতে হয়। ‘নৈতিকতা’ একটি আদর্শিক মানদÐ। এই মানদÐ ভাল-মন্দ, করণীয়-বর্জনীয়,উচিত-অনুচিত, ঠিক-বেঠিক, ন্যায্য-অন্যায্য, মানবীয়-দানবীয় প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে দেয়। নৈতিকতা ব্যক্তিকে তাঁর সততা, স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ধর্ম, সমাজ-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, মানবিকতা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে নৈতিকতা বা নৈতিক মানদÐ গড়ে ওঠে। অর্থাৎ নৈতিকতা বা নৈতিক দর্শন সঠিক কাজের দিশা দেয়। কিন্তু সাংবাদিকতায় অল্প-অর্ধ শিক্ষিত, অনভিজ্ঞ, অদক্ষ, অসৎ সুবিধাবাদী শ্রেণির কতিপয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটার কারণে সৎ সাংবাদিকতা নেতিবাচক বৈরী পরিবেশ মোকাবেলার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়া বিপথগামী গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার কাজটি এখনই গুরুত্বের সাথে শুরু হওয়া দরকার। কেননা দীর্ঘ সময় ধরে চলমান এই মানবকল্যাণের পরিপন্থী বিষয়টির লাগাম টেনে না ধরতে পারলে ক্রমেই তা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠবে।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভায় যে ভাষণ দেন তা এক মহামূল্যবান দলিল। এই ভাষণ সম্পর্কে “বঙ্গবন্ধুর ভাষণ: একটি পর্যালোচনা” শিরোনামে ‘বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম’- গ্রন্থে প্রকাশিত মিজানুর রহমান তাঁর লেখা নিবন্ধে যে সমাপ্তি বিশ্লেষণ করেছেন তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি ওই নিবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে লিখেছেন,“ পুরো বক্তব্য (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ) বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ওই সময়ের নেতিবাচক সাংবাদিকতা যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি নতুন দেশের জন্য কল্যাণকর নয়- এবক্তব্যই ফুটে উঠেছে। বস্তুত হলুদ সাংবাদিকতা কিংবা সাবজেক্টিভ জার্নালিজম কোন সময়ের জন্যই দেশের এবং দশের জন্য উপকারী নয়। এ সত্যটি বঙ্গবন্ধু যেমন বুঝেছিলেন, বর্তমানেও সাংবাদিক সমাজ এবং পাঠককে নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতি নিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। সাংবাদিকতার বিষয়ে আলোচ্য সমস্যার প্রেক্ষাপটে যে যুক্তি বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে উঠে আসে তা হলো- পেশাজীবিরা যদি নীতিবান হন, তাহলে নীতিমালা বা আচরণবিধি দিয়ে সততার ব্র্যাকেটে বন্দী করার কৌশল খোঁজার দরকার হয় না। আরেক ধাপ এগিয়ে অন্যরা বলেন, এত কিছুর দরকার নেই। একটা সাদামাটা নৈতিক বিষয়ই যথেষ্ট। আর তা হলো-ভালো উদ্দেশ্য।
(তথ্য সহায়ক: বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের গণমাধ্যম সাময়িকী ‘নিরীক্ষা’ ২০২তম ও ২০৮ তম সংখ্যা ও ‘বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম’ গ্রন্থ।)
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যসেবক