অনলাইন কেনাকাটায় বাড়ছে প্রতারণা

115

তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশে অনলাইনে কেনাকাটা জীবনযাত্রা সহজ করছে। ঘরে বসেই বাজারে না গিয়েও সেরে নেয়া যাচ্ছে কেনাকাটা। তবে এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে প্রতারণার অভিযোগ বাড়ছে। প্রতারকদের নিত্য-নতুন ফাঁদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে পণ্য কিনে নানাভাবে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা। এসব প্রতারণার অভিযোগ আছে নামকরা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
ক্রেতা যে পণ্য অর্ডার করেন, অনেক সময়ই তার পরিবর্তে অন্য কিছু দেওয়া হয়। ছবিতে এক মডেল থাকলে দেয়া হয় অন্য মডেল। আবার পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও সেটা দেয়া হয় না। কেউ কেউ অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য কেনেন, ফেরত দিলে মেলে না টাকা। ‘ক্যাশ ইন ডেলিভারি’র ক্ষেত্রে আবার পণ্য ফেরত পাঠাতে হলে দিতে হয় মাশুল। পণ্য ফেরত পাঠালে টাকা বা বদলকৃত পণ্য ফেরত আসে না। ফলে সঠিক পণ্যও পান না ভোক্তারা, আবার সময়ের পাশাপাশি গচ্চা যায় টাকাও। প্রতারিত হলেও কোথায় অভিযোগ করবেন, সে সম্পর্কে অবগত নেই অধিকাংশ ক্রেতা। এর মধ্যে প্রতারিত হওয়ার কিছু অভিযোগ জমা পড়ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে।
সীমিত জমা পড়া অভিযোগের এ সংখ্যা দপ্তরে মোট জমা পড়া অভিযোগের ৪০ শতাংশ। তবে অধিদপ্তর থেকে এসব ই-কমার্স প্ল্যাটফরমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তেমন নজর নেই। যদিও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাশ বলেন, অনলাইনে প্রতারণার অভিযোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে যেসব অনলাইনের ঠিকানা রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আর যেসব অনলাইনের ঠিকানা নেই অর্থাৎ ভুয়া অনলাইন, সেগুলো নিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমাদের কাছে যে অভিযোগগুলো জমা পড়ছে তার মধ্যে ৪০ শতাংশ অভিযোগ অনলাইনে প্রতারণার। আমরা মোট অভিযোগের ৯২ শতাংশ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান দারাজ থেকে শুরু করে ফেসবুকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আছে অভিযোগ। তবে ফেসবুকে যে সকল প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর কোনো ঠিকানা থাকে না। ক্রেতাদের এ বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ঠিকানা না থাকলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।
তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে অনলাইন বাজারের পরিধি ক্রমেই বাড়ছে। নিত্য-নতুন পণ্যের সমাহার, বিভিন্ন ছাড় ও উপহারের কমতি নেই ভার্চুয়াল এ বাজারে। ফলে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে বাজার। প্রতিবছর জ্যামিতিক হারে বাড়ছে লেনদেন। প্রায় সকল ধরনের পণ্যই মিলছে এ বাজারে। তবে বেশিরভাগ পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। মান, পণ্যের ধরন, মূল্য থেকে শুরু করে পণ্যের উৎপত্তিস্থল নিয়েও আছে অভিযোগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাংলাদেশে এখনো ই-কমার্স বা অনলাইনে কেনাকাটায় কোনো নীতিমালা হয়নি। এমন একটি সাইট করতে কি কি লাগবে সেটাও বলা নেই। এমনকি ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া শুধু মোবাইল নম্বর দিয়ে অনেকে এ ব্যবসা করছে। কোনো অফিস বা ঠিকানা নেই। মোবাইল বন্ধ করে দিলে ধরার কোনো সুযোগ নেই। দারাজসহ যেগুলোর অস্তিত্ব আছে সেগুলোর অভিযোগ নিষ্পত্তি হচ্ছে। তাদের অনেকবার জরিমানা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতিদিন আমাদের (ক্যাব) কাছে ২০-৫০টি করে অভিযোগ পড়ছে অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণার। প্রায় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ক্রেতাদের এ ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। সাইট কতটুকু ভেরিফাইড সেটা দেখে কেনাকাটা করা উচিত। এরপরও প্রতারিত হলে অভিযোগ করে ব্যবস্থা নিবে।
দিনে দিনে অনলাইন কেনাকাটা যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠছে প্রতারক চক্রও। চাকচিক্য দেখে পণ্য অর্ডার করলেও পরক্ষণেই পণ্য হাতে পাওয়ার পর পড়ছেন বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখে। ভার্চুয়াল পণ্যসামগ্রীর ছবির সাথে বাস্তবতার বেশ অমিল পাওয়া যায় পণ্য পাওয়ার পর। ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান দারাজের বিরুদ্ধে এমন অনেক অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে নির্ধারিত পণ্য না পাঠানো, পণ্য ফেরত পাঠালে পণ্যের মূল্য ফেরত না দেয়া, একটির বদলে অন্যটি দেয়া এবং পণ্য পরিবর্তন করে না দেয়ার অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে দারাজের চট্টগ্রাম সেন্টারে (দারাজ পয়েন্ট) গেলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। পরবর্তিতে দারাজে ওয়েবসাইটে প্রদত্ত ইমেইল ঠিকানায় ও ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেও দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ই-কমার্স নতুন কোনো ব্যবসা নয়। এটি হল গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছানোর মাধ্যম। ইন্টারনেটের সাহায্যে যেখানে যখন খুশি কেনাকাটা করা যায়। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই উপকৃত হয়। যানজটের ঝুঁকি এড়ানো, শ্রম এবং সময় বাঁচানো ও নিরাপত্তাজনিত কারণে দিন দিন অনলাইনে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। বিদেশের নামি ব্র্যান্ডের পণ্য অর্ডার দিলেও দেশে বসেই এসব পণ্য পাওয়া যায়। বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা গেলে আগামী দিনে এ সেক্টরটির বিশাল মার্কেট রয়েছে। তবে আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বিশ্বস্ততার জায়গায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়সেবা দেওয়ার নামে গ্রাহকদের অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রতারনায় লিপ্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন নামিদামি পণ্য অর্ডার নিয়ে তারা ওই পণ্য না পাঠিয়ে নিম্নমানের বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করছে। এমনকি মোবাইলের পরিবর্তে সাবান পৌঁছে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতারিত হওয়ার পর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন ক্রেতারা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, অনলাইন শপিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতারিত হলে কেনাকাটার প্রমাণপত্রসহ অভিযোগ করতে হবে। তবে সবার আগে যে কোনো কেনাকাটায় ক্রেতাকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে অনলাইন কেনাকাটায় বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা করতে হবে।