অনন্য এক স্কুলের নাম ‘নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি’

151

অদুল কান্তি চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনন্য ও অন্যরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি’। শিরোনামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিষ্ঠাতার নাম বলার কারণ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠাতা অদুল কান্তি চৌধুরী এমন এক দাতা, যিনি বাংলাদেশে বহু জেলায় উপজেলায় গ্রামে গঞ্জে দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি টাকা দান করেছেন এবং দান করে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় এমন ব্যক্তি বা দাতাকে অনেকে জাতীয় দানবীর হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন। বিষয়টি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আন্তর্জাতিক দানবীরও বলা যেতে পারে। কারণ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বর্হিবিশ্বে যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, ভারত প্রভৃতি দেশেও অসংখ্য সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি একেবারে মুক্ত হস্তে নিজেকে উজাড় করে অকাতরে কেবল দিয়ে যাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকার অনুদান।
আজকের লেখায় ব্যক্তি দানবীর অদুল কান্তি চৌধুরীকে নিয়ে লেখার উদ্দেশ্য আমার নয়। হয়ত আগামীতে কোন একদিন, তাঁকে নিয়ে কোন এক পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয়তে লেখার আশা রাখছি। কিন্তু আজকের লেখায় মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বহুল আলোচিত ও এলাকায় আলোকিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি নিয়ে। এমন দানবীর ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেমন হতে পারে, তারই পূর্বধারণা দেবার জন্যে লেখার গৌরচন্দ্রিকা বা ভূমিকায় এই লেখা।
গত মাস খানেক আগে অদুল দাদা’র সাথে দেখা হয়েছিল, আন্দরকিল্লাস্থ সাব-এরিয়া এলাকায় তাঁর নিজস্ব বাসভবনে। এই সময় শ্রদ্ধেয় অদুল দাদা’র সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। কথার প্রসঙ্গে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি (নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি) নিয়ে আলোচনা করেন। একপর্যায়ে স্কুলটিকে আমি দেখিছি কিনা, স্কুলটিতে এরই মধ্যে গিয়েছি কিনা আমার থেকে জিজ্ঞাসা করেন। এরপর ঐ বিদ্যালয় সম্পর্কিত কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে স্কুল সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। অতঃপর এই বিদ্যালয় নিয়ে আমার কিছু লেখার এবং দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য শ্রদ্ধেয় অদুল দাদা’র বাড়ি আমার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের মত উত্তর পূর্বে অবস্থিত। আমার বাড়ি কানুনগোপাড়া গ্রামে, আর উনার বাড়ি জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামে; পাশাপাশি এই দুটি গ্রামকে বিভক্ত করেছে ছোট্ট সরু একটি খাল।
জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামটি চট্টগ্রাম জেলাধীন বোয়ালখালী উপজেলার অন্তর্গত শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নে অবস্থিত। এমনিতেই গ্রামটি প্রকৃতির নিজ হাতে নিপুণভাবে গড়া; অনুপম ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল প্রাচুর্যে নির্মল সৌন্দর্যে ভরা। এই গ্রামটির পূর্বদিকে রয়েছে সবুজ পাহাড় অরণ্য, আর উত্তর দিকে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী, খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর জলধারা। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এমনই অপূর্ব অপরূপ প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি জ্যৈষ্ঠপুরায়, অদুল কান্তি চৌধুরী তাঁর মা নিরুবালা চৌধুরী’র নামে এই একাডেমি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছেন ২০১০ সালে। একদিকে খরস্রোতা নদীর উছল জল রাশি, অন্যদিকে পাহাড়ি অরণ্যে নাম জানা অজানা নানা প্রজাতির গাছগাছালী ও গুল্মলতার মাঝে, মায়াবী পরিবেশে অবস্থিত জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামটি। ঠিক তারই মাঝে ছায়া সুনিবিড় সুশীতল শান্তির নীর নিরব নিস্তব্ধ এলাকায় সম্পূর্ণ শিক্ষা বান্ধব পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই স্কুল, অর্থাৎ নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি। স্কুল চলাকালীন সময়ে সুনির্দ্দিষ্ট ইউনিফর্মে সুসজ্জিত শতশত ছাত্রছাত্রীর কলরব আর রঙবেরঙের পাখপাখালীর কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন। এক কথায়, প্রকৃতির এমন অপরূপ দৃশ্য ও মানুষ সৃষ্ট স্কুলের সৌন্দর্য্য, যা মানবীয় সত্তা দিয়ে অনুভব ও উপভোগ করা মত এবং ঘুরে দেখার মত একটি জায়গা।
এবার আসি কেন তিনি এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারণায় ও নির্বাচনী ইস্তেহারে মূল আকর্ষণ ছিল ডিজিটেল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। এই অঙ্গিকারকে সামনে রেখে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। সরকারের সেই ডিজিটেল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসাবে শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কথা চিন্তা করেই অদুল কান্তি চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন এই ধরণের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার কথা।
আরো সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ঘোষণাকে দ্রুততম সময়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতেই গ্রামীণ তৃণমূল এলাকায় এই ধরণের স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। সরকারের সেই ডিজিটেল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়, আর তাঁর চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটল তাঁরই মায়ের নামে নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তাঁর মতে, ডিজিটেল বাংলাদেশ গড়তে হলে, প্রথমে শিক্ষাকে ডিজিটেলাইজ করতে হবে। কারণ দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে আনতে হলে সর্বপ্রথম শিক্ষাকে আগে উন্নীত করতে হয়। আর শিক্ষা ও উন্নয়ন একটি অপরটির পরিপূরক। তাই নতুন প্রজন্মকে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সমান্তরাল ভাবে চলতে অদুল বাবু’র এই নিরলস ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তিনি বলেন তাঁর এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলায় আরো ‘নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে পরিচালনা করবেন, এমন পরিকল্পনাও রয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণস্বরূপ চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী বেশ কিছু খৃষ্টান মিশনারী স্কুলের কথা উল্লেখ করেন।
এবার বিদ্যালয়ের কার্যক্রম নিয়ে কিছু কথা বলতে হয়। গত ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জৈষ্ঠপুরা নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি। সেই হিসাবে চলতি বছর এই বিদ্যালয়ের এক দশক পূর্ণ হল। প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রাক প্রাথমিক থেকে অর্থাৎ প্লে নার্সারী ক্লাস দিয়ে শুরু করলেও পরে পর্যায়ক্রমে প্লে ক্লাস থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত, প্রাথমিক শিক্ষাস্তর নিয়ে শিখন শেখানো কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অসংখ্য এ-প্লাস ও বৃত্তি পাওয়ায় এলাকায় ব্যাপক সাড়া জাগে। এরপর কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের ভিত্তিতে এবং সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় আরো তিনটি শ্রেণি বর্ধিত করে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার কথা বিবেচনায় রেখে, নিরুবালা চৌধুরী একাডেমিতে শুরু হয় সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষা; যা নিম্নমাধ্যমিক (৬ষ্ঠ-৮ম) স্তর হিসাবে অধিকতর পরিচিত। সেই হিসাবে ’২০ সাল থেকে শিক্ষাবোর্ড প্রদত্ত নিজস্ব ইআইআইএন নম্বরে, প্রথম বারের মত জেএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এইদিকে এলাকাবাসীর অনুরোধে বিদ্যালয়টিকে পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক (নবম-দশম) ও উচ্চ মাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) স্তরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই অনুযায়ী বিদ্যালয়ে ৩৬ কক্ষ বিশিষ্ট দুটি নতুন একাডেমিক ভবন, অডিটোরিয়াম, বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরী নির্মাণ করা হয়েছে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এক ঝাঁক দক্ষ অভীজ্ঞ যোগ্য ও নবীন প্রবীণ শিক্ষকের সমন্বয়ে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষণ ও শিখন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রধানশিক্ষক রেজাউল করিম মোস্তফা ও সহকারি প্রধানশিক্ষক বাবু সুবাস চৌধুরী সহ সর্বমোট ১৮ জন শিক্ষক এবং ৪ জন কর্মচারী রয়েছে। রয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীর যাতায়তের সুব্যবস্থা। এখানে উল্লেখ্য সহকারি প্রধানশিক্ষক বাবু সুবাস চৌধুরী হচ্ছেন কানুনগো পাড়া ডঃ বিভূতি ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি একজন যোগ্য অভীজ্ঞ দক্ষ শিক্ষক হিসাবে অবহিত করতে পারি; কারণ আমি ১৯৮৫ সালের দিকে ঐ কানুনগো পাড়া ডঃ বিবি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে, তিনি আমারও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন।
যা হোক, যে কথা বলছিলাম; নিরুবালা একাডেমিকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন ভৌত ও অভৌত কাঠামোগত উপকরণ ঢেলে সাজিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগেই বলছিলাম এটি একটি প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সকলক্ষেত্রে ডিজিটেলাইজ করা হয়েছে। এখানে ডিজিটেল বিদ্যালয়ের অংশ হিসাবে রয়েছে নিজস্ব ওয়েব সাইটে, রেকর্ডপত্রসহ সকল তথ্য উপাত্ত সম্পূর্ণ ডিজিটেলাইজড। এছাড়া অনলাইনে ভর্তি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিতি হাজিরা, ডিজিটেল কনটেন্ট তৈরী, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে পাঠদান, ফলাফল প্রকাশ, নোটিশ প্রদান ইত্যাদি হয়ে থাকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে।
ছাত্র-ছাত্রীর নিয়মিত উপস্থিতি, পাঠোন্নতি অভিভাবকের মোবাইলে সেন্ড হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয় ম্যাসেজ এর মাধ্যমে। ভিতরে বাইরে পুরো স্কুল ক্যাম্পাস ক্লোজ সার্কিট ক্যমরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, শুদ্ধ উচ্চারণ ও রিডিং রাইটিং স্কিল দক্ষতা অর্জনের উপর গুরুত্বআরোপ, দুবর্ল শিক্ষার্থীদের ফলাবর্তন ব্যবস্থা, সবল শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রাপ্তি উপযোগি করে গড়ে তোলা, নিজস্ব একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ, সঠিক লেসনপ্ল্যান অনুকরণ, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি ও শিক্ষাদান, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিতকরণ, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি পরিবেশ রয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ে রয়েছে নিজস্ব অ্যাপস; যার মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট সকলেই খুব সহজেই অবাধে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। এইভাবে অনেক নিত্য নতুন আধুনিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে এই স্কুলটিতে। রয়েছে শিশু কিশোর শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশে ক্রীড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার এবং বার্ষিক পুরুষ্কার প্রদানের সুব্যবস্থা আর কো-ক্যারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস। শেষ কথায় এবং এক কথায় বলতে পারি, সুশিক্ষিত স্বনির্ভর আতœবিশ্বাসী জাতি গঠনের অঙ্গিকার নিয়ে অগ্রযাত্রা শুরু হওয়া ‘নিরুবালা চৌধুরী একাডেমি’ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে নিজেকে ছাড়িয়ে আরো সামনের দিকে।
লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক