অধ্যাপক আনিসুজ্জামান: স্বররূপের সন্ধান থেকে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে

73

 

মনস্বী শিক্ষক, উদারনৈতিক মানুষ, প্রগতিশীল চেতনার সজাগ বুদ্ধিজীবী, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (১ ফেব্রæয়ারি ১৯৩৭-১৪ মে ২০২০) এক দুর্যোগময় সময়ে চলে গেলেন। এই শোক ও শূন্যতা জানি কোনোকালেই পূরণ হবেনা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র এবং পরবর্তীতে পথিকৃৎ শিক্ষক হিসেবে তিনি কেবল বিদ্যায়তনিক মানুষ ছিলেন না। সাহিত্যকে তিনি এঅঞ্চলের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। বিশেষত গবেষণা ক্ষেত্রে তিনি যোগ করেছিলেন ভিন্ন একটি মাত্রা। নতুন তথ্যে- ভাষ্যে ও বিশ্লেষণে ভেঙে দিয়েছেন পুরোনো ধারণা। মুলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য(১৯৪৬) পিএইচডি গবেষণায় তিনি তুলে ধরেছেন বাঙালি মুসলমানের মানসিক পরিবর্তনের নানা দিক। দৃিষ্ট ফেলেছেন তিনি ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি বিচিত্র বিষয়ের উপর। ‘ ইরেজ উপনিবেশের ঔরশে বাংলা গদ্যের জন্ম’Ñএই প্রতিষ্ঠিত তত্ত¡কে খারিজ করে দিয়েছেন তিনি পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪) গ্রন্থে। তাঁর এই আবিষ্কার ও অনুসন্ধান ছিল বিস্ময়কর। বাঙালি নারী: সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০) গ্রন্থের দুটিপর্বে উনিশশতকপূর্ব,দ্বিতীয়টিতে উনিশশতকের সাহিত্য ও সমাজে নারী সম্পর্কিত ধারণা বিশ্লেষিত হয়েছে। ভারতবর্ষে নারীকে একাধারে দেবী ও গণিকারূপে দেখা হতো। এপ্রসঙ্গে লেখক প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে প্রমাণ উপস্থিত করেছেন।‘ কন্যাসন্তানের জন্মকে আনন্দের বলে বিবেচনা করা হতো না’-এধারণা প্রথাগত, সত্য নয়। চন্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, পদ্মাবতী,ধর্মমঙ্গল কাব্যে দেখা যাচ্ছে, কন্যাসন্তানের জন্মের পর আনন্দলাভের ঘটনাই বেশি। তবে স্ত্রীশিক্ষা যে উপেক্ষিত ছিল, তা বুঝতে ভুল হয়না। যেমন ব্যাধের সন্তান কালকেতুর লেখাপড়ার উল্লেখ নাই,ব্যাধকন্যা ফুল্লরারও লেখপড়ার কোনো প্রশ্ন উঠেনি। অষ্টাদশমতাব্দির কবি ভারতচন্দ্র বিধবাবিবাহ নিন্দনীয় মনে করতেন। অনিসুজ্জামানের অভিমত হলো-‘এই নীতিবোধ ও নারী সম্পর্কিত ধারণা উনিশ শতকেও অনেকখানি বজায় ছিল। তার প্রমাণ সতীদাহপ্রথা,বিধবাবিবাহের অপ্রচলন ও নারীকে ভোগ্যবস্তুরূপে দেখা।দেওয়ার কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, রাজনারায়ন বসু শিবনাথ শাস্ত্রীর বিবরণ এবং ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস (১৮২৫) পর্যন্ত গ্রন্থেও চিত্র বারঙ্গনা-আসক্তির যে সাক্ষ্য দেয়,তা ইরেজ আমলের দœ বলে চিহ্নিত হলেও এর অন্তর্নিহিত ভোগপিপাসা ভারতচন্দ্রে কালের চেয়ে পৃথক নয়। ’নারীর নতুন ভাবমূর্তি স্থাপন ও দাম্পত্য সম্পর্কেও নতুন আদর্শ স্থাপনে উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধেও বাংলা সাহিত্য সাহায্যকারি ভূমিকা পালন করেছে। মধুসূদন, বীহারীলাল, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার বঙ্কিমচন্দ্রের কথা উল্লেখ করলেও স্বভাবতই প্রশ্ন থেকে যায়, ১৮২৯সালে সহমরণপ্রথা নিষিদ্ধ হবার প্রায় আড়াই যুগ পরে লেখা মেঘনাদবধ কাব্যে (১৮৬১) মেঘনাদের মৃত্যুর পর প্রমীলা যে সহমরণে গেল, এক্ষেত্রে নবজাগরণের কবি মধুসূদনের কোন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, আনিসুজ্জামান তা উল্লেখ করেননি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এমন একব্যক্তি ছিলেন, যাকে মহীরুহের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তার মধ্যে একই সঙ্গে শিক্ষকসত্তা, গবেষকসত্তা, কর্মীসত্তা, সমাজ ও রাজনৈতিকসত্তা,সজাগ বুদ্ধিজীবীসত্তার সমাবেশ ছিল,সর্বোপরি সমীহ-শ্রদ্ধা জাগানো এক অনুপম ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর কর্ম পরিধিও বিশাল ও বহুমুখি ছিল।
আবু তৈয়ব মোহাম্মদ (এ.টি.এম) আনিসুজ্জামান, পৈতৃক নিবাস পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমায়। পিতা বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক ডা. আবু তাহের মোহাম্মদ (এ.টি.এম) মোয়াজ্জেম,মা সৈয়দা খাতুন। তিন বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। বড়বোন তৈয়বুন্নেসা, মেঝবোন তৈয়মুন্নেসা ছোটবোন মেহেরুন্নেসা, বড়ভাই আবুল কালাম মোহাম্মদ আসাদুজ্জআমান, ছোটভাই আবু তালেব মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। আনিসুজ্জামান বিয়ে করেন ১৯৬১ সালে। স্ত্রী সিদ্দিকা জামান।তাঁদের দুই কন্যা রুচিরা হক, শুচিতা জামান এবং একপুত্র আনন্দ জামান।১০৪৩ সালে কলকাতা পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়ালেখা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পিতা-মাতার সঙ্গে কলকাতা ত্যাগ এবং নতুন বাসস্থান খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি। খুলনা থেকে পিতা ঢাকায় বসস্থান পরিবর্তনের ফলে ১৯৪৯ সালে ঢাকা প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমানে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণিতে ভর্তি। ১৯৫১সালে এই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে বি.এ (অনার্স)পরীক্ষায় কলা অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করে ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।এম.এ পরীক্ষায় ১৯৫৭ সালে অনিসুজ্জামান প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৫৮ সালে পিএইচডি গবেষক হিসেবে বাংলা একাডেমির বৃত্তি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’। অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের তত্ত¡াবধানে ১৯৬২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে তিনি শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে যান এবং ‘ উনিশ শতকের বাংলার সাস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল’ বিষয়ে গবেষণা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে কমনওয়েথ স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ বিভাগে প্রাক্-উনিশ শতকের বাংলা গদ্য বিষয়ে গবেষণা করেন। স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬) আনিসুজ্জামানের একটি অনুসন্ধানী আত্মপরিচয়মূলক মৌলিক প্রবন্ধ। এখানে তিনি ভারত বিভক্ত হবার পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির অত্যাচার নিপীড়নে পর্যুদস্ত পূর্ববাংলার মানুষ দীর্ঘকালধরে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে যে স্বাতন্ত্র্য বহন করে আসছে, তাকে পৃথক করে সনাক্ত করেছেন।এই প্রবন্ধে একটি জায়গায় বদরুদ্দীন উমরের যুক্তি উপস্থাপন করেন-‘আমরা বাঙালি না মুসলমান? ্ প্রশ্ন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মনকে কিছুদিন থেকে আলোড়িত করে এলেও আজ সেটা আবার অল্পসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরন নতুন করে দেখা দিয়েছে।
..কেউ যদি প্রশ্ন করেন,‘আমরা কি বাঙালি, না মৎসভোজি, নাসঙ্গীতামোদী, না বিশ্বশান্তিকামী? তাহলে প্রশ্নকারিকে অনেকেই অস্বচ্ছ চিন্তা করার দারয় অভিযুক্ত করবেন।.. আমরা বাঙালি, না মুসলমান,না পাকিস্তানি? এই প্রশ্নের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু বাঙালি বলতে কাদের বোঝায়? এর উত্তর খুব সহজ, বাংলাদেশের যে কোনো অংশে যারা মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে বাংলাদেশের আর্থিক জীবনে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলা ঐতিহ্যকে নিজেদের ঐতিহ্য মনে করে, তারাই বাঙালি।’ এখানে আনিসুজ্জামান মুনীর চৌধুরীর একটি উক্তিও তুলে ধরেন-‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সহস্র বছরের পুরাতন।এই ভাষায় রচিত সকল শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আমার সাস্কৃকি ঐতিহ্যেও অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ এরপর আনিসুজ্জামান বাঙালির নৃতাত্তি¡ক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভিত্তির উপর স্থাপন করে বলেন,-‘১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলন,মুনীর চৌধুরীরর একাঙ্কিকা, জহির রায়হানের উপন্যাস, আবদুল গাফফার চৌধুরীর গান বাঙালির সেই উপলব্ধিরই ফসল। বিষয়টির পরিণত রূপ লক্ষ্য করা যায় ১৯৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থান কাল থেকে ১৯৭১সালের মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত,তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাণীর প্রধান বাহন হয়ে উঠেছিল কবিতা। স্বাধীনতারস্পৃহার সঙ্গে কবিতার এই একাত্মতার কথা শোনা যায় মুক্তিসংগ্রামের কালে রচিত শামসুর রাহমানের একচি কবিতা-
‘স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অৎর কবিতা,অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
এহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা।’
অধ্যাপক অনিসুজ্জামানের এই যে আত্ম অনুসন্ধান, হাজার বছরের বাঙালির আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের মীমাংসায় তিনি পৌছলেন, এটি তাঁর দীর্ঘ গবেষণা সত্তার মহোত্তম প্রাপ্তি। ১৯৪৩ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারে হাসিখুসি গ্রন্থের মাধ্যমে যে বালকের পাঠাভ্যাস শুরু হয়েছিল, তার পরিণতি ঘটে জাতির আত্মপরিচয়ের মীমাংসিত সত্যে। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের নিন্দা, বিরোধিতা, অসহযোগিতা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তাঁকে অগ্রসর হতে হয়েছে কিন্তু কোথাও তিনি অণন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। একাধিক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা,কিন্তু তিনি সর্বদায় ছিলেন অবিচল। ইন্টমেডিয়েট পড়ার সময় তিনি বামপন্থার রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হন। প্রগতিশীল চেতনা ভিত্তি তৈরি হয় তখন থেকে। যদিও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবে তিনি যথেষ্ট রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। যে কারণে দেগশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়,তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রæয়ারী (১৯৫৩)সম্পাদকীয় আনিসুজ্জামানের হাতের লেখা বøকে মুদ্রিত হয়।১৯৬১ সালে রবীন্দ্র বিরোধিতাকালে উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক সংকলন রবীন্দ্রনাথ । ১৯৫৯ সালে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার মাসের এ্যাডহক ভিত্তিতে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।পরে অস্থায়ীভিত্তিতে,১৯৬২ প্রভাষকের স্থায়ীপদে নিয়োগ লাভ করেন।১৯৬৪ সালে সিনিয়র প্রভাষকপদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালে রিডার হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেনএবং ১৯৭২ সালে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং ২০০৩ সালে অবসরগ্রহণ করেন।আমার একাত্তর গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,মার্চের প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেয়ার পর প্রথমে সহকর্মীদেও নিয়ে কুন্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নেন। হাটহাজারিতে প্রতিরোধব্যুহ ভেঙ্গে যাবার পর রামগড়ে, সেখান থেকে আগরতলা,তারপর কলকাতা শিক্ষক সমিতির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। অস্থায়ী মুজিনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হয়ে তাজুদ্দিন আহমদের সঙ্গে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় বন্ধু ডক্টও কামাল হোসেনের আমন্ত্রণে সংবিধানের বাংলা অনুবাদ করেন। সংবিধানের মূলনীতি-‘জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’কিন্তু ১৯৭৫সালে জাতির পিতার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর উপর্যুপোরি সামরিক শাসকদের কবলে পড়ে সংবিধানের মূলনীতি ও স্বাধীনতা স্বপ্নময় চেতনা ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়।এনিয়ে অধ্যপক আনিসুজ্জামানের ক্ষোভ ও হতাশার কথা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের জন্য জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতে সাক্ষী হন, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত বিশেষ ট্রাবুনালেও তিনি সাক্ষ্য প্রদান করেন। এভাবে আনিসুজ্জামান নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, গবেষণা, আর পেশাগত জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সাড়া দিয়েছেন সমাজের বিহত্তর আহŸানে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন,উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন অমায়িক, সজ্জন বন্ধুবৎসল। যেকোনো ছোটখাট অনুষ্ঠানেও তিনি অংশগ্রহণ করতেন। খ্যাতি ও পান্ডিত্যের অহমিকা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। অনায়াশে তিনি সর্বাস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। খুব অল্প কথায় অনেক কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার মতো এক অনন্যসাধারণ গুণ ছিল তাঁর।২০১৮ সালে সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সর্বশেষ তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। যুক্ত ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম-এর সঙ্গে। আনিসুজ্জামানের আত্মস্মৃতি কালনিরবধি,বিপুলা পৃথিবী, আমার একাত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজ-সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য অনুপম দলিল হিসেবে কাজ করবে।বাঙালি জাতির স্বরূপ সন্ধান থেকে আনিসুজ্জামান পৌঁছেছিলেন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে।
এই মানস-অভিযাত্রা তাঁর দীর্ঘ জ্ঞানচর্চারই ফসল।সংস্কৃতি অধ্যয়ন ও পর্য়বেক্ষণ তাঁকে এই স্থানে উপনীত করেছে। তাঁর অভিমত-‘সংস্কৃতি বলতে বোঝায় কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ও সুবিন্যস্ত আচরণরীতি এবং বস্তুগত অর্জন,বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও আধ্যাত্মিক ধারণা সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। হার্ডারের যুক্তি দেখিয়ে রেমন্ড উইলিয়াম বলেন যে, সংস্কৃতি না বলে সংস্কৃতিসমূহ বচলা উচিত: কেননা শুধু যে বিভিন্ন জাতি ও কালপর্বেও নির্দিষ্ট ও পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি রয়েছে, তা নয়, একটা জাতির বিভিন্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীরও নির্দিষ্ট ও পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি আছে। এর থেকে সাংস্কৃতিক বহুত্বের একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক বহুত্বেও ধারণায় একথা স্বীকৃত যে,পৃথিবীর বহু সংস্কৃকি রয়েছে এবং প্রত্যেক সংস্কৃতিরই নিজের মতো বিকাশ লাভের অধিকার আছে।’আজকের এই গেøাবাল কনসেপ্টে কেউ আর আঞ্চলিক মানুষ নেই, একই সে সঙ্গে বিশ্বনাগরিকও।এটা মনে রাখলে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, আমরা সাংস্কৃতিক প্লুরালিজমের মধ্যে বাস করছি। আনিসুজ্জামান যে শূন্যতা রেখে গেলেন, তা কেবল ব্যক্তির নয়, জাতীয় শূন্যতা। তাঁর জীবন ও কর্ম বাঙালি জাতির বাতিঘর হয়ে থাকবে।