অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ.) যাঁর জীবন উৎসর্গীত ছিল ইলমে দ্বীনের খেদমতে

68

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

বুজুর্গ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষাবিদ ছিলেন অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ)। সারল্য, সততা ও মহানুভবতার বিরল গুণ ছিল তাঁর মাঝে। বিনয়ী, সৎ, উদার ও পরোপকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। সত্তর বছরের দীর্ঘ জীবনে বহু মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ হিসেবে আজীবন ইলমে দ্বীনের খেদমতে, দ্বীন শিক্ষা বিস্তারে ও সুন্নিয়তের প্রচারে তিনি নিবেদিত ছিলেন। চট্টগ্রাম চান্দগাঁওয়ে শাহজি হুজুর কেবলা (রহ) প্রতিষ্ঠিত আল আমিন বারীয়া মাদ্রাসাকে ইবতেদায়ী হতে ফাজিল (ডিগ্রি সমমান) পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। কর্মজীবন ও শিক্ষকতা জীবনের সিংহভাগ অর্থাৎ ১৮ বছর ধরে তিনি বারীয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ ছিলেন।
এক ঐতিহাসিক দিনে অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খানের জন্ম। ১৯৪৭ সনের ১৪ আগস্ট তাঁর জন্ম দিন। চট্টগ্রাম চকবাজার নবাব ওয়ালি খান বেগ প্রকাশ অলি খাঁ (তাঁর নামে অলি খাঁ মসজিদ) এর ৬ষ্ঠ অধঃস্তন পুরুষ হলেন আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ:)। তাঁর পিতা ছিলেন অত্যন্ত বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব দরবেশ মৌলভী মুহাম্মদ নূরুল হোসাইন খান (রহ)। পিতামহ হলেন ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ আবদুল গফুর (রহ:)। অধ্যক্ষ আল্লামা নূরুল আলম খানের (রহ) পিতা দরবেশ মৌলভি নূরুল হোসাইন খান (রহ) একজন দ্বীন প্রচারক ও সাধক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দ্বীন প্রচারের জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করেন। বিশেষ ইবাদত বন্দেগি ও বুজুর্গির কারণে ‘দরবেশ সাহেব’ হিসেবে তাঁকে ডাকা হতো। অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ) ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। কুমিল্লা গাজিমোড়া আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল (হাদিস) শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে এখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৭০ সনে মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। কামিল শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবার পর আল্লামা নূরুল আলম খান (রহ)’র কর্মজীবন ও শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম বোয়ালখালী চরণ›দ্বীপে অবস্থিত চরণদ্বীপ ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। তিনি কিছুদিন এ মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ ছিলেন। এ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা কালে কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে অবস্থিত বাগোয়ান পাঁচখাইন গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও ব্যবসায়ী আলহাজ্ব মুহাম্মদ এমদাদুল হকের (রহ.) কনিষ্ঠ কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আল্লামা নূরুল আলম খান (রহ)। আব্বার সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শুনে আমার নানা সাগ্রহে নিজ কন্যাকে পাত্রস্থ করেন। আর এই বিয়ের নেপথ্যে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন আমার মেজ মামা পীরে তরিকত উস্তাজুল উলামা আল্লামা কাজী মুহাম্মদ নূরুল আলম হেজাজী (মজিআ)। যিনি রাঙ্গামাটি সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সূফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে আব্বার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সূফী সাহেব তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। একদিন সূফী সাহেব এক ঘরোয়া আলোচনায় ওখানে সমবেত আলেমদের কাছে জানতে চাইলেন জ্বিন জাতির ইতিহাস। জ্বিন জাতির আবাস কোথায় তা জানতে চাইলেন। তাঁর এ জিজ্ঞাসার উত্তর দানে অনেক খ্যাতিমান আলেম তখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেও খুব গুছিয়ে দলিলভিত্তিক জবাব দিলেন অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ)। ‘বাদায়েয়ুজ জহুর ফি ওয়াকায়েদ্দুহুর’ কিতাবের উদ্ধৃতি পেশ করে সূফী মিজান সাহেবের কাছে তিনি জ্বিন জাতির ইতিহাস বর্ণনা করলেন। বললেন ‘কুহে কাফ ’ নামক স্থানে অবস্থান করেন জ্বিন জাতি। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় যারা অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ হিসেবে থাকেন তারা সাধারণত প্রশাসনিক দায়িত্বের অজুহাতে তেমন ক্লাস নেন না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী গুণের অধিকারী ছিলেন আব্বাজান কেবলা (রহ.)। অধ্যক্ষ হিসেবে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত ক্লাস নিতেন। কোনো ক্লাসে শিক্ষক নেই দেখলে নিজেই ক্লাসে ঢুকে পড়তেন। বাংলা-ইংরেজি বিষয়েও তাঁর পান্ডিত্য ছিল।
২ মার্চ ২০১৯ সন। চট্টগ্রাম চান্দগাঁওয়ে আল আমিন বারীয়া কামিল মডেল মাদ্রাসা চত্বরে মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক জাফর আহমদ স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আমার শিক্ষক। তাঁর মুখে শোনা একটি ঘটনা। আব্বার ইন্তেকালের দিন তাঁর নামাজে জানাজায় যোগ দিতে তিনি মোটর সাইকেলযোগে হামজারবাগ মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে চান্দগাঁও হাজী শরফতুল্লাহ ফিলিং স্টেশনের সামনে গিয়ে পানির ঢলে তিনি আটকে পড়েন। ২/৩ হাত উঁচু পানিতে সড়ক সয়লাব। পানির স্রোতের কারণে তিনি মোটর সাইকেলটি সামনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বারীয়া মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের পক্ষে একটি শোক ব্যানার নিয়ে নামাজে জানাজায় যাচ্ছিলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনও পানিতে ডুবে গেছে। কিন্তু গাড়ির স্টার্ট তখনো বন্ধ হয়নি। অথচ গাড়ির ইঞ্জিন ডুবে গেলে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলে তিনি তা ঠিক করে যথাসময়ে নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। পানির মধ্যে ঠেলে সচল মোটর সাইকেলযোগে জাফর স্যার সেদিন আব্বার নামাজে জানাজায় উপস্থিতির ঘটনাটি অলৌকিক ও বিস্ময়কর বলে মনে করেন। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার তৎকালীন সহসভাপতি আলহাজ¦ এম এ ওহাব (বর্তমানে প্রয়াত) আব্বাকে খুবই ভালোবাসতেন। ১৯৯৭ সনে আনজুমান ট্রাস্ট পরিচালিত চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর মাদ্রাসা এ তৈয়বিয়া সুন্নিয়া ফাজিল এর অধ্যক্ষের পদে আব্বা নিযুক্ত হন। অত্যন্ত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পন্থায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন করে আব্বাজান তৈয়বিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। অনেক বাধা, চক্রান্ত ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তৈয়বিয়া মাদ্রাসায় পাঁচ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। বারে বারে নিজে জুুলুমের শিকার হলেও দীর্ঘ অধ্যক্ষ জীবনে কারো ওপর তিনি জুলুম চাপিয়ে দেননি। কাউকে চাকরিতে হয়রানি করেননি। অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে কারো চাপে কোথাও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেননি। (শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনৈতিক লেনদেন তো এখন অহরহ ঘটছে)। পূর্ণ সততা, দায়িত্বশীলতা, যোগ্যতা-দক্ষতার সঙ্গে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। মাদ্রাসা বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়মমাফিক তদন্তে আব্বার কাছ থেকে কোনো অসাধুতার প্রমাণ কখনো মেলেনি। মাদ্রাসার অর্থ লেনদেনে তিনি সাবধানতা অবলম্বন করতেন। হালিশহর তৈয়্যবিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ থাকাকালে একবার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের ভুলে আব্বার একাউন্টে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকা জমা হয়। এতে আব্বা বিস্মিত হন এবং বাড়তি টাকা ফেরত দেন। আব্বা চাইলে এই টাকা গচ্ছিত রাখতে পারতেন। কিন্তু ওই পথে তিনি যাননি। লোভ-লালসা তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। আব্বার সময়জ্ঞান ছিল অসাধারণ। অধ্যক্ষ হওয়া সত্তে¡ও সবার আগে অফিসে যেতেন এবং সবার শেষে অফিস ত্যাগ করতেন। তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল হাটহাজারী আনোয়ারুল উলুম নোমানিয়া ফাজিল মাদ্রাসা। আব্বাজান কেবলা (রহ.) চট্টগ্রাম নগরের হযরত হামজা খাঁ (রহ.) শাহী জামে মসজিদের টানা ২০ বছর ধরে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত খতিব পদে আসীন ছিলেন। আব্বার সুমধুর খুতবা, বক্তব্য এবং হৃদয়গ্রাহী কুরআন তেলাওয়াত শুনতে প্রতিটি জুমায় হাজার হাজার মুসল্লির সমাগম হতো। আব্বা এই মসজিদে যখন প্রথম যোগ দেন তখন মসজিদ ছিল একতলা বিশিষ্ট। বর্তমানে দৃষ্টিনন্দন ৩ তলা মসজিদ ও সুরম্য-সুউচ্চ মিনার নির্মাণের পেছনে আব্বার বড় অবদানের কথা সবাই স্বীকার করেন। আব্বাজান হামজার বাগ মসজিদের মুসল্লিদের কাছে কতটা পছন্দনীয় ছিলেন তা দেখা গেছে তাঁর ইন্তেকালের পর। মুসল্লিরা আব্বার কফিনবাহী গাড়ি সেদিন ঘিরে রেখে মসজিদ কবরস্থানে তাঁকে দাফন করার জোর মিনতি জানান। ফলে মুসল্লিদের অনুরোধে মসজিদ ও হযরত হামজা খাঁ (রহ.) মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে নামাজে জানাজায় দূর দূরান্ত থেকে শত শত আলেম ও সর্বস্তরের হাজার হাজার ছাত্র জনতার বিপুল ঢল দেখে প্রমাণিত হয় তিনি কতটা জননন্দিত ও সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অধ্যক্ষ আল্লামা ক্বারী নূরুল আলম খান (রহ.) এর ৭ জন পুত্র সন্তান এবং ২ কন্যা রয়েছে। ২০১৭ সনের ১৩ জুন (১৭ রমজান) আব্বাজান কেবলা (রহ.) ইহজীবন থেকে বিদায় নিলেও কর্মগুণেই তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। যাঁর প্রায় ৫০ বছরের শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বিভিন্ন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে এবং ইলমে দ্বীনের খেদমতে। আজ ২৬ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার চন্দনাইশের সৈয়দাবাদের নিজ বাড়ি নূর মঞ্জিল প্রাঙ্গণে জশনে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এবং তাঁর ৪র্থ বার্ষিক ইসালে সওয়াব মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এতে বিশিষ্ট বরেণ্য ওলামা মাশায়েখরা অতিথি ও আলোচক থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট