অতীত মোছা যায় না, ভবিষ্যৎ বদলানো যায়

15

 

যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব সেদিন থেকে জবরদখল, সেদিন থেকেই রাজনীতির শুরু। অতএব রাজনীতি মানেই অপরের রাজ্য-সম্পদ আর ক্ষমতা দখলের চর্চা। অ্যারিস্টটল, কার্লমার্ক্স এঁরা রাজনীতিকে সভ্য-শোভন ও গণমানুষমুখি করে তোলার চিন্তা-ভাবনা করেছিরেন। রাজনীতিকে গণমানুষের মুক্তির কথা বলে অধিকারের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে তা শিখিয়েছিল কার্ল মার্ক্স। গত শতকের ৮০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বিপর্যয় নেমে আসে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে। রাজনীতি থেকে সুস্থ সভ্যতা ও মানবতাবোধ বিদায় নিয়েছে তখন থেকে। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিকে প্রতিনিয়ত অমানবিক করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে পুঁজিবাদী বিশ্বের নয়া কৌশল। এজন্যে বিশ্বের দেশে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতেও ব্যাপৃত তারা। ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্ব মোড়ল। যে দেশটি প্রকৃত অর্থে কোনো দিন বিশ্বের কোনো সাধারণ মানুষ অর্থাৎ নির্যাতিত নিপীড়িত-বঞ্চিত জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি। নিঃস্বার্থভাবে একটি দানা-পানি দিয়েও সাহায্য করেনি কোনো দেশ বা জাতিকে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে আমাদের এ অঞ্চলে রাজনীতিক বেচাকেনা অর্থাৎ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাসও নতুন নয়। রাজনীতিকরা বেচা-বিক্রি হয়েছেন অনেক আগে থেকেই। বেশি পেছনে না গিয়ে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের কথাই ধরি। যে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথাই ধরি। সেদিন মীরজাফর বিক্রি হয়েছিলেন বলেই বাংলার পতন হয়েছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল। সেদিনের যুদ্ধে মীরজাফর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বিশ্বাসঘাতকতা না করলে উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো হয়ত। অন্তত ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হওয়ার গ্লানি আমাদের বহন করতে হতো না। পরে ভারতজুড়ে এমন হাজার হাজার মীর জাফরের কারণে ব্রিটিশরা ১৯০ বছর ভারত শাসন করে যেতে পেরেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে। রাজনীতি তখনও জমিদার জোতদার নবাব শ্রেণীর দখলে। অভিজাতরাই তখন মুসলিম লীগ করতেন। অবিভক্ত বাংলায় তখন একটু একটু পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কিছু তরুণ রাজনীতিকে গণ মানুষের করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে যাচ্ছে সে সময়ও রাজনীতিকরা কীভাবে বেচা-কেনা হতেন তার একটি চমৎকার বর্ণনা আছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে। তা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে তখন বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের পতন হয়েছে। অর্থাৎ পতন ঘটানো হয়েছে। ও সময়ের কথা, বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা (নিম্ন সভার সদস্য) এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি। আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হলো। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে। কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নেই, বিরোধীদল টাকা দিয়েছে। আমি যদি কিছু টাকা আনতে যাই আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগ পক্ষেই দেব।” আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের। এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে ধরে আনা হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন। এ রকম আরেক এমএলএকে আনতে বঙ্গবন্ধুকে রংপুর পাঠানো হল। যুদ্ধাবস্থায় প্রায় উপোস থেকে তিনি ওই জমিদার কাম এমএলএর বাড়ি পৌঁছানোর পরে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু খাব কিনা। পথে খেয়েছি কিনা। বলতেন, এখনতো রাত তিনটা বাজে। বিছানার কি দরকার হবে? বললাম, দরকার নেই যে সময়টা আছে বসিয়েই কাটিয়ে দেব। ঘুমালে আর উঠতে পারব না। খুবই ক্লান্ত। একদিকে পেট টনটন করছে, অন্যদিকে অচেনা রংপুরের মশা। একদিন পরে তিনি এসেছিলেন (কলকাতায়) তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রাখা হয়েছিল। তবু পেছনের দরজা দিয়ে এক ফাঁকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে পাওয়া যায় নি। আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালোবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম। এই সকল জঘন্য নীচতা এই প্রথম দেখলাম। পরে যদিও অনেক দেখেছি। এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে ইংরেজদের তাড়ানো যাবে। বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হয়।
এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের (এম.এনএ, এম এলএ) শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। টাকার বিনিময়ে নিজদলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে যেন ষড়যন্ত্র পাকাতে না পারেন সে লক্ষেই বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ সংযোজন করেন। এ আইনের কারণে বর্তমানে কোনো সংসদ সদস্য ফ্লোর ক্রস করতে পারে না, অর্থাৎ নিজদলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে না সংসদে।
স্বাধীন বাংলাদেশে নেতা বেচাকেনার সংস্কৃতি চালু হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনককে হত্যার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া তখন ইচ্ছা পোষণ করলেন রাজনীতি করবেন। দল গঠন করবেন। জড়ো করলেন শাহ আজিজদের মতো শীর্ষ রাজাকারদের। অন্যান্য দল থেকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য ভয় দেখিয়ে অর্থ দিয়ে অন্যদল থেকে নেতা ভাগিয়ে গঠন করলেন রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, চীনাপন্থি কমিউনিস্ট, মুসলিম লীগার ও নীতি ভ্রষ্ট রাজনীতিক নিয়ে গঠিত হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তৎকালে স্বাধীনতা ও আওয়ামীলীগ বিরোধী সবাই জড়ো হলেন জেনারেল জিয়ার পেছনে।
পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদও তার গুরু জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। অন্যদল থেকে নেতা কিনে দল গঠন করেছেন। যুগে যুগে মীরজাফর থেকে কাজী জাফর, রায় বল্লভ থেকে মওদুদের মতো নেতার অভাব হয়নি রাতারাতি ভোল পাল্টাতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার বিনিময়ে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে যারা রাজনীতির সুবিধাবাদিতাকে জিইয়ে রেখে নিজেদের ক্ষমতা ও লাভের অংশীদার করে রাখতে চান বর্তমান রাজনীতিতে তো তাদেরই খেলা চলছে। রাজনীতিকদের জন্যে রাজনীতিকে সত্যি কঠিন করে গেছেন জেনারেল জিয়া। তাই দেশে আজ পরীক্ষিত, সৎ নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক নেই বললেই চলে। রাজনীতির নিয়ন্তা আজ পেশিশক্তি, কালোটাকার মালিক। যারা নিজেদের বিক্রি করার জন্যে কোরবানি পশুর মতো সেজে গুজে থাকেন।
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিএনপি ক্ষমতায় নেই ১৫ বছর, দুর্নীতিতে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা কীভাবে? কথাটা ঠিক তবে আংশিক কারণ পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশে সকল অনিষ্ট ও অসততার সূত্রপাত ঘটেছে জিয়া-এরশাদ নামের দুই জেনারেলের হাত ধরে। আজ সে সংস্কৃতিকে বহন করতে হচ্ছে আমাদের।
জাতিসংঘ অধিবেশন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে গত সোমবার গণভবন থেকে এই ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুষ্ঠানে বিএনপির সা¤প্রতিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা দল কীভাবে জিতবে? তার নেতৃত্ব কোথায়? একজন এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আরেকজন একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ নানা ধরনের কর্মকাÐের ফলে দেশান্তরি, সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাহলে জনগণ কোন ভরসায় ওই দলকে ভোট দেবে আমাকে সেটা বলেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণ কখন ভোট দেয়। তারা আগে দেখে ক্ষমতায় যাবে কে। যদি এখন এটাই হয় যে একজন এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, আরেকজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারা তো ইলেকশনও করতে পারবে না।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন তোলে, এই দলটির জন্ম কিভাবে? এই দলটি কি কোনো নির্বাচিত নেতৃত্ব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বা এমন কোনো নেতা যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা নিয়ে কোনো আন্দোলন করেছে বা কিছু করেছে? সুবিধাবাদী ও বলতে গেলে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের হাতে গড়া একটি সংগঠন।’ তিনি বলেন, ‘এরা বলতে গেলে সব সময় পরভাতে পালিত। এখন সেই জায়গাটা তাদের আর নেই। এজেন্সিগুলোর সুবিধা নিয়ে তাদের তৈরি করা হয়েছিল। যেহেতু বিএনপি ক্ষমতায় নেই, সে কারণে এজেন্সিগুলোতে তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই বা তাদের ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে না।’
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভাষায় বক্তব্য দিলেও শেখ হাসিনার অভিযোগ ও বিএনপি নিয়ে মূল্যায়ন মিথ্যে নয়। বিএনপিকে আজ প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে।
বিএনপি সৃষ্ট রাজনৈতিক কূটচালে নিজেরাই আজ পতিত হয়েছে। তাতে বিস্ময়ের কী আছে?
বিএনপি চিন্তা ও কর্মে সৎ হলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎকে পাল্টাতে পারতো। কিন্তু তা তারা করেনি, করার পরিকল্পনা আছে বলেও মনে হয় না।

লেখক : সাংবাদিক