অতিরিক্ত শব্দদূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ জরুরি

21

পরিবেশ দূষণের আরেক নাম শব্দ সন্ত্রাস। দূষণের নানা মাত্রিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে শব্দদূষণও বাড়ছে। বায়ু দূষণ, দৃশ্য দূষণ, পানি দূষণ, যানজট ইত্যাদি বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। পরিবেশগত এসব সমস্যাগুলো দিনদিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব। বিশেষ করে বায়ু দূষণ আর শব্দ দূষণে চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকা কত নাজুক অবস্থায় আছে তা বলাই বাহুল্য। বায়ু দূষণ আর শব্দ দূষণের বিপর্যস্ত অবস্থার কথা উঠে এসেছে সা¤প্রতিক কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনেও।
আমরা জেনেছি, কিছুদিন আগেই বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশের তালিকার শীর্ষ স্থানে নাম আসে বাংলাদেশের। সে রেশ কাটতে না কাটতেই শব্দ দূষণেও ঢাকা শীর্ষস্থানের খবর পাওয়া গেছে। এটি কিন্তু আমাদের জন্য নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। স¤প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করে করা ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, শব্দদূষণে বিশ্বে ঢাকা এখন শীর্ষস্থান দখলকরী শহর। ঢাকার পরেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ভারতের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাজশাহী। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। সুতরাং ঢাকা ও রাজশাহীর শব্দের তীব্রতা যে কত ভয়াবহ অবস্থায় আছে তা এ প্রতিবেদন থেকে সহজেই অনুমেয়। রিপোর্টে বাংলাদেশের আরো একটি শহরের কথা উঠে এসেছে- টাঙ্গাইল। যেখানে শব্দের তীব্রতা ৭৫ ডেসিবেল। এটি শীর্ষ পাঁচ বা শীর্ষ দশে না থাকলেও একটি দেশেরই তিনটি শহর শব্দ দূষণের তালিকায় থাকা কম উদ্বেগের বিষয় নয়। সুখের বিষয় ওই তালিকায় চট্টগ্রাম নেই। তাই বলে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর গিলতে নেই। গতকাল শুক্রবার দৈনিক পূর্বদেশে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত পতিবেদনে বলা হয়েছে, শব্দের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণের জন্য পাঁচটি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে- নীরব এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, আবাসিক এলাকা, শিল্প এলাকা এবং মিশ্র এলাকা। এসব এলাকায় শব্দের একটি মানমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শব্দের মানমাত্রা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবেল, রাতে ৪০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবেল, রাতে ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবেল, রাতে ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৭০ ডেসিবেল। চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর এসব এলাকায ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করে অতিরিক্ত শব্দদূষণ ছাড়া সহনীয় মাত্রার কোন শব্দের খোঁজ পায়নি। এসব এলাকায় ৩০ থেকে ৫০ ডেসিবল বেশি মাত্রায় শব্দের তীব্রতা পেয়েছে। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬- এ বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা, যেখানে কোনো ধরনের হর্ন বাজানো যাবে না। অথচ কি হাসপাতাল, কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিস- আদালত, সকল জায়গায়-ই হরহামেশাই চলে শব্দের ঝনঝনানি। আইনে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন চালানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা বিন্দুমাত্র মানার বালাই নেই। নগরীতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায় দিন নেই রাত নেই চলছে পাইলিং-এর কাজ; যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ইট ভাঙার যন্ত্র বা সিমেন্ট মিকচারের। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, নগরীর শব্দ দূষণের অন্যতম উৎস যানবাহন ও মোটরবাইকের হর্ন। ২০১৭ সালে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের শব্দ দূষণের ওপর করা এক জরিপ বলছে, আটটি শহরেই ৮০ শতাংশ শব্দদূষণ করে যানবাহনের হর্ন। ২০ শতাংশ বাকিগুলো। আর ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের হর্ন। এর সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিশেষ দিবস, বিভিন্ন উৎসব ও বিনোদনমূলক আয়োজন এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণাকে কেন্দ্র করে উচ্চশব্দে বাজানো মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহারও শব্দ দূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ তিরিক্ষি হওয়া, আলসার, হাইপার টেনশন, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও বিরক্তিভাব তৈরি হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিশু এবং বয়স্কদের। শব্দ দূষণ যেহেতু অসচেতনতা আর অবহেলার কারণে আমাদের দ্বারাই সৃষ্টি হচ্ছে, তাই একটু সচেতন হলেই এটি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। শব্দ দূষণের অপকারিতা ও ক্ষতি সম্পর্কে চালক, মালিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনাতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচার পত্র, সামাজিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করতে হবে। বিদ্যমান শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ এর কঠোর বাস্তবায়নও জরুরি। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরো জোর তৎপরতা চালাতে হবে।