অতিথি পাখিরা নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাক

53

রতন কুমার তুরী

খাদ্যের জন্য হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের জন্য আমাদের প্রত্যেকের মমত্ববোধ বাড়াতে হবে কারণ এসব প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ধনকারী অতিথি পাখিরা হচ্ছে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী। বর্তমানে আমাদের দেশে শীত বাড়ার সাথেসাথে সুদূর সাইবেরিয়া পাড়ি দিয়ে আসতে শুরু করেছে ঝাঁকেঝাঁকে অতিথি পাখি। এময়টাতে সাধারণতঃ পুরো সাইবেরিয়াতে অতিরিক্ত ঠাÐার কারণে পাখিদের খাদ্য বরফের নিচে ঢাকা পড়ে এবং এই অতিরিক্ত বরফের আস্তর কমতে কমতে প্রায় তিনমাস ক্ষেত্রবিশেষ আরো কয়েকমাস বেশি সময় লাগে আর এই সময়টিতে সাইবেরিয়ার পাখিদের মধ্যে চরম খাদ্যের অভাব দেখা দেয় আর তাই তারা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অপেক্ষাকৃত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল বাংলাদেশে চলে আসে খাদ্যের খোঁজে। উক্ত সময়টিতে বাংলাদেশে শীত পরলেও একেবারে বরফঠাÐা শীত পরেনা ফলে এসময়টিতে এখানে নদনদী, খালবিল, হাওড় বাওড়গুলোতে খাদ্যে পরিপূর্ণ থাকে। অতিথি পাখিরা সহজে এসব জায়গা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে খেতে পারে। এসব অতিথি পাখিদের খাদ্য সাধারণত ছোটছোট পোকামাকড়, ঝিলের ছোটছোট শামুক, নদীর ছোটছোট মাছ হওয়ায় এগুলো এসময়টিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাধারে যথেষ্ট পরিমাণ পাওয়া যাওয়ার কারণে অতিথি পাখিরা দূরদূরান্ত থেকে এদেশে প্রতিবছর আসে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অতিথি পাখিরা এদেশে আসাযাওয়া করতে থাকায় এখানে কিছু জায়গায় এদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে ওঠেছে। ফলে অতিথি পাখিরা এদেশে অনেকটা নিরাপদ মনে করে। এদেশের বেশিরভাগ মানুষই এসব অতিথি পাখিদের সাদরে গ্রহণ করেছে এবং কিছু জায়গায় মানুষ নিজ উদ্যেগে এদের জন্য অভয়ারণ্য
গড়ে তুলেছে এমনকী কিছু মানুষ এদের জন্য খাদ্যদ্রব্যও বিতরণ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাঝেমধ্যে কিছু চোরা পাখি শিকারিকে অত্যন্ত গোপনে এসব অতিথি পাখি শিকার করে বিক্রি করতে দেখা যায়। আর হাওড়,বাওড়ে কিছু মানুষকে পাখি ধরে তা রান্না করে খেতে দেখা যায় যা অত্যন্ত অমানবিক ও বেদনাদায়ক কাজ। যে পাখিগুলো দূরদেশ থেকে আমাদের দেশে ক্ষণিকের মেহমান হয়ে এসেছে তাদের শিকার করে মেরে ফেলা কিংবা তাদের শিকার করে ভক্ষণ করা তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায়না। এমনও দেখা গেছে যে অতিথি পাখিদের শিকারের জন্য বিষটোপ ব্যবহার করছে কিছু অমানবিক মানুষ। আর সে বিষটোপ খেয়ে শ’য়ে শ’য়ে পাখি মারা পরছে। এর বাইরে অতিথি পাখি শিকারের জন্য কেউকেউ জাল, ফাঁদ, এয়ারগান, লাইসেন্স করা বন্দুকও ব্যবহার করছে যা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায়না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধনকারী এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এসব পাখিদের নিরাপদে চলাচল এবং বসবাস করার জন্য ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন এবং ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দন্ডনের বিধান রাখা হয়েছে। বিশেষ করে অতিথি পাখি নিধন এবং এর অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ। ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত জেল জরিমানার বিধান আছে।
এদেশে প্রায় ৬ শ ৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে যারমধ্যে ৩ শ ৬০ প্রজাতি আমাদের দেশের স্থায়ী পাখি এদের জন্ম বেড়ে ওঠা এবং সব এদেশেই। ভোর হলেই এসব পাখিদের আমরা আমাদের আঙ্গিনায়, বাড়ির পাশে পুকুরের ডোবায়, ঝিলে এবং বনবাদাড়ে হরহামেশাই দেখতে পাই ফলে এসব পাখি আমাদের জীবনের সাথে মিশে গেছে অত্যন্ত গভীরভাবে। ময়না, টিয়া, কাকাতুয়ার নাম জানেনা এদেশে এমন কেউ নেই। চড়ুই, শালিক, কাক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা দেখলেই আমরা চিনি। এর বাইরে প্রায় ৩ শ প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে অস্থায়ীভাবে শীতের সময় আসে আবার তারা নিজ দেশে ফেরত চলে যায় এসব অস্থায়ী অতিথি পাখিদের মধ্যে প্রায় ১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে যারা এদেশে থেকে যায় এবং এদেশের পাখিদের সাথে মিশে গিয়ে একসময় এসব পাখি এদেশের স্থায়ী পাখিতে পরিণত হয়।
২৯০ প্রজাতির অতিথি পাখির মধ্যে বেশিরভাগই হাঁস প্রজাতির পাখি এদেশে আসে আর এসব পাখি মানুষকে ভয় পায় কম তাই এরা মানুষের আশেপাশে বসবাস করতে পছন্দ করে এই সুযোগ পাখি শিকারীরা এদের শিকারেমপরিণত করে। এ বিষয়ে টাঙ্গুয়ার হাউস, হাকালুকি লেক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু জায়গায় কর্তৃপক্ষ কঠোর ভূমিকা পালন করলেও আমাদের দেশে এমনকিছু হাওড়, বাওড় আছে যেখানে অতিথি পাখিরা আসে কিন্তু সেখানে প্রশাসনের তেমন নজরদারি থাকেনা ফলে এই জায়গাগুলোতে অতিথি পাখিরা চোরা শিকারে পরিণত হয় এমনকী এদেরকে শিকার করে কেউকেউ আবার উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রিও করে যা ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। প্রকৃতপক্ষে শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে আসা অতিথি পাখিদের রক্ষার দায় আমাদের। আমরা চাইলে এসব চোরা পাখি শিকারিদের আইনের হাতে তুলে দিয়ে প্রকৃতির এই সুন্দর পাখিদের জীবন বাঁচিয়ে প্রকৃতিকে আরো সুন্দুর রাখতে পারি।
সচরাচর শীতের সময় এদেশে অতিথি পাখিরা যখন আসতে থাকে ঠিক তখন এসমস্ত চোরা শিকারিদের দেখা যায়, এরা সুকৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে এসব নিরীহ পাখিদের ফাঁদে ফেলে হত্যা করে। যদি আমরা সজাগ থাকি শীতের সময় এসব চোরা পাখি শিকারীদের পাখি শিকার করতে নিরুৎসাহিত করি, তাদের কাছ থেকে কেউ শিকার করা অতিথি পাখি না কিনি তাহলে তারা পাখি শিকার বন্ধ করতে বাধ্য হবে। তাও যদি না পারি তাহলে এসব পাখি শিকারিদের যেকোনো উপায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি এসব চোরা পাখি শিকারীদের বিরুদ্ধে আইনমত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করেন তাহলে অতিথি পাখি শিকার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে। মুলতঃ জনসচেতনতা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগই পারে অতিথি পাখি শিকার রোধ করতে। তাই আসুন আমরা সবাই সজাগ হই। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে অতিথি হয়ে আসা অতিথি পাখিদের এদেশে নিরাপদে বিচররণ করতে সহায়তা করি এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করি। প্রতিটা শীতে অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠুক আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আবার শীত শেষে তারা সুখস্মৃতি নিয়ে নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাক এমন প্রত্যাশা সকলের।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক