অতিথি পাখিদের যথাযথ আতিথেয়তা দরকার

16

এমরান চৌধুরী

বিচিত্র উপাদানে সাজানো গোছানো আমাদের প্রিয় আবাস এই পৃথিবী। ডানে বামে কিংবা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ যেদিকে চোখ রাখি না কেন দেখা যাবে সৃষ্টিকর্তা অকৃপণ হাতে উজাড় করে দিয়েছেন নানান উপাদান। গাছপালা, নদী-খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত প্রকৃতির এসব উপাদান আমাদের চারপাশকে করেছে অপূর্ব। আমাদের দুচোখে যুগিয়েছে অপার রূপের ঝলক। এই ঝলক, এই অপূর্ব চিত্রই আমাদের পরিবেশ। আর এই পরিবেশের একটি অন্যতম উপাদান, অনন্য উপহার পাখি। পাখিরা পরিবেশের বন্ধু, আমাদের অকৃত্রিম সুহৃদ। জল- স্থল-অন্তরীক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যচারী সৃষ্টির পরম বিস্ময় প্রাণি- পাখি। গীতিময় গতিময় বনফুল এরা। ডানার মুক্ত ছন্দে, রঙ আর কাকলীর মোহন বৈচিত্রে এরা সুখ ছড়ায়, নীড় থেকে নীলিমায়। সীমার মাঝে আনে অসীমের সুর। দিকে দিকে রঙ ছড়িয়ে সুর ঝরিয়ে মধুময় ও মাতাল করে তোলে দখিন হাওয়ার ভুবন। সে সুরে ভোর হয়, সূর্য ওঠে, ফুল ফোটে, জীবন জাগে। পাখির গানেই ঘুম ভাঙে, জেগে ওঠে, ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’।
পাখিরা দেখতে কত যে সুন্দর তা দেখতে হলে আমাদের জলা-জঙ্গলে, গাছপালায় সুশোভিত জনপদে ঢু মারতে হবে। তবেই দেখা মিলবে বিচিত্র প্রজাতির পাখি। আমরা কাকের কর্কশ স্বরে বিরক্ত হই, পর মুহূর্তে দোয়েল আর কোকিলের মিষ্টি সুরে মুগ্ধ হই। বাড়ির চালার ফাঁকে ময়নার উড়াউড়ির দৃশ্য দেখে আনন্দ পায় না এমন মানুষ গ্রামবাংলায় খুব কমই আছে।মানুষের মতোই পাখিরও গলার স্বরে-সুরে রয়েছে বৈচিত্র্য। শুধু গলার স্বর ও সুরে নয় পাখিদের কাছে মানুষের শেখার আছে অনেক কিছুই। কবির ভাষায় তাই বলতে হয়, স্বাধীনতা মানে পাখিরাই জানে/ আমরা কি জানি ছাই!/ আকাশের ওড়ার কত সুখ আহা/ জানে শুধু পাখিরাই। সত্যিই তাই। পাখিদের ওড়া দেখে মানুষের সাধ জাগে আকাশের ওড়ার। আর মুক্ত ডানার অবাধ উড়াল মানুষের ভেতর জাগিয়ে তোলে স্ব-অধীনতার বোধ।
পাখিরা অরণ্যের আপনজন। প্রকৃতির প্রিয়। আমাদের সত্যিকারের সুহৃদ। এদের বর্ণনায়, বন্দনায় ভরপুর আমাদের শিল্প, সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আজকের প্রতিভাবান সব কবিই গানে কবিতায় প্রকৃতির অনুপম রূপের নিপুণ চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। বসন্তের দূত কোকিল। অনেকে আবার বসন্তের দূত হিসেবে দোয়েলকে স্থান দিয়েছেন। তাদের যুক্তি কোকিল বারমাসই ডাকে। বসন্ত গ্রীষ্মে কিছু বেশি ডাকে এই যা। আর দোয়েল শীতে ডাকেই না। তার গলাতেই ঘোষিত হয় বসন্তের আগমন বার্তা। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন দোয়েলের আগমন সবার আগে। রবীন্দ্রনাথের গানে এক সঙ্গে দুটো নামই উঠে এসেছে- দখিন হাওয়া হেঁকে বেড়ায় জাগো জাগো দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানে নাগো। এ অপূর্ব সুন্দর পাখিদের নিয়ে আমাদের পরিবেশ। প্রকৃতির সোনায় সোহাগা ঐতিহ্যের প্রধানতম উপাদান এরাই। প্রকৃতির এই সোনায় সোহাগা রূপকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে শীতের অতিথি পাখিরা। আমাদের দেশে শীতের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে থাকে। পাখিদের ঋতুভিত্তিক আগমন একটি নিয়মিত ব্যাপার। সাধারণত খাবার অথবা বাসস্থান পরিবর্তনের জন্য পাখিরা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে এসে থাকে। এ জন্য এরা কখনো স্বল্প দূরত্ব, কখনো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে থাকে। অতিথি পাখিরা একটা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আবার পূর্বের স্থানে ফিরে যায়। এজন্য একে পরিযায়ী পাখিও বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের একজন ছড়াশিল্পীর ছড়ায় অতিথি পাখিদের পরিচয় ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে
কেউ বলে পরিযায়ী /কেউ যাযাবর
বুনোহাঁস, খন্জনা/ জল কবুতর।
হাড়গিলা, কাঁদাখোঁচা/ বক, গাঙচিল
পেলিক্যান, গুলিন্দা/ সারস, কোকিল।
ভরত, চটক, থ্রাস/ বিলাতি শালিক
ওরা যেন আকাশের/ আসল মালিক।
শীত এলে উপকূল / জলাশয়, চর
হয়ে ওঠে দিনরাত/ ভীষণ মুখর।
পাখি মানে- প্রকৃতি /সুন্দর দিন
অতিথি পাখিরা হোক/অবাধ স্বাধীন।
উপর্যুক্ত অতিথি পাখি ছাড়াও বাংলাদেশে অরও বহু বিচিত্র নামের অতিথি পাখির দেখা পাওয়া যায় যেমন-লেজাহাঁস, পান্তামুখি, ধূসর, বড়ভুটি, লালশির, নীলশির, জিনিয়া হাঁস, বামুনিয়া হাঁস, চিত্রা, চিতি হাঁস, বান চাহা, ছোটচোগা, জুরালি, জলরচা, ধেঙ্গা, লাল-পা-পিও, হত-তি-তি, গঙ্গা কইতর, মহাকই, জলদস্যু, খোপা ডুবুরি প্রভৃতি।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই পাখিরা অভিগমন করে আসছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিশ্বের প্রায় ১০০০ প্রজাতির পাখি অভিগমন করে থাকে। বাংলাদেশে প্রতি বছরই হিমালয় অঞ্চল, সাইবেরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে অতিথি পাখি আসে। সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আগমন করে। বাংলাদেশে যে পথ ধরে অতিথি পাখিরা আসে তা মধ্য এশিয়ান ফ্লাইওয়ে বা মধ্য এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে বা মধ্য এশিয়ান-সাউথ এশিয়ান ফ্লাইওয়ে নামে পরিচিত। এই পথের পাখিরা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বসবাস করে। বালাদেশে মোট ভূ-ভাগের প্রায় দুই তৃতীয়াংশই জলাভূমি, যা অতিথি পাখির অবাধ বিচরণের জন্য উপযুক্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির পাখি আছে বলে জানা যায়। এই ৬২৮ প্রজাতির পাখির মধ্যে ২৪৪ প্রজাতিই অতিথি পাখি। আমাদের দেশে জলাভূমিগুলো প্রায় ৭০ প্রজাতির অতিথি পাখির আবাসস্থল।
বাংলাদেশে যে সব স্থানে অতিথি পাখিরা ভিড় করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হলো- চলনবিল,। সুন্দরবন, মেঘনার মোহনা, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর এবং সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, উত্তর- পশ্চিমের জলাভূমি অঞ্চল। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্বিদ্যালয়ে প্রতি বছর প্রচুর অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ অতিথি পাখিদের প্রতি সর্বোত্তম নজর রেখে থাকে। এমন কি অতিথি পাখিদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর পাখিমেলারও আয়োজন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এর মধ্যে ৩১ প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশে অতিদ্রæত জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি। ফলে অতিথি পাখিরা বাস্তুহারা হয়ে সরে যাচ্ছে দূরে অনেক দূরে। বিলোপ হয়ে যাচ্ছে বন বনানী থেকে। পাখি শিকারীদের বা অসাধু ব্যবসায়ীদের লালসার শিকার হচ্ছে ফুলের মতো নিষ্পাপ পাখিরা। অবাধে পাখি শিকার আর নিধন পর্ব চলছে শুধু বাংলাদেশে নয়- সারা জগতজুড়ে। এখনও যা আছে আমাদের আশেপাশে সেখানে আইনের নিষেধ অমান্য করে হানা দেয় শিকারীরা। বাংলাদেশে পাখির অবাধ বিচরণের জন্য বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, বন আইন ১৯২৭ (সংশোধিত ২০০০) ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭ রয়েছে। কিন্তু এ সব আইনের তোয়াক্কা কেউ করে বলে মনে হয় না। প্রতি বছর শীত মৌসুমে যে হারে অতিথি পাখি শিকার করা হয় তা দেখে যে কোনো সচেতন নাগরিকের তা এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।
পাখিরা আমাদের পরম সুহৃদ, উপকারী বন্ধু। তা দেশীয় পাখি হোক কিংবা অতিথি পাখি হোক। এরা শুধু রোমান্টিক মনের চাহিদা মেটায় না, জীবনহানিকর জীবাণু ধ্বংস করে আমাদের প্রজন্মকে সুস্থ ও নিরোগ রাখতে সাহায্য করে। চাষপক্ষীরা ফসলের ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে ফলন বাঁচায়। গাছের পোকা খেয়ে গাছকে বাঁচায় কীটের হাত থেকে। এরাই ফুলে ফুলে পরাগরেণু ঘটিয়ে ফলভারে শাখা ভরে দেয়। বীজ ছড়িয়ে সৃজন করে অরণ্য। শুধু রূপে আর গানে নয়, নানাভাবে এরা ভরে দেয় পৃথিবীকে। তাই বাংলাদেশে যত অতিথি পাখি আসে সেগুলোর যথাযথ আতিথেয়তা দরকার। কারণ প্রকৃতিতে তথা বাস্তুসংস্থানগত গুরুত্ব রয়েছে অতিথি পাখির। জীববৈজ্ঞানিক খাদ্য শিকলের ভারসাম্য রক্ষায়ও অবদান রাখে অতিথি পাখি। এমন পরোপকারী, অকৃত্রিম অতিথি পাখিকে আমরা এখনও আপনার করে নিতে পারিনি। অথচ পক্ষিবিদরা আমাদের বধির কানে সেই কথাটিই দীর্ঘকাল ধরে বলে আসছে। পাখিরা কেবল সুন্দর নয়, এরা আমাদের উপকারী বন্ধু। কৃষকের, ফসলেরও পরম বন্ধু সে বৃহস্পতিরও। সে শুধু সুন্দর নয়, মানুষের সুহৃদ। যত তাড়াতাড়ি এ উপলব্ধি আমাদের অন্তরে প্রোথিত হবে ততই দ্রæত প্রকৃতি, পরিবেশ, মাটি ও মানুষের সাধিত হবে অশেষ কল্যাণ।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক