অচলাবস্থা কাটছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে

94

ওয়াসিম আহমেদ

আট বছর ধরে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চেষ্টা চালিয়ে আসছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এ নিয়ে অন্তত দুই ডজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছিল সংস্থাটি। কিন্তু বাস্তবায়নের আলো দেখাতে পারেনি। এমনকি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাথে চুক্তি করেও পর্যাপ্ত জায়গা ও বর্জ্যের যোগান দিতে না পেরে অধরা রয়ে যায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বপ্ন। তবে এবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অচলাবস্থা কাটছে।
ইতোমধ্যে চীনা প্রতিষ্ঠানের সাথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। একইভাবে চলতি মাসের মধ্যে চসিকের সাথে চুক্তি করার কথা রয়েছে বলে পূর্বদেশকে জানিয়েছেন সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনতে হলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর চেষ্টা করছি আশার আলো জাগাতে। গত ১৮ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি’র সাথে দেখা করেছি। তিনি জানিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটি নিয়ে আন্তরিক। গতকাল (বুধবার) ঢাকায় হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে আমাদের সাথে চুক্তি হওয়ার কথা। জায়গা নিয়ে আমাদের সংকট রয়েছে। তাতে সমাধান বের করে কাজ করতে আগ্রহী অনেক প্রতিষ্ঠান। জায়গা আছে সাড়ে ৬ একর এবং দৈনিক আড়াই হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ হয়। এসবের মধ্যে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হলে বর্জ্য সংগ্রহে শৃঙ্খলা আসবে মন্তব্য করে সিটি মেয়র আরও বলেন, তখন বর্জ্যগুলো আলাদা করে সংগ্রহ করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানই করবে। সেক্ষেত্রে আমাদের জনবল সঠিকভাবে ব্যবহার হবে। ইতোমধ্যে ইনসিনারেশন প্লান্ট বসানোর ব্যবস্থা করছি, যাতে মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে পুড়িয়ে পরিবেশে জীবাণু না ছড়ায়।
জানা গেছে, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে দেশে। ঢাকার আমিন বাজারে নির্মাণ করা হবে ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর রসদ আসবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে। ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি টাকায় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে চীনের মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোশেন (সিএমইসি) কোম্পানি। তারাই পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। সিটি করপোরেশন প্রয়োজনীয় জমি ও নিয়মিত বর্জ্য সরবরাহ করবে। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে বিদ্যুৎ বিভাগ। এই লক্ষ্যে বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে সিএমইসির সঙ্গে চুক্তি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগ।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ আবর্জনা প্রয়োজন হবে, তা সরবরাহ করলে শহরে ময়লার সমস্যা কেটে যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। কার্যক্রম শুরু হওয়ার ১৮ মাসের মধ্যে উৎপাদনে যাবে চীনা কোম্পানিটি। এ ব্যাপারে সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোশেন, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামসহ দেশের সকল সিটি করপোশেন, বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌরসভাগুলোতেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, যেসব বিভাগীয় বা জেলা শহর অথবা পৌরসভা প্রতিদিন ৬০০ টন বর্জ্য সরবরাহ করতে পারবে, তারা বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে সমন্বয় করে সরাসরি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারবে।
এ দিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চসিকের বর্জ্য সংগ্রহের উপর প্রতিবেদন তৈরি করে জাইকা (জাপান উন্নয়ন সংস্থা)। এটি চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ জরিপ। সেই জরিপে চট্টগ্রাম নগরে দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হলেও চসিক সংগ্রহ করতে পারে ২ হাজার টন। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সংগৃহীত ২ হাজার টন বর্জ্যরে মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবহার করা যাবে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২ টন। অন্যদিকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন দৈনিক আড়াই হাজার টন ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য।
পিডিবি’র চাহিদা অনুযায়ী জায়গা ও বর্জ্যরে যোগান দিতে না পারলেও সক্ষমতার মধ্যে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করে আসছে চসিক। এ নিয়ে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ছয়টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাবসমূহ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এসব প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরপর বিদ্যুৎ বিভাগের মতামতের জন্য পাঠানো হবে বলে জানানো হয়।

কেন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন: সিটি করপোরেশন শহরের সবধরনের বর্জ্য সংগ্রহ করে। এসব বর্জ্য নির্দিষ্ট জায়গায় স্তূপ করে রাখে। সময়ের সাথে সাথে বর্জ্যরে স্তূপের আকার বড় হলে বিশাল পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন পড়ে। উন্মুক্ত জায়গায় বর্জ্য রাখায় পরিবেশও দূষিত হয়। তাই বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে একদিকে জায়গার সাশ্রয় এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি স্থায়ী সমাধান হবে আর অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা হ্রাস ও নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি পাবে।

বিফলে যাওয়া যত উদ্যোগ : গত বছরের ১৮ নভেম্বর চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের সাথে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব নিয়ে সোলার্স পাওয়ার লিমিটেডের অঙ্গ সংগঠন এনডিওরিং এনার্জির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করে। প্রতিনিধি দলটি করপোরেশনের সংগৃহীত বর্জ্য থেকে সলিড রিকোভারড ফুয়েল (এসআরএফ) পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুবিধা এবং এর জন্য কি পরিমাণ জায়গা প্রয়োজন তা চসিক প্রশাসকের কাছে উপস্থাপন করে। কিন্তু তারাও প্রজেন্টেশন দিয়ে হারিয়ে যায়। কার্যকরী কোনো পদেক্ষেপ দেখা যায়নি। সে সময় এনডিওরিং এনার্জি জানায়, প্রকল্পের জন্য তাদের মোট ৩০ একর জায়গা ও প্রতিদিন আড়াই হাজার টন বর্জ্য প্রয়োজন হবে। একই সাথে তারা উল্লেখ করেন, এসআরএফ পদ্ধতিতে কয়লা থেকে ফুয়েলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ শতাংশ কার্বন, ৮৫ শতাংশ নাইট্রোজেন, ৯০ শতাংশ সালফার, ৫০ শতাংশ ক্লোরিন নিঃসরণ করে কয়লার চাইতে পানির মাধ্যমে ৪০ শতাংশ সমন্বয় সাধন করা যাবে। যা পরিবেশের জন্যও উপযোগী।
একটন কঠিন বর্জ্য থেকে ৫৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বর্জ্য পুড়িয়ে এর পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব হয়। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১৩ সালে ইতালিয়ান কোম্পানি ‘ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএলের’ সাথে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি চুক্তি হয়েছিল। কথা ছিল, কোম্পানিটি রাজধানীর বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এবং পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি করে ১০০ মেগাওয়াট করবে। কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।
পরবর্তীতে ‘রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানির’ একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আগ্রহ দেখায়। তবে সে উদ্যোগও বেশি দূর এগোতে পারেনি। এসব ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি উদ্যোগ নিলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমোদন জটিলতার কারণে সফল হয়নি। আবার ২০১৫ সালে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এমন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোশেনকে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ও ২৯ ডিসেম্বর এবং ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়া প্রেরণ করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। সেখানে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি চসিক। এরপর ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট এবং ১৫ অক্টোবরও পিডিবি খসড়া পাঠায় চসিককে, যেখানে ২৫ মেগাওয়াটের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবরে সমাঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তবে সেবারও ভ‚মি জটিলতায় কাক্সিক্ষত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।