অঙ্গুরি

26

 

তার অভিযোগ খুব একটা ছিলো না। যা দিতাম তাই খুশিমনে গ্রহণ করতো। প্রথম প্রথম কোনো কিছু চাওয়াটাও তো চাইতে জানতো না! আবদারও খুব একটা ছিলো তাও কিন্তু নয়। কেউ চাইতে জানে না বলে তাকে না চাওয়ার বন্দরে আটকে রাখার মানুষ আমি নই। আমি চাই সে আমার কাছে কোনো না কোনো কিছুর আবদার করুক। বিলকুল করুক। তাই নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করতাম- কিছু লাগবে কি? তার সরল জবাব- না, সবই তো আছে। কি আর চাইবো? একদম সাদামাটা জবাব। চাওয়ার একটা শিল্প আছে- এটা আমি জানি। কিন্তু সেই শিল্পে তাকে গাহন করার ইচ্ছে জাগে আমার। আমি বারবার তাকে বলতেই থাকি- সংকোচ করো না, লাগলে বলো? সেই একই কথা! মাঝে মাঝে তো নিরুত্তরই থাকতে পছন্দ করে। আমি চাই সে আমার কাছে কোনো কিছুর আবদার করুক। হোকনা সেটা দুর্মূল্যের বাজারে দুপয়সারও। আমার তাগিদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তার দু’একটি প্রয়োজনের কথা আমায় বলে সে। তাও প্রয়োজনেরও প্রয়োজনীয় বিষয়। যেসব না হলে নারীর চলে না। আমি খুব করে বুঝি এসব চাওয়া-টাওয়া প্রকৃতই কোনো চাওয়া নয়। ওই যে বললাম, আমার তাড়নার ঝাড়ি খেয়ে কিছু একটা বলা মাত্র!
বাবার একক সিদ্ধান্তে তাকে বিয়ে করেছিলাম। রূপলাবণ্যে আহামরি না হলেও শ্যামবর্ণের চেহারায় অতো মন্দও না। সিøম ফিগার, নিষ্পাপ চেহারা, গালে কালো তিল তার সৌন্দর্য আর সৌকর্যকে সমৃদ্ধি দানিয়েছে। ঠোঁটের রক্তিম আভা; যেন বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে চৈতের অযতেœ ক্লান্ত একটিমাত্র গোলাপ। এমন মেয়েকে না ভালোবেসে উপায়ও নেই। কিন্তু সে আমাকে মন থেকে ভালোবাসতো কিনাÑ আমার কাছে এটা একটা রহস্য। লাজুক স্বভাবের এমন মেয়েদের কাছ থেকে এ রহস্য উদ্ঘাটন করা বেশ মুশকিল। আমি যে তাকে ভালোবাসি এবং নিঃসংকোচে ভালোবাসি; কোনো সন্দেহ নেই। আমার ভালোবাসার উষ্ণ পরশ কেটে এড়িয়ে চলতেও দেখি না তাকে। একান্তই আমার স্পর্শসুখে সুখী হতে দেখি তাকে। তার আলতো স্পর্শ উপভোগ করতাম ঠিক, স্নিগ্ধ হাসিতে স্বর্গ আসতো আমার প্রাণে এটাও সত্য, আমি উল্লসিত হতাম একথাও সঠিক। আমার স্পর্শে তার সম্বিৎ ঠিকঠাক কাজ কাজ করতো এও মিথ্যা নয়। সে যখন আমার চুলে অঙ্গুলি আচড়াতো তখন সত্যিই সে আমাকে ভালোবাসে এটাই মনে করতাম। আমি তখন তার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠতাম। বরাবরই আমি উপভোগে বিশ্বাসি। ভোগ ক্ষণিকের; কিঞ্চিৎ আনন্দে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু উপভোগের স্থায়িত্ব জন্মজন্মান্তর। উপভোগে ভোগ আছে, এর আনন্দটাও চিরস্থায়ী।
কম বয়সে তাকে আমি বিয়ে করি। বয়সের এই কমতি-খামতিই তাকে আড়ষ্ট করে রেখেছে আমার ধারণা। বয়সের কারণে অনেক কিছুই তার কাছে অজানা অচেনা। গুছিয়ে বলা তো দূরে থাক; কোনো কিছু গুছিয়ে করতেও পারতো না। গ্রামের লোকেরা মনে করে বিয়ে করে ঘরে বউ আনা মানে একজন ক্রীতদাসি নিয়ে আসা। পান থেকে চুল খসলেই যেন আসমান থেকে চন্দ্রতারা খসে পড়েছে! শ্বাশুড়িরা যেন একেকটা সামন্ত রাজা। যৌথ ফ্যামিলিতে শাসনের নামে দুঃশাসন তো আছেই। যেখানে শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, দেবর-ননদ এমন কি সুযোগ পেলে প্রতিবেশিরাও শাসাতে পারলে পুলক অনুভব করে। আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকার পক্ষে নই। সবার সাথে মিলেমিশে যৌথ সংসারই আমার আনন্দ। কিন্তু সে মনোগ্যামি পরিবারের ছোট সংসারের মেয়ে এবং ছোট মানুষ। তাদের পরিবারে সে অতিআদুরে লালিত একমাত্র কন্যা ছিলো। পড়ালেখায়ও খারাপ ছিলো না। তার নম্র-ভদ্র ব্যবহার এবং নিষ্পাপ চাহনি তার প্রতি আমার স্নেহভাগের পরিমাণটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তার এলোচুলে ঘুমন্তরূপ আমার কাছে অনন্য এক দৃশ্য। আমি চেয়ে থাকতাম আর মুখের উপর থেকে চুলগোছা সরিয়ে দিতাম। কি জানি তার মনের হাহাকার- ঘুমের ঘোরে মা, মা চিৎকারে ঘরটাকে উজালা করে দিতো। আমাকে জড়িয়ে ধরতো যেন আমি তার সাহসের অভয়ের শেষ আশ্রয়স্থল। আমি ছিলাম চাকরিজীবী। চাকরিস্থল দূরে হওয়া সত্ত্বেও আমি তার নিষ্পাপ চাহনির টানে ফিরে আসতাম। সে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতো, কি যেন বুঝাতে চাইতো! আমি বলতাম- কাঁদছো কেন? উত্তর দিতো না। আমি ভাবতাম হয়তো মা-বাবাকে ছেড়ে এসেছে অথবা আমার সঙ্গহীনতা তাকে বিরহতায় ভোগাচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে তাকে আমি স্নেহের পরশে জড়িয়ে নিতাম। আমার বুকে মাথা রাখতে পারলে সে নিশ্চিন্ত হতে পারতো। এই নিশ্চিন্ততার বহুভাষা আমি তার চোখেমুখে দেখতে পেতাম। সে একটা কিছু বুঝাতে চাইতো আমায়। কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করলে বরাবরই নিরুত্তর থাকতো। বাড়ি থেকে চলে আসার সময় তার দু চোখের অঝোর শ্রাবণ আমার মাঝে এক ধরনের অপরাধবোধ জন্ম দিতো। কিন্তু আমি জানতাম বাস্তবতা একটাই, আমাকে যেতে হবে।
আমি যা-ই আনি না কেন সানন্দে গ্রহণ করতো সে। কোনো অভিযোগ করতো না। প্রত্যেক নারীর দুটো প্রিয় জিনিস থাকে। এর একটি গহনা অন্যটি ফুল। বিয়ের সময় আমি তাকে পর্যান্ত পরিমাণে অলঙ্কারাদি দিতে পারিনি। যে সামান্যই স্বর্ণালঙ্কার দিয়েছিলাম তাও আমার প্রবাসি ছোট ভাইয়ের সৌজন্যে। বিয়ের সময় দু একটি আংটি যে উপহার আসেনি তা কিন্তু নয়। তবে যে একটা অঙ্গুরি দিতে হয় তা জানা থাকলেও সেই বিষয়ে আমি সিরিয়াস ছিলাম না। তবুও তার প্রতি কিসের একটা টান অনুভব করেছিলাম। আমার এখনো মনে হয় এটা একটা স্বর্গীয় নিষ্পাপ প্রেমের প্রথম শিহরণ। কোনো এক সময় তার হারটা দেবরের বিশেষ প্রয়োজনে ধার দিতে হয়েছিলো। এমনকি উপহারের অঙ্গুরিসহ যা ছিলো তার সবটাই দিয়ে দিয়েছে। কেবলই নাকফুলটা অবশিষ্ট ছিলো। এসবে আমাকে সে একবারও জিজ্ঞেস করেনি। আমি জানতে পারলে এ কাজের জন্য তাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, তার প্রতি আমার আন্তরিকতা বেড়ে গিয়েছিলো। সে চাইতো আমি যেন মিতব্যয়ী হই। আমার যা স্বভাব; আমি তো আর মিতব্যয়ী হতে পারি না। রোজগারের সবটুকু পরিবারের খরচে আনন্দ পেতাম, ভালো লাগতো। এরই মাঝে সাফোয়ান-কায়েনাত আমাদের শূন্যনীড়ে পূর্ণতা নিয়ে আসে। চাহিদার ব্যাপ্তিও বেড়ে যায়। এখন আমি ভয়ে তাকে কল দিই না, যদি চাওয়ার ফর্দটা দীর্ঘ হয়। আমি না চাইলেও সে বলতে চায়। যে মেয়ে কিনা চাইতে বললেও চাইতে জানতো না; সে কিনা এখন গুছিয়ে অর্ডার করতে জানে! হ্যাঁ, সে এখন আবদার করে না; অর্ডারই করে। আমিও শুনে যাই। শুনতে হয় আমাকে। তার কথাতে মাঝেমাঝে স্বর্ণ ও অঙ্গুরির কথাও ওঠে আসে; কখনো অর্ডার, কখনো আবদার আবার কখনো অভিমানি সুরে। ইতোমধ্যে আমিও যে একেবারে তাকে কিচ্ছুটি দেইনি তা কিন্তু নয়। তার এখন একটা গলার হার, কাঁকন, দুই জোড়া কানের দুল হয়েছে। কিন্তু অঙ্গুরি আজও হয়নি। হয়নি মানে আমি দিতে পারিনি। আজকাল তার সাথে আমার একযুগের ভালোবাসা কখনো সখনো অভিমান কিবা আবদার হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। আমি সিদ্ধান্ত নিই এবার কিন্তু তাকে একটা আংটি দিবোই দিবো। কম ওজনের হলে চলবে না, কম করে হলেও চারআনা। আমার পরিকল্পনা কল্পনায় আটকে থাকে। ব্যর্থ হই আমি। তার অভিমান বাড়ে। এখন তার আবদারগুলি প্রতিবাদের ভাষায় রূপ নিয়েছে। শাসিয়ে বলে- আমার আংটি না নিয়ে এলে…। আমি কথা দিই কিন্তু তার বিশ্বাস হয় না। আমি প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরি কেবল অঙ্গুরি ছাড়া। আমি ভয়ে ভয়ে কপাটে মৃদু আঘাত করি। সে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে দরজা খুলে দেয়। নিজেকে সাজিয়ে আমার প্রতিক্ষায় থাকার অবসান ঘটায়। ভুলে যায় মান অভিমান। আমাকে পেয়ে কত কথাই না সে বলে কিন্তু অঙ্গুরির কথা ভুলেও বলে না। অঙ্গুরি আনতে ভুলে গেছি বললেই সে বলে- ভুলে যাওয়া তো আপনার অধিকার। এই অধিকার কবিরা রাখতেই পারেন। আমি তো আর আপনার অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারি না!- বলেই জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধ হাসিতে মেতে ওঠে আর আলতো চুম্বনে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয়। গভীর আলিঙ্গনে বেয়ানের অপেক্ষায় থাকে স্মৃতির রাতগুলি। স্মৃতির দেয়ালে লিখা থাকে একটি অঙ্গুরির কথা। পৃথিবী স্তব্ধ হয়। থেমে যায় রাতের গতি। ভালোবাসা থামে না। আমি আশ্বাস দিয়ে বলি, এবার কিন্তু সত্যি সত্যি নিয়ে আসবো।
সে কিচ্ছুটি বলে না। হয়তো সে ধরে নিয়েছে আমার সত্যিটা আর কোনো দিন সত্য হবে না! শুধু বলে- অঙ্গুরি চাইনে তোমাকে চাই। যে অঙ্গুরি ব্যথা দেয়, যে সোনা কাঁদায় তা আমি চাইনে। আমি তার দিকে চেয়ে দেখি এখনো প্রতিটি প্রভাত আসে প্রেম হয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অক্লান্ত শ্রমে। রাতের নিস্তব্ধতায় শ্যামবর্ণের ভালোবাসা হয়ে ভালোলাগার প্রতিক্ষায়। পূর্ণ হয় না আবদার শূন্যতার অরণ্য রোদনে। একটি অঙ্গুরির প্রতিক্ষায়।