অঙ্গহীন মানুষের জন্য ‘রোবোটিক হ্যান্ড’

90

হাটহাজারী প্রতিনিধি

অবিকল সুস্থ মানুষের হাতের মতো নড়াচড়া করছে কব্জি থেকে শুরু করে আঙ্গুলগুলো। ইচ্ছে মতো, যে কোনো দিকে ঘোরানো যাচ্ছে, করা যাচ্ছে মুষ্টিবদ্ধ। বোতল হাতে নিয়ে পানিও পান করা যাচ্ছে। অথচ এটি আসল হাত বা আঙ্গুল নয়। এটি চট্টগ্রামের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ইলেকট্রনিক্স ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত ১৯ বছর বয়সী জয় বড়ুয়া লাভলু তৈরি করা ‘রোবোটিক হ্যান্ড’। যা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে। মূলত অঙ্গহীন মানুষের জন্য স্নায়ুতন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন রোবোটিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করেন তিনি।
হাটহাজারীর ফতেপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বড়ুয়াপাড়ার ভাড়া বাসায় বসবাস করেন লাভলু। ক্ষুদ্র ফার্নিচার ব্যবসায়ী রবি বড়ুয়া তার বাবা। লাভলু দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট।
গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় লাভলুর ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, চারকক্ষ বিশিষ্ট ঘরের একটি ছোট্ট কক্ষকে ল্যাব বানিয়ে আপন মনে কাজ করছেন লাভলু। কখনো ল্যাপটপ থেকে কোড নিয়ে সেট করছেন রোবোটিক্স হ্যান্ডে, আবার কখনো জোড়াতালি দেয়া হচ্ছে ক্যাবলগুলোতে। এভাবে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে রোবোটিক হ্যান্ড তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছোটবেলা থেকেই ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির প্রতি লাভলুর আগ্রহ ছিল দারুন। ঘরে ব্যবহৃত কোনো জিনিস নষ্ট হলে তা খুলে ঠিক করতেন তার বাবা, তা দেখেই তার এসব কাজে আগ্রহ জন্মে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করলেও লাভলুর উদ্ভাবনের সংখ্যা একেবারে কম নয়।
স্থানীয় জোবরা পিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ার সময় লাভলু পরিচিতদের কাছে ‘খুদে বিজ্ঞানী’ হিসেবে পরিচিত ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তৈরি করেছে রোবট। সহপাঠি, শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধবরা তাকে ‘নিউটন’ বলে ডাকতেন। মেধার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বেশকিছু পুরস্কারও পেয়েছেন।
রোবোটিক হ্যান্ড তথা কৃত্রিম হাত তৈরির বিষয়ে লাভলু জানান, ২০১৭ সালের দিকে হাত তৈরির বিষয়টা তার মাথায় আসে। তখন এসএসসি শেষ করেছিল মাত্র। শুরুতে মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনেছে। অধিকাংশ যন্ত্রাংশ দেশে পাওয়া যায় না বলে চড়া দামে বিদেশ থেকে আনিয়েছেন। তার কৃত্রিম হাতের চারটা প্রজেক্ট আছে।
এর মধ্যে প্রথমটা হলো যাদের হাত গোড়ালির উপর থেকে কাটা, তাদের জন্য কৃত্রিম হাত। এটা হাতের কাটা অংশে স্থাপন করতে হয়। কৃত্রিম হাতের সেন্সরগুলো কাটা হাতের নার্ভ বরাবর সংযুক্ত করে দিলেই হয়। এতে স্নায়ুবিক আবেদনে সাড়ে দেবে কৃত্রিম হাতটি। ইতোমধ্যে হাতকাটা এক লোকের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে এটি।
দ্বিতীয় প্রজেক্টটি হলো যাদের কনুইয়ের উপর থেকে হাত কাটা তাদের জন্য। এটাও প্রথমটার মত সেট করতে হয়, কাজও করে সেভাবে। তৃতীয়টি স্বাভাবিক মানুষদের জন্য। এটা মূলত বুকের সাথে বেল্ট দিয়ে বেঁধে সেট করতে হয়। তবে এর নিয়ন্ত্রণ থাকে পায়ে। মানুষের অন্য দুই হাতের পাশাপাশি এ হাত দিয়েও সারানো যাবে স্বাভাবিক কাজকর্ম। এ প্রজেক্টটি ২০১৮ সালে ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত আইডিইবির ইনোভেশন ল্যাবে একটি রোবট প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। তাছাড়া অন্যটি হলো ওয়ারল্যাস হ্যান্ড। মানুষের স্বাভাবিক হাতকে দূর থেকে অনুকরণ করতে পারে এ হাত। এ হাত দিয়ে মূলত দূর থেকে বোমা নিষ্ক্রিয় করার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করা যাবে।
ক্ষুদে বিজ্ঞানী লাভলু বলেন, যারা বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, বিভিন্ন লোহা ফ্যাক্টরি এবং বিপদজনক কাজ করার সময় এ রোবোটিক ওয়ারলেস হাত ব্যবহার করতে পারবেন। যেটা কন্ট্রোল করা হবে মানুষের হাতের সাথে লাগানো একটি ট্রান্সমিটার হাতের সাহায্যে।
এতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে শ্রমিকরা তাদের হাতকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবেন। এর মধ্যে যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাদের জন্য এটি খুবই উপকারী হতে পারে। মাত্র ১৫ হাজার টাকা খরচ পড়েছে হাতটি তৈরি করতে। তবে পরিবারে কিছুটা আর্থিক অনটন থাকায় ইচ্ছা থাকলেও এ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যদের প্রত্যাশা লাভলু একদিন বড় বিজ্ঞানী হবে।
ডিপ্লোমা শেষ করে লাভলুর ইচ্ছে ঢাকা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। এছাড়া ভবিষ্যতে একটি বড় রোবোটিক্স প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। লাভলু বাংলাদেশ রোবট সাইন্স এন্ড ইনোভেশন সেন্টার নামে একটি অর্গানাইজেশন চালু করেন, সেখানে তিনি স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে রোবোটিক্স সম্পর্কে নানা রকম ধারণা প্রদান করছেন।
লাভলুর মা রীনা বড়ুয়া ও বাবা রবি বড়ুয়া জানান, তাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। অনেক কষ্টে দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। লাভলুর জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা চান তারা।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শাহিদুল আলম বলেন, লাভলু ‘রোবোটিক হ্যান্ড’ তৈরি করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে নাসা স্পেস অ্যাপ চ্যালেঞ্জে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম স্থান অর্জন করে লাভলু ও তার দল। এছাড়া তিনি চ্যানেল আই এসো রোবট বানাই টিভি শোতে এগরিকালচার রাউন্ড থেকে ২য় স্থান অর্জন করেন। ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘আবিস্কারের খোঁজে’ প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট রানারআপের পুরস্কার পান। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতা, চট্টগ্রাম নগর ও হাটহাজারীতে স্থানীয়ভাবে আয়োজিত বিজ্ঞান মেলা ও বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় তিনি একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন।