অগ্নি দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেক বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে

30

তুষার দেব

এবারের শুষ্ক বা শীত মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে নগরী ও জেলায় এরইমধ্যে দুই ডজনেরও বেশি অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছোট-বড় আগুন লাগার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে নগরীর স্টেশন রোডের নূপুর মার্কেটের জুতার গুদাম ও রাঙ্গুনিয়ায় পারুয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ার সিএনজি অটোরিক্শাচালক খোকন বসাকের বাড়িতে আগুনে পুড়ে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়ার অগ্নিকান্ডের উৎস রান্নার চুলা বলে ধারণা করা হলেও নূপুর মার্কেটের জুতার গুদামে আগুন লাগে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে।
কেবল নূপুর মার্কেটের দুর্ঘটনায় নয়, বিদায়ী ২০২২ সালে চট্টগ্রামে সংঘটিত সর্বমোট অগ্নি-দুর্ঘটনার প্রায় ৫০ শতাংশের উৎস ছিল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। এমনটাই জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
অপরদিকে, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আগুনের ঝুঁকি’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ২০১৫ সাল থেকে গত সাত বছরে ৩ হাজার ১১৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার ৬৬ শতাংশেরই উৎস ছিল বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। বাকি ১১ শতাংশ রান্নাঘরের আগুন, ১৩ শতাংশ বিপদজনক উপাদান (রাসায়নিক পদার্থ), ৯ শতাংশ সিগারেটের আগুন আর ১ শতাংশ অন্যান্য কারণে সংঘটিত হয়েছে। অগ্নিকান্ডের ৪৭ শতাংশ ঘটে আবাসিক এলাকায়। বাণিজ্যিক এলাকায় ঘটে ২৭ শতাংশ। এ সময়ে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আহত হন ১১৫ জন এবং মারা যান ২৯ জন।
ফায়ার সার্ভিস ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বা ওভারলোডিং, ত্রæটিপূর্ণ সরবরাহ লাইন, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের লাইন ও যন্ত্রপাতি নিয়মিত চেকআপ ও প্রতিস্থাপন না করার কারণে চট্টগ্রামে বৈদ্যুতিক ত্রুটি থেকে অগ্নি-দুর্ঘটনা বাড়ছে। সতর্কতা অবলম্বনে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে আরও শক্তিশালী করা এবং তাদের ফায়ার ইক্যুইপমেন্টের যে অভাব আছে, তা দ্রæত পরিপূর্ণ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ৯৪৭টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডের ৮৮৭টি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া ৩৯০টি সিগারেট ও ১৪৭টি চুলার আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে। একই সময়ে চট্টগ্রাম জেলায় ৬৭০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে ৩৩২টি। এছাড়া বিভাগের আওতাধীন কুমিল্লায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ৬৩৫টি, নোয়াখালীতে ২৯৮টি, রাঙামাটিতে ১০৭টি, বান্দরবানে ৪০টি ও কক্সবাজারে ১৭৯টি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মোবিলাইজিং অফিসার কামাল উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামে অগ্নিকান্ডের ৫০ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। এরপর ২০ শতাংশের ওপরে রয়েছে গ্যাসজনিত ত্রুটি। গত এক বছরে চট্টগ্রামে আগুনে ক্ষতি হয়েছে ৭ কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার টাকার সম্পদ। শুধু চট্টগ্রামে গত এক বছরে আগুনে মারা গেছেন সাতজন। এছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ১৯ জন। বিভাগওয়ারী হিসাবে চট্টগ্রাম, কুমিল্ল, নোয়াখালী, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় গত এক বছরে আগুনে ক্ষতি হয়েছে শত কোটি টাকার সম্পদ। এ সময়ে আগুনে মারা গেছেন ৭৫ জন। ২০২১ সালে ১ হাজার ৬১৩টি আগুনের ঘটনা ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে। এসব ঘটনায় দগ্ধ হন ৪২ জন, মারা যান ১৪ জন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত বছর যেসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে তার বেশির ভাগই বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। যার অন্যতম কারণ ওভারলোডিং। দেখা গেছে, এক বাসা-বাড়িতে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক চুলা, ফ্রিজসহ বিদ্যুৎচালিত বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্ত্যু বৈদ্যুতিক তার যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো সঠিক মানের না বা লোড নিতে পারছে না। ফলে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে সেখান থেকেই। এছাড়া বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক যে তার ও সুইচ লাগানো হয়েছে, তা নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয় না। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের কারণে সেখান থেকে সৃষ্ট গোলযোগে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাড়ছে। তিনি বলেন, অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন, অগ্নি-নির্বাপণ মহড়া, লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে ফায়ার সার্ভিস।