অগ্নিঝরা মার্চ

9

নিজস্ব প্রতিবেদক

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ মাসে বাঙালি জাতি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, বিদ্রোহ-বিক্ষোভে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিল। শেকল ছেঁড়ার অদম্য আকাঙ্খায় দুরন্ত-দুর্বার হয়ে উঠছিল গোটা দেশের মানুষ। প্রয়াত শিল্পী কামরুল হাসানের (পটুয়া) আহবানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভায় চিরপরিচিত শাপলাকে জাতীয় ফুল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঘোষণা শেষে মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন আরও বেশি উৎসাহী করে তুলতে শিল্পীরা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিলি করেন।
একাত্তরের ১০ মার্চ জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব উথান্ট এক নির্দেশে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত জাতিসংঘের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি যেন সদর দপ্তরে ফিরে যান। এ নির্দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ দেশের মানুষও এই পৃথিবীর বাসিন্দা। তাই তাদের প্রতিও জাতিসংঘের দায়িত্ব রয়েছে।
অন্যদিকে ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকান্ড। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকি সামরিক জান্তা দমে যেতে থাকে। মার্চের শুরুতে পতাকা উত্তোলন এবং ইশতেহার পাঠের পর থেকে বাঙালির স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্খা আরও তীব্র হতে থাকে। পেশাজীবীরা পথে নেমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সবকিছু পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে।
একাত্তরে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এসে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারা আন্দোলনে অর্থের জোগান দিতে তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দেন। এই দিনে রাস্তায় নেমে আসেন শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কর্মজীবী সবাই। শ্লোগানে শ্লোগানে মাতিয়ে রাখে ঢাকার রাজপথ। পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনকে আরও সংঘবদ্ধ ও জোরদার করতে রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তানবিরোধী শ্লোগানে রাজপথকে উত্তাল করে তুলে জনতা। শিল্পী মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে চারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এ পরিষদ বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। একাত্তরের মার্চ মাসের দিনগুলো ছিল থমথমে, উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কায় পরিপূর্ণ। চাপা উদ্বেগ, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। কি ঘটবে, কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত-উৎকণ্ঠিত ছিলেন সবাই। অবরুদ্ধ গণমানুষ ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছিলেন চ‚ড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। লক্ষ্য একটাই-নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কারণ, ততদিনে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানি বেনিয়া ও দুর্বৃত্ত শোষকগোষ্ঠী বাঙালিকে তার ন্যায্য অধিকার কোনোদিনই দেবে না। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই জাতির সামনে স্পষ্ট বার্তা এসে যায়, বিনাযুদ্ধে পাক হানাদাররা কিছুই মেনে নেবে না। আসবে না হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন মহার্ঘ স্বাধীনতা। যুদ্ধ করেই যে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে হবে- এটি বুঝতে পেরে সারাদেশেই বীর বাঙালি রণপ্রস্তুতি নিতে থাকে।